শ্রীনিবাসনঃ তিনিই উকিল, তিনিই বিচারক

“তিনিই বাদীপক্ষের উকিল, তিনিই বিচারক।
তিনি সম্মানের পরোয়া করেন না।
ক্ষমতাই তাঁহার একমাত্র কাম্য।
তাঁহাকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
(তাহাকে রাখিয়া) ক্রিকেটকে বাঁচাইবার আর কোনও পথ নাই।”

হ্যা, তিনিই এন শ্রীনিবাসন; নারায়নস্বামী শ্রীনিবাসন।

কথাগুলো আমার নয়; ভারতের সবচেয়ে বড় বাংলা পত্রিকা, দেশটির অন্যতম প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম আনন্দ বাজার লিখেছে।

কার সম্পর্কে লিখেছে?

শ্রীনিবাসনের সম্পর্কে লিখেছে।

তারা লিখতে পারে। তাদের দেশের মানুষ, তারা দু কথা মন্দ বলতেই পারে। আমরা কী করে বলি!

আইসিসির চেয়ারম্যানকে এতোটা অপমান করা আমাদের ঠিক হবে না। আমরা বরং একটু খোজ নেই, কে এই এন শ্রীনিবাসন?

বর্তমান ক্রিকেট দুনিয়ায় সম্ভবত একক শক্তির বিচারে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ভারতীয় ক্রিকেট, ইংলিশ ক্রিকেট এই খেলাটিতে ভয়ঙ্কর ক্ষমতাশালী সব লোকেদের দেখেছে। কিন্তু নিশ্চিত করেই বলা যায়, এন শ্রীনিবাসনের মতো একক ক্ষতমাধর প্রশাসক ক্রিকেট ইতিহাস কখনো দেখেনি।

শ্রীনিবাসনের উত্থান তামিলনাড়ু থেকে।

পৈত্রিক সূত্রে ইন্ডিয়া সিমেন্টের প্রধাণ হয়েছিলেন। তার বাবা টিএস নায়ারনস্বামী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এখন ভারতের সর্ববৃহত এই সিমেন্ট প্রতিষ্ঠান। সেই ইন্ডিয়া সিমেন্টের আকাশে অবশ্য এখনও কিছু বিতর্ক ঘুরে কেবড়ায়। বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটির সহপ্রতিষ্ঠাতা শঙ্করলিঙ্গম ও তার ছেলে কে এস নারায়নের বঞ্চনার দীর্ঘশ্বাস লেগে আছে প্রতিষ্ঠানটিতে।

সে যাই হোক, ইন্ডিয়া সিমেন্ট সেই আশির দশকে তামিলনাড়ুর আঞ্চলিক ক্রিকেটের অন্যতম বৃহৎ স্পন্সর ছিলো। তারা স্থানীয় অনেক ক্রিকেটারকে চাকরিও দিয়েছিলো। তামিলনাড়ুর একাধিক ক্রিকেট টূর্নামেন্ট নিয়মিত স্পন্সর করতো ইন্ডিয়া সিমেন্ট।

বিভিন্নভাবে ক্রিকেটে টাকা দিতে দিতে একসময় এন শ্রীনিবাসনের মনে হল, ক্রিকেটের শাসনপ্রক্রিয়াতেও ঢোকা দরকার; মনে রাখবেন, ভারতে একটা সময় পর্যন্ত সংগঠকদের কাজ ক্রিকেটকে শাসন করাই বোঝানো হতো।

শ্রীনিবাসন তখন তামিলনাড়ুর শেরিফ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। সেই সময়ে বোর্ড পরিচালক পদে নির্বাচন করে হেরে যান। কিন্তু তাকে শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটে প্রথম নিয়ে আসেন তখনকার বিসিসিআই ও তামিলনাড়ু সভাপতি এসি মুত্তিয়া। স্কুলবন্ধু মুত্তিয়ার পরামর্শে শ্রীনিবাসন ভেলোর জেলা থেকে নির্বাচন করে বোর্ডে আসেন এবং সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান।

২০০২ সালে সর্বোচ্চ আট দফা সভাপতিত্ব করার পর মুত্তিয়া দায়িত্ব ছেড়ে দিলে তামিল নাড়ুর সভাপতি হন শ্রীনিবাসন। এখানেই প্রথম ভেলকিটা দেখান তিনি। মুত্তিয়া ভেবেছিলেন, তার পুতুল হিসেবে চলবেন শ্রীনি; কিন্তু উল্টো বাকী বোর্ড পরিচালকদের নানাভাবে কিনে নিয়ে তামিলনাড়ুতে প্রথম একনায়ক হয়ে ওঠেন।

তামিলনাড়ুর সূত্রে বিসিসিআইয়ে এসে কোষাধ্যক্ষ হন শ্রীনিবাসন।

মজার ব্যাপার কী জানেন? তাকে এই পদে নিয়ে আসেন জগমোহন ডালমিয়া। শ্রীনিবাসন শুরুর সেই দিনগুলোতে ডালমিয়ার এতোটাই ‘ভক্ত’ ছিলেন যে, তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সভাপতিত্ব শেষ হওয়ার পর ডালমিয়া যেন ‘আজীবন প্রধাণ পৃষ্ঠপোষক’ পদে থাকেন।

ডালমিয়া সে প্রস্তাব নেননি।

তখন বিসিসিআইয়ে ‘তিন বন্ধু’র এক গোষ্ঠী তৈরী হয়; শরদ পাওয়ার, শ্রীনিবাসন ও তরুন লোলিত মোদী। এরা তিন জনই তখন ডালমিয়া বলতে পাগল।

কিন্তু ডালমিয়া পদ ছাড়ার পর শুরু হয় সাবেক এই আইসিসি ও বিসিসিআই সভাপতিকে নিয়ে তদন্ত। সে তদন্তে ‘প্রমাণ’ হয় ডালমিয়া ১৯৯৬ বিশ্বকাপের তহবিল নিয়ে নয়-ছয় করেছেন। একটু কল্পনা করুন তো, এই আবিষ্কারটা কার ছিলো?

জ্বি, এটা বের করেছিলেন একসময়ের ডালমিয়া-ভক্ত এই শ্রীনিবাসন; তখন তিনি পাওয়ার-ভক্ত!

এই সময়েই অবশ্য ভক্তি বাদ দিয়ে শরদ পাওয়ারের বিপক্ষে যৌথভাবে রাজনীতি শুরু করেন শ্রীনিবাসন ও তার ডান হাত মোদী। ফলে একসময় পাওয়ার ছিটকে যান। টিকে থাকেন শ্রীনিবাসন ও লোলিত মোদী। এর মধ্যে ডালমিয়া আবার আদালত থেকে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে কলকাতার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে চলে আসেন। শ্রীনিবাসন প্রকাশ্যে ডালমিয়াকে আবারও ‘নিজেদের লোক’ বলেন।

এবার শুরু হয় মোদী উচ্ছেদ অভিযান। কারণ, তখন গুরু মুত্তিয়া, মেন্টর ডালমিয়া এবং তার সভাপতি পাওয়ার আর দৃশ্যপটে নেই। আছেন একমাত্র মোদী। মোদীকে একেবারে মামলার পর মামলা, পরোয়ানা-টরোয়ানা দিয়ে দেশছাড়া করেন শ্রীনিবাসন।

২০০৮ সালে আইন সংশোধন করে তিনি বোর্ড কর্মকর্তাদের আইপিএল দলমালিক হওয়া সহ বিভিন্ন ব্যবসার মালিক হওয়ার আইন পাশ করিয়ে ফেলেন। ফলে তিনি একাধারে বিসিসিআই সভাপতি, চেন্নাই সিমেন্টের চেয়ারম্যান ও আইপিএল দল চেন্নাই সুপার কিংসের মালিক হয়ে অবস্থান করেন।

এর ভেতর দিয়ে শ্রীনিবাসন হয়ে ওঠেন ভারতের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ক্রিকেট প্রশাসক; যার কোনো চ্যালেঞ্জার নেই, যার কোনো শত্রু নেই। আর এই জোরে ভারতের বিশাল বাজার দেখিয়ে আইসিসির দখল নিয়ে নেন তিনি।

ভারতের চেয়ে সেখানে বড় হয়ে ওঠে শ্রীনিবাসনের লাভালাভ। আইসিসিকে দিয়ে নিজের জন্য সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এক পদ সৃষ্ঠি করান-চেয়ারম্যান।

আর অন্য দিকে আইসিসিকে ভারতীয় বাজারের ভয় দেখিয়ে আইনি সব ক্ষমতা নিয়ে নেন তিন মোড়ল ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার হাতে।

শ্রীনিবাসন তখন কার্যতই বিশ্বের সম্রাট।

এমন সুখের দিন কে না চায়? আমি-আপনিও চাই এমন বিশ্ব কতৃত্ব অনির্দিষ্টকাল ধরে চলুক। কিন্তু কিছু ‘খারাপ’ লোক তো থাকেই, যারা অন্যের সুখ দেখতে পারে না। ভারতে তেমন কিছু লোকও আছে।

তেমনই একজন বিহার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। তিনি মামলা ঠুকে দেন যে, শ্রীনিবাসন যে আইন সংশোধনের বলে বোর্ড ও চেন্নাইয়ের দায়িত্বে আছেন; তা অবৈধ। এই মামলায় কেচো খুড়তে অনেক কেউটে পেয়ে যান আদালত।

ভারতের বিশিষ্ট সাবেক বিচারপতি জাস্টিস মুকুল মুদগালের (যিনি আইসিসির একবার সংষ্কার কমিশনেরও সদস্য ছিলেন)নেতৃত্বে গঠিত আদালতের তদন্ত কমিটি আবিষ্কার করে অনিয়মের পর অনিয়ম করে চলেছেন শ্রীনিবাসন।

জামাতা গুরুনাথ মেইয়াপ্পনেআইপিএল কেলেঙ্কারিতে গ্রেপ্তার হলেও পদক্ষেপ নেন, অবৈধভাবে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে ব্যবসা ও ক্ষমতা ধরে রেখেছেন শ্রীনিবাসন। আদালত তখন নির্দেশ দেন, শ্রীনিবাসনকে আরও তদন্তের স্বার্থে সরে দাড়াতে হবে। দফায় দফায় তাকে ডেকে ভৎর্সনা করা হয়। এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ ভারতীয় আদালত বলেন, ‘এতো সব অভিযোগের পরও তিনি কী করে পদে আছেন?তার পদে থাকাটা বিরক্তিকর। আমাদের মনে হয়, উনি অভিযোগগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন না।’
[২৩ মে, ২০১৪; জাস্টিন এ কে পাট্টনায়েক]

শেষমেষ চূড়ান্ত রায়ে আদালত জানান, শ্রীনিবাসনকে হয় বিসিসিআই পদের লোভ ছাড়তে হবে, নইলে ব্যবসা ও চেন্নাইয়ের দল ছাড়তে হবে। শ্রীনিবাসন ব্যবসা বেছে নিলেন, ক্রিকেট নয়। আর মজার ব্যাপার হল, দেশের ক্রিকেট থেকে বিতাড়িত ও ক্রিকেটকে ছেড়ে দেওয়া এই শ্রীনিবাসনকে মেনেই নিলো আইসিসি!

শ্রীনিবাসন, ভালো, নাকি মন্দ; সে বিচার মহাকাল করবে। আমরা শুধু আনন্দবাজারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আরেকবার বলতে পারি-
বিশ্বমঞ্চে সেই বাহুবল প্রদর্শনে ভারত কিছুমাত্র কুণ্ঠিতও নহে। কিন্তু, ‘ভদ্রতা’ বস্তুটি যে এখনও বিলুপ্ত হয় নাই, কথাটি মনে না রাখিলে মুশকিল। নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন এই কথাটি বেমালুম ভুলিয়া গিয়াছেন।



মন্তব্য চালু নেই