চার-ছক্কায় মোদি-নওয়াজ ভাই ভাই?

৬৮ বছর কেটে গেল। প্রতিবেশীর বেড়া কাটার অভ্যাস যায়নি তাদের। সুযোগ পেলেই দু-চারজন প্রতিবেশী ভাইয়ের রক্তে হাত ভিজিয়ে নেয় তারা। ১৯৪৭ সালে যে ধর্মের বেড়ায় ভাগ হয়েছিল তারা, সেই বেড়ার কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে আজো ঝুলে থাকে কারো কারো লাশ। সীমানা বেড়া ডিঙিয়ে ভারতের ঘরে ঢুকে বোমা ফাঁটিয়ে লাশ ফেলানোর স্পর্ধাও দেখায় ‘ধার্মিক’ প্রতিবেশীরা। কীসে মিটবে এই জাতশত্রুতা, ধর্মের বাড়াবাড়ির খেলা?

বছরের পর বছর কেটেছে, সম্পর্ক সংকটের কোনো সমাধান নেই। পারলে একে অপরের মুখই দেখে না, এমন ভাব। তারপরও থেকে যায় হাজার বছরের সমুদ্রসমান স্মৃতি, রক্তের প্রবাহ যা কখনো কখনো প্রবল হয়ে ওঠে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয় ১৯৪৭ সালে। কিন্তু তার আগে হাজার হাজার বছর ধরে তারা ছিল এক মানচিত্রে। সময়ের ¯্রােতে সেই মানচিত্র আজ তিন খ-ে ভাগ হয়ে গেছে। তাই বলে শত্রুতার সম্পর্ক আর কত দিন? প্রতিবেশী ভাইয়ের হাত ধরে চলার কোনো কি সুযোগ নেই? শেষ হবে নাকি এই সংঘাতের খেলা? হ্যাঁ, হবে। হোক বা না-ই হোক, আশায় বুধ বাঁধতে দোষ কী? ক্রিকেট খেলার মধ্য দিয়ে সেই পুরোনো খেলা শেষ হবে হয়তো।

এখন এই একটি বাদে আর সব জানালা বন্ধ। যে জানালা দিয়ে বন্ধুত্ব হতে পারে। ক্রিকেট। এ যেন হাড়েহাড়ে উপলব্ধি করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ক্রিকেটের মাঠে ভারত-পাকিস্তান শুধু খেলোয়াড়। খেলার মাঠের ২২ জন ভারত-পাকিস্তানকে একই উন্মাদনায় ভাসায়। গ্যালারিতে এক পাকিস্তানির পাশে আরেক ভারতীয় বসে কোমল পানীয়র বোতলে মুখ লাগায়! কারো পাশে কেউ শত্রু নয়, দর্শক-বন্ধ, দেখতেই ভালো লাগে।

ভারতে খেলা হলে দলে দলে পাকিস্তানিরা আসে ভারতে। ভারতের মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাদের সখ্য হয়। আবার ভারতীয়দের বেলায়ও তাই। এসব সফরে দেখা হয় দেশ ভাগের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দু-দেশে বসবাস করা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে। দেশ ভাগের সময় অসংখ্য মুসলিম ভারত থেকে পাকিস্তানে গেছে আবার পাকিস্তান থেকে হিন্দুরা দলে দলে ভারতে এসেছে। কিন্তু দুই পক্ষেরই অনেক আত্মীয়স্বজন নিজ নিজ দেশে থেকে গেছে আপন মাটি আঁকড়ে। ক্রিকেট খেলার সুযোগে অনেকে শেকড়ের সন্ধানে নেমে ভিটামাটি স্পর্শ করতে পারে। এতে প্রতিবেশী দেশের জন্যও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়।

ভারতের জন্য ভালোবাসা আছে পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের। তার জন্মভূমি ভারত। মাটির টানে, নাড়ির টানে তাকে ভারতে আসতেই হয়। দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর তিনি ভারত সফর করেছেন, জন্মভূমির জন্য তার ভালোবাসার কথা বলেছেন। এই যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর অবস্থা, তখন ভাবুন তো, পাকিস্তানের কত মানুষ আছে, যাদের জন্মভূমি বা পৈত্রিক ভিটা ভারতে? এ সত্য অস্বীকার করা যায় না।

ভারত-পাকিস্তানকে বলা হয় জঠরজাত শত্রু। কারণ একই মাকে ভাগ করে তারা দুই হয়ে যায়। আজ তারা প্রতিবেশী, শত্রু। এই শত্রুতাকে ভুলে মমতার দাবি নিয়ে জন্মভূমি ভারতে গিয়েছিলেন নওয়াজ শরিফ। মোদি ভাইয়ের মায়ের জন্য এনেছিলেন শাড়ি ও শাল। সেদিন নওয়াজের দুই চোখে জল গড়িয়ে পড়িয়েছিল। মনে পড়েছিল তার মাকেও, যিনি ভারতের মাটিতে জন্ম দিয়েছিলেন নওয়াজকে।

এই নাড়ির সম্পর্ক কেমনে ভুলে থাকবে ভারত-পাকিস্তান? এবার দুই দেশই নড়েচড়ে বসেছে। ক্রিকেটীয় সেতু দিয়ে কাঁটা তার পাড়ি দিতে চাইছে তারা। আট বছর পর আবার হতে যাচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান ক্রিকেট দলের মধ্যে সিরিজ খেলা। পাকিস্তান বলেছে, তারাই প্রথম সিরিজের দায়িত্ব নেবে। আর বাকি থাকে কি? ভারতও তাতে রাজি।

এখানেই শেষ নয়। মঙ্গলবার ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সংসদীয় কমিটির বৈঠকে মোদি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে যত বেশি পারা যায়, ক্রিকেট খেলার বন্দোবস্ত করতে। বিজেপির কিছু নেতারা তাতে আপত্তি থাকলেও মোদি তা গ্রাহ্য করেননি। ‘ক্রিকেট কূটনীতি’ দিয়ে তিনি সম্পর্কের ছেড়া জাল নতুন করে বুনতে চাইছেন।

এ ছাড়া আর কোনো উপায় আছে কি ভারত-পাকিস্তানের জন্য। আছে বৈকি। তবে তা ৬৮ বছরের পুরোনো অস্তিত্বের সংকট। সেই সংকটের নাম সীমান্ত সমস্যা ও কাশ্মীরের মালিকানা। এর শেষ কোথায় তা হয়তো ভারত-পাকিস্তান কেউ বলতে পারে না। তবে ক্রিকেটকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে দু-দেশের জনগণকে এক আসরে হাজির করার যে প্রয়াস ব্যক্ত করেছেন মোদি, তা প্রসংশাযোগ্য। শান্তির জন্য হোক ক্রিকেট কূটনীতি। চার-ছক্কার হল্লায় মোদি-নওয়াজ হয়ে উঠুক ভাই ভাই।

লেখক : সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী।



মন্তব্য চালু নেই