সেনা অভ্যুত্থান, গৃহযুদ্ধ না গণতন্ত্র, কোন পথে বাংলাদেশ?

বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পশ্চিমাগোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ কি দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে নাকি সামরিক শাসনে আবার ফিরে যাচ্ছে, নাকি অংগ্রহণমূলক গণতন্ত্রে ফেরার আন্দোলন জোরালো হচ্ছে- এরকম আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা।

সম্প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার বিষয়ক উপ-কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিয়ান দান প্রেদা নিজের লেখা এক নিবন্ধে বাংলাদেশের চলমান সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেনা হস্তক্ষেপ অথবা গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

“ঢাকায় ৭২ ঘণ্টা” শীর্ষক ওই নিবন্ধে ক্রিশ্চিয়ান প্রেদা-বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে উল্লেখ করেন- একদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ২০১৪ সালের নির্বাচনকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা দাবি করে তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যস্ত রয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অন্যতম একটি ছিল ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীদের বিচার করা। ইতিমধ্যে শেখ হাসিনার সরকার জামায়াতের অন্যতম নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ও কার্যকর করেছে। আরো কয়েকটি রায় কার্যকরের অপেক্ষায়। এ দুই দলের আধিপত্যের রাজনীতির কারণে দেশটিতে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। এতে নাগরিক ও সামাজিক অধিকার আরও উদ্বিগ্ন অবস্থায় পতিত হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশটি সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ও গৃহযুদ্ধের ঝুঁকিতে রয়েছে।

ওই লেখায় প্রেদা আরও বলেন, দেশটিতে এখন বিরোধীদের সন্ত্রাসী হিসেবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। প্রেদা উল্লেখ করেন, বিএনপি ও তাদের জোট দলগুলো হাসিনার সরকারকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করে নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনা ২৩২ আসনে জয়লাভ করে এবং এর মধ্যে ১৫৪টিতে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই জয় পায় ক্ষমতাসীন জোট। দুই মাস ধরে খালেদা জিয়ার অবরুদ্ধ দশার কথাও উল্লেখ করেন প্রেদা।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসে। ক্রিস্টিয়ান প্রেদা এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন। তারা তিন দিনের সফরে ২০টিরও বেশি বৈঠক করেন রাজনৈতিক দলের নেতা, ট্রেড ইউনিয়ন, উদ্যোক্তা, এনজিও ও মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে। ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গেও বৈঠক করেন।

প্রেদা তাঁর লেখায় উল্লেখ করেন- অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধের কারণে দেশটির স্থিতিশীলতা আজ প্রশ্নের মুখে পড়েছে। দ্বিমেরুকরণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান দেশটিতে। দুই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের একটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ, অপরটি বিএনপি। দল দু’টির মধ্যে তীব্র মতবিরোধ রয়েছে। এক দল আরেক দলকে সহ্য করতে পারে না। এই বিরোধ দেশটিতে অপরাধ, সহিংসতা ও উগ্রপন্থাকে উসকে দিয়েছে।

আওয়ামী লীগ সোশালিস্ট ও ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী। বিএনপি একটি প্রো বিজনেস পার্টি। দুই দলই ভারতমুখি। রাজনীতির এই মেরুকরণের ফলে দুই বড় রাজনৈতিক দলের রয়েছে ৫০ লাখেরও বেশি কর্মী-সমর্থক। বিপুলসংখ্যক এই কর্মী সমর্থক দেশব্যাপী বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে।

আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা সাত বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছেন। সংসদের দুই চারটি অধিবেশনে যোগ দেয়া ছাড়া ২০০৮ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত বিএনপি সংসদ বয়কট করে। তবে আইনগত অধিকার থেকেই ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি।

এর আগে নির্বাচন হতো তত্ত্বাবধায়কের অধীনে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থার ইতি ঘটায়। সরকারের এই পদক্ষেপ বিরোধী মহলে উত্তেজনার সৃষ্টি করে।

প্রেদা উল্লেখ করেন-‘বিএনপির নেতৃত্বে রয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। গত দুই মাস ধরে বলতে গেলে তিনি তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে বন্দী রয়েছেন। আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি অত্যন্ত কঠোর ভাষায় তার বিরোধীর (শেখ হাসিনা) সমালোচনা করেন। এর অবশ্য সত্যতাও রয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। ঢাকার রাজনৈতিক অভিধায় এটি একটি পরিচিত শব্দ।’

এই মুহূর্তে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলছে। বিএনপি নতুন নির্বাচন চায়। আওয়ামী লীগ বলছে তারা ক্ষমতার ম্যান্ডেট নিয়ে এসেছে। বিএনপির অভিযোগ আওয়ামী লীগ বৈধ উপায়ে ক্ষমতায় আসেনি। ২০১৪ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ২৩২ আসনে জয়ী হয়েছে। তবে এর ১৫৪টি আসনে এমপিরা জয়ী হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এসব আসনে আওয়ামী লীগ একজন করে প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়। এমন ঘটনা রোমানিয়ায় ঘটেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। সেখানে আইন করে একজন করে প্রার্থী মনোনয়ের কথা বলা হয়েছিল। বাংলাদেশে সেই ব্যবস্থা ফিরে আসায় রাজনৈতিক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে শুধু মেরুকরণ এবং চরম রাজনৈতিক উত্তেজনাই নয়, রাজনৈতিক বিরোধের এই রেশ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। সাংবাদিক ও চিকিৎসক সংগঠনের মতো পেশাজীবীরাও আজ দুই ভাগে বিভক্ত। এমন পরিস্থিতিতে কী ঘটতে পারে? সেনা হস্তক্ষেপ অথবা বিপরীতপক্ষে গৃহযুদ্ধ- এই আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর বেশ সুনাম রয়েছে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। খুব কম লোকই জানেন যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি সেনা পাঠানো হয়ে থাকে।

২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশ থেকে আরো ৪ হাজার সেনা পাঠানোর অনুরোধ করেন শেখ হাসিনা সরকারকে (যদিও প্রেদা লিখেছেন খালেদা জিয়ার নাম)। কিন্তু ওই সময় কিছু কিছু এনজিও রাজনৈতিক সঙ্কটকে সামনে নিয়ে আসে এবং বান কি মুনকে অনুরোধ জানায় তিনি যেন ওই সেনা সরবরাহের বিনিময়ে বাংলাদেশে নতুন নির্বাচনের আহ্বান জানান। তারপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশে নতুন করে নির্বাচন দাবি করে আসছে।

এছাড়াও, বাংলাদেশে চলমান অস্থিরতা ও সহিংসতার ঘটনায় জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রসমূহ এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ (এইচআরডব্লিউ) বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু কোনো মতেই পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সহিংসতার জন্য কারা দায়ি সে বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকারি দল বারবার বলছে বিরোধী দল রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সন্ত্রাসী ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দল বলেছে নাশকতা সরকারি দলের লোক এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী করেছে।

তবে এ ব্যাপারে যারা যেকথাই বলুক না কেন, নাশকতা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যে ঘটছে এবং এতে ব্যাপক প্রাণহানী হয়েছে একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

দু’মেরুতে অবস্থানে থাকা ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার নেত্বাধীন সরকার ও খালেদা জিয়ার নেত্বাধীন বিরোধী জোট পরস্পরকে ঘায়েল করতে বিভিন্ন সময়ে নানা কৌশল অবলম্বন করে আসছে। তবে বলা যায়- গেল ছয় বছরে রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগের দিক থেকে বরাবরই হাসিনা সরকার অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলো। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার যে বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র রক্ষা’ আর ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবস পালন করতে গিয়েই দু’পক্ষে রাজনৈতিক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এতে চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি থেকেই সরকার পক্ষ সারাদেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে বিরোধী জোট নেত্রীকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। আর বিরোধী পক্ষ ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবস পালন করতে না পারায় ৬ জানুয়ারি থেকে লাগাতর অবরোধের ঢাক দেয়। সেই সঙ্গে চলছে হরতাল-ধর্মঘট।

পরস্পর বিরোধী অবস্থানে গোটা দেশ দুই মাস ধরে কার্যত অচল। বোমা-পেট্রোলের আগুনে জ্বলছে যানবাহন, পুড়ছে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ, বোমায় জলসে হতাহত হচ্ছে শত শত মানুষ। মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে চলছে দগ্ধ মানুষের আহাজারি। এসব ঘটনার জন্য পরস্পরকে দায়ি করা হচ্ছে। অন্যদিকে চলছে বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। পেট্রোল বোমায় পুড়ে এবং বন্দুকযুদ্ধের নামে ইতোমধ্যে দেড়শতাধিক মানুষ মারা গেছে। ছোবলে গোটা দেশবাসী যেন আজ অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। এরপরও চলমান এই সহিংসতার শেষ কোথায় তা কেউ জানে না।

হরতাল অবরোধের ৫৬দিন পেরিয়ে গেলেও দৃশ্যত পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বরং আরো বেশি অবনতি হচ্ছে। পরিস্থিতি ক্রমেই বেসামাল হয়ে উঠেছে। বলা যায়, সার্বিক পরিস্থিতি অনেকটাই সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

দৃশ্যত: দুপক্ষই ‘বাঁচা মরার লড়াইয়ে’ লিপ্ত হয়েছে। এতে দেশের পরিস্থিতি আরো অবণতির আশঙ্কা রয়েছে। যেটা আলোচনার মাধ্যমে এখনো এড়ানো সম্ভব।

বলা যায়- রাজনীতিবিদদের একগুয়েমিতে দেশ আজ গভীর সংকটের নিমজ্জিত। সংকটের গভীরতা বিবেচনায় ‘পরিস্থিতি এমন যে, বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার পথে চলছে।’ আবার কেউ কেউ গৃহযুদ্ধের আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছেন। আর গৃহযুদ্ধ রাজনৈতিক সংকটের মধ্যদিয়েই আসে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা একই ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

এমন পরিস্থিতিতে তৃতীয় শক্তির উত্থানের আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন অনেকে । রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ আশঙ্কাকে একবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। বিশ্লেষকদের মতে, যেখানে গণতান্ত্রিক চর্চা রুদ্ধ হয়ে পড়ে, সেখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বিরাজমান থাকে। কেননা, অতীতেও এমন পরিস্থিতিতে জনগণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থেই দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে এগিয়ে আসতে দেখা গেছে।

দিন দিন সব কিছু অবনতির দিকে যাচ্ছে। এটি কারো জন্য শুভ নয়। অচিরেই রাজনৈতিক নেতারা সংকট নিরসন এবং এবিষয়ে একটা সমঝোতায় পৌঁছতে না পারলে চলমান অনভিপ্রেত পরিস্থিতির কারণে দেশে তৃতীয় শক্তি আসতে পারে! এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। যেহেতু এর পেছনে বেশ কিছু কারণও রয়েছে বলে মনে করছেন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশীলসমাজের সদস্যরা। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দেশের রাজনীতিতে অঘটনের পেছনে যে সব কারণকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চিহ্নিত করে আসছেন সেগুলোর মধ্যে- প্রথমত: ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক, দ্বিতীয়তঃ দেশে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব, তৃতীয়তঃ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া, চতুর্থঃ দুর্নীতির ফলে একশ্রেণী লোকের হঠাৎ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া, পঞ্চমতঃ ইসলামী ও স্যেকুলার শক্তির প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব বিদ্যমান রয়েছে।

সম্প্রতি জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জিএম কাদের) দেশের চলমান রাজনীতি, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রসঙ্গ, বাংলাদেশে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা, সরকারের একতরফা নীতি, ব্যাংক-বীমার নানা সংকট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এমন আশংকার কথাও ব্যক্ত করেছেন।

এছাড়া যে ধরনের পরিস্থিতিতে তৃতীয় শক্তির উদ্ভব হয় বর্তমানে সে ধরনের কিছুটা হলেও প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ জনগণের সবচেয়ে বড় আকাঙ্খা হলো- জানমালের নিরাপত্তা। কিন্তু বর্তমানে দেশের জনগণ জানমালের কোনো ধরনের নিরাপত্তা বোধ করছে না। কারণ রাস্তায় বের হলে তারা আবার অক্ষত অবস্থায় ঘরে ফিরতে পারবে কী না সে ধরনের কোনো গ্যারান্টিবোধ করতে পারছে না। ফলে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তির বাইরে তৃতীয় শক্তির অনুভব ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছে সাধারণ মানুষের মাঝে। প্রসঙ্গত, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে তৃতীয় শক্তির উদ্ভবকে স্বাগত জানানোর মনোভাব লক্ষ্যনীয়।

এছাড়া ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের আগস্টে ভারতীয় দৈনিক দা ইকোনমিক টাইমস এবং নিউইয়র্ক টাইমস এধরনের খবর প্রকাশ করেছিল যে, সেনা অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকার যে কোনো সময় ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে।

প্রতিবেদনটি যে উদ্দেশ্যেই প্রকাশ করা হোক না কেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তা একেবারে অমূলক ভেবে অবহেলা করলে চলবে না। কারণ আমরা যদি একটু পেছনে ফিরে যাই তবে দেখতে পাবো- বিগত ওয়ান ইলেভেনের কয়েক মাস আগে বিদেশি পত্রিকায় এ ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করে প্রতিবেদন কিংবা সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়েছিল। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও শহীদ জিয়াউর রহমানের সরকারের পতনের আগে এ ধরনের ভিনদেশী গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক রিপোর্ট আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয় এবং তা নিয়ে দেশে গুঞ্জনও চলছিল বেশ কিছুদিন। এ ছাড়া বেশ কয়েকবার ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনাও ঘটে। পরে সেটি সত্যে পরিণত হয়।

এমন কী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া সরকারের বিগত সময়ে কয়েক দফা সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। আর সেটা উপেক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল সতর্কতার সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার ফলে। অতীতের এসব ঘটনা থেকে বলা যায়, বাংলাদেশে দৃশ্যত: সেনা অভ্যুত্থানের মতো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা না থাকলেও, যে কোনো সময় এ ধরনের কোনো অঘটন যে ঘটবে না, এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

সার্বিক দিক বিবেচনায় তৃতীয় শক্তি দেশের জন্য ক্ষতি হলেও রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতায় রাজনৈতিক সংকটের কারণে সহিংস পরিস্থিতিতেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে তৃতীয় শক্তি ক্ষমতা গ্রহণ করার অনেক নজির রয়েছে। আর তৃতীয় শক্তির উদ্ভবের পেছনে বিদেশীদের এক ধরনের হস্তক্ষেপ বরাবরই ছিল। আমরা যদি সাম্প্রতিককালে থাইল্যান্ড, মিশরের দিকে লক্ষ্য করি তবে এমনটিই দেখতে পাই।

আর তৃতীয় শক্তির রাজনীতিতে কোনো ধরনের অঘটন ঘটলে হাসিনা-খালেদা কারো জন্য যে শুভকর হবে না তা বাস্তব। বরং তাদের ভুলের খেসারত গোটা জাতিকে দিতে হবে। ফলে আমাদের রাজনীতিবিদদের প্রতি আহবান রাখবো, অবিলম্বে জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং দেশের সুশীলসমাজ-বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন মহলের সংলাপের আহবানকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। অন্যথা কোনো ধরনের অঘটন ঘটলে কোনো পক্ষেরই যে লাভ হবে না, তা আমরা অতীত থেকেই শিক্ষা নিতে পারি। সর্বোপরি, দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে শত রাজনৈতিক মতবিরোধের মধ্যেও কিছু মৌলিক প্রশ্নে সব পক্ষকে একমত হতে হবে। তবেই জাতির বৃহত্তর স্বার্থ সংরক্ষিত হবে।

লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক
ই-মেইল: [email protected]



মন্তব্য চালু নেই