সংঘাতের জন্য দায়ী সরকার : ড. কামাল

সংবিধান প্রণেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন চলমান সংঘাতের জন্য সরকারকে দায়ী করেছেন। চলমান সংকট অনাকাঙ্ক্ষিত নাকি অনিবার্য ছিল-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, “দৃশ্যমান পরিস্থিতি দেখলে বলতে হয়, সংঘাত অনিবার্যই ছিল। কিন্তু এই সংঘাতের জন্য আপনি কোনোভাবেই সাধারণ মানুষকে দায়ী করতে পারেন না। এর জন্য প্রথমত আমি সরকারকেই দায়ী করছি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি একটি অসাধারণ বিজয় অর্জন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে আমরাও অবস্থান নিয়েছিলাম। পরে আমরা মহাজোট থেকে বেরিয়ে এলেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব জোট পাঁচ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। এই সময়ে সংবিধান সংশোধন করে বিতর্ক সৃষ্টি করলেও সরকার ৫ জানুয়ারি একটি পাতানো নির্বাচন করে পরিবেশ অস্থিতিশীল করেছিল। ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে খোদ সরকারের মধ্যেও দ্বিধা ছিল। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নিয়ম রক্ষার নির্বাচন উল্লেখ করে বলেছিলেন, অতিদ্রুত আলোচনায় বসা হবে। সরকারের অন্য ব্যক্তিরাও সবার অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। এই প্রতিশ্রুতির রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর সরকারের সুর পাল্টে যায়। সরকার তার ওয়াদা ভুলে গেলেও দেশের মানুষ তা ভুলে যায়নি। সুতরাং আমি মনে করি, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনই সংঘাতকে অনিবার্য করে তুলেছে। সংঘাত কেন অনিবার্য হয়ে উঠল, তার জবাব সরকারই ভালো দিতে পারবে। ”

সাপ্তাহিকের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. কামাল এসব কথা বলেন।

কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল বলেন, “এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ। চলমান সংকটকে আমি ভয়াবহ বলব। দেশের সাধারণ মানুষ এই পরিস্থিতি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে যে সংঘাত, বোমাবাজি, অগ্নিসংযোগ, রক্তপাত চলছে, তা কোনো সভ্য সমাজের কাজ হতে পারে না। অপরদিকে সরকার বিরোধী পক্ষের সঙ্গে যে আচরণ করছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। বিএনপি নেত্রীকে অন্তরীণ রেখে সরকার সংঘাত উসকে দিয়েছে। দেশে আইন আছে। কেউ অন্যায় করলে তার ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা সরকার নিতেই পারে। কিন্তু সরকার বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ব্যাপারে যে অবস্থান নিয়েছে, তা আইনের অপব্যবহার বলে মনে করছি। দেশের এই অবস্থা অনাকাঙ্ক্ষিত।”

৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে সরকারের স্ববিরোধিতায় আমরা কোথায় যাচ্ছি? এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “সরকার তার সুবিধামতো জায়গায় নেয়ার চেষ্টা করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ সেখানে যেতে চাচ্ছে কি না? সাধারণ মানুষ সরকারে আস্থা রাখতে পারছে না। রাষ্ট্র অকার্যকর হলে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য হয়ে দাঁড়ায়। আমি মনে করি, এখন গণমাধ্যমের ভূমিকার দিকে মানুষ চেয়ে আছে। মানুষ যেমন সংঘাতে বিশ্বাস করে না, তেমনি সরকারের নানা কৌশলেও আস্থা রাখছে না। জাতির বৃহৎ স্বার্থে গণমাধ্যম এখন শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। ”

ড. কামাল বলেন, “শাসক দল সব সময় বোঝানোর চেষ্টা করে যে, তারা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু সভ্যতার এই সময়ে আপনার কাছ থেকে গণমাধ্যম নিয়ে এমন অভিযোগ শুনতে পাওয়া মানেই গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। এটি আমার কথা নয়। রাস্তায় চলেন, দেখবেন সব মানুষ এভাবেই বলছে। আমরা বললে অনেক দোষ। কিন্তু চরম সত্য হচ্ছে, এ দেশের মানুষ অগণতান্ত্রিক শক্তিকে বেশি দিন সহ্য করতে পারে নাই। ৪৪ বছরে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যে অর্জন, তা সাধারণ মানুষের। বরং রাজনৈতিক দলগুলো সেই অর্জনে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী, পাকিস্তানবিরোধী ও এরশাদবিরোধী আন্দোলন সাধারণ মানুষই করেছে। আমরা রাজধানীর কেন্দ্রবিন্দুতে শহীদ নূর হোসেন চত্বর করেছি। নূর হোসেন যখন শহীদ হয়, তখন আমি ওর থেকে মাত্র ১০ কি ১২ হাত দূরে অবস্থান করেছিলাম। ওর কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল না। গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য এই সাধারণ মানুষটির আত্মত্যাগ। নূর হোসেনের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না।”

স্বাধীনতার এত বছর পরও গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খাচ্ছে? আর কত ঠেকতে হবে? এমন প্রশ্নে গণফোরাম সভাপতি বলেন, “যে গণতন্ত্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধ, তা আজও অনেক দূরে। এটি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য। ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর আমাদের জন্য বড় ক্ষতি। এর পেছনে ষড়যন্ত্র ছিল ঠিক, কিন্তু কেন ষড়যন্ত্র করল, কারা সুবিধা নিল, তা নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। ষড়যন্ত্রের কথা বলে আপনি সবকিছু দূরে রাখতে পারেন না। জর্জ ওয়াশিংটন আমিরকার স্বাধীনতার জনক। কিন্তু তাকে হত্যার শিকার হতে হয়নি। এখানেই অনেক প্রশ্ন থেকে যায়।”

তিনি বলেন, “গণতন্ত্র একদিনে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এটি চলমান প্রক্রিয়া এবং তা দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা পায়। মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রের জন্যই মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সংবিধান রচনা হয়েছে। সংবিধানে মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু এই অধিকার বারবার ক্ষুণœ হয়েছে। বেঁচে থাকার, কথা বলার অধিকার হারিয়ে ফেলছে। আজ গণমাধ্যমও কথা বলতে পারছে না। নিরাপত্তার নামে বাড়ির সামনে বালুর ট্রাক মোতায়েন করা হচ্ছে। চলাফেরার স্বাধীনতায় রাষ্ট্র নিজেই বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। স্বাধীনতার চার দশকে গণতন্ত্র উন্নত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমরা পশ্চাতের দিকে যাচ্ছি। ”

বালুর ট্রাকেই গণতন্ত্র আটকে যাচ্ছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. কামাল বলেন, “শুধু আমি নই, ১৬ কোটি মানুষ একই মত পোষণ করবে। আপনি মিডিয়াতে আপনার মতো করে যা খুশি তা-ই প্রচার করলেন। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষকে ভাঁওতাবাজি দিতে পারেন না। তাদেরও নিজস্ব মত আছে। বালুর ট্রাক দিয়ে গণতন্ত্র রক্ষা হয় না, বরং বিপন্ন হয়। সরকার তা-ই করছে।”

তিনি বলেন, “সরকার কোথায় যেতে চাচ্ছে, তা সরকারই হয়তো জানে না। ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল জনগণের বিজয়। ১/১১ অনেকেই অনেকভাবে দেখতে পারেন। কিন্তু আমি মনে করি, ১/১১-এর ঘটনা না ঘটলে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচন হতোই। এই নির্বাচন বিএনপি তার মতো করে সাজিয়েছিল। আর আওয়ামী লীগ একই ধরনের নির্বাচন করেছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণ তার অধিকার ফিরে পেয়েছিল। কিন্তু জনগণ আবারও তার ভোটের অধিকার নিয়ে শঙ্কিত। ”

সংলাপ প্রসঙ্গে ড. কামাল বলেন, “ক্ষমতার মোহে দুই জোটই সংকট সৃষ্টি করেছে। দৃশ্যত সমাধানে তাদেরই প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে। তবে আমি মনে করি, কার্যকর একটি রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে হলে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। দেশে আরও রাজনৈতিক দল আছে, অনেক সংগঠন আছে। তাদের সঙ্গেও আলোচনা করা জরুরি।”



মন্তব্য চালু নেই