বিজেপি বা মোদি সরকারের মনোভাব কি বদলেছে?
ভারতের কেন্দ্রীয় বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ। তিনি খালেদা জিয়াকে ফোন করেছেন নাকি করেন নাই বাংলাদেশে এ নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। এ নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মিডিয়া সরগরম। অমিত শাহ ফোন করে থাকেন কিমবা না, হাসিনা সরকারের প্রতি বিজেপি বা মোদি সরকারের মনোভাব কি বদলেছে? বিশেষ করে বাংলাদেশের চলমান অবরোধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে? যদি বদল হয়ে থাকে তবে বুঝার উপায় কী?
গত ২ জানুয়ারি ২০১৪ পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির এক নেতা তথাগত রায় বাংলাদেশে এসেছিলেন। পরিচয়ে তিনি বিজেপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সাবেক সভাপতি। তিনি বাংলাদেশের হিন্দুদের এক ধর্মীয়-সামাজিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে এসে বলেছেন, “বিজেপি সরকার উপলব্ধি করেছে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন দেয়া উচিত এবং সেই কাজটি তারা করেছে। এটা আমি আপনাদের নিশ্চিত করেই বলতে পারি”। [ প্রথম আলো ২ জানুয়ারি ২০১৫]
এখানে সমর্থন মানে কী? বিগত কংগ্রেস সরকার সমর্থন বিষয়টাকে যে বাড়াবাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল তেমন বা সে মাত্রায়? বিগত কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশের জনগণকে উপেক্ষা করে তার পছন্দের সরকার রাখার ব্যাপারে মরিয়া হয়েছিলেন, গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগের মাসেও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং ভারতের পছন্দের সরকার কায়েমের ব্যাপারে মরিয়া অবস্থান নিয়েছিলেন।
অমিত শাহের টেলিফোন করা না করা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিতর্কিত হয়ে আছে। এর ভেতরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের কোনো ভূমিকা নেই, আগামী দিনেও থাকবে না। বাংলাদেশ কিভাবে চলবে তা সে দেশের সরকার ও জনগণই ঠিক করবে।’ প্রথম আলো, ১৩ জানুয়ারি ২০১৫।
এখন এই বক্তব্য কি অমিত শাহের টেলিফোন করা না করা নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্কের কোনো অবসান ঘটাল? প্রত্যক্ষভাবে অবশ্যই নয়। দৈনিক যুগান্তর থেকে জানা যাচ্ছে, অমিত শাহ বিষয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেও তিনি এর জবাবে বলেন, ‘বাংলাদেশে কী ধরনের সমাজ থাকবে, কোন বিষয় প্রাধান্য পাবে, তা ঠিক করে দেয়ার কেউ ভারত নয়। বাংলাদেশের সরকার ও সে দেশের জনগণই ঠিক করবে কোন সমাজে কিভাবে তারা থাকবে।’
তাহলে কী দাঁড়াল?
তবুও অনেকে এই বক্তব্যে অমিত শাহ ফোন করেননি, এমন অর্থ বের করার চেষ্টা করবেন হয়তো। সে চেষ্টা বিফলে যাবে সন্দেহ নেই, আর বিতর্কের অবসানও হবে না। তবে এই বক্তব্য থেকে সবাই মানবেন, এমন কিছু সিদ্ধান্তে আসা যায়।
যেমন শেখ হাসিনার প্রথম পাঁচ বছর আর পরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে যেভাবে রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ ও সাংবাদিকদের সাথে আলাপে স্পষ্ট করেছিলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন তাদের শেখ হাসিনাকেই চাই। এমন প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের জায়গায় মোদির সরকার এখন নেই, এটা আকবরউদ্দিন পরিষ্কার করেছেন। সুজাতা সিং চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে আমাদের মিডিয়াকে সে সময় নিজে দুটো বাক্য বলেছিলেন। এক. নির্বাচন হওয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় হাসিনার এগিয়ে যাওয়া উচিত। দুই. সবাইকে নিয়ে নির্বাচনের চেষ্টার বদলে যত বেশি দলকে পারা যায় তাদের নিয়ে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। আর ওইদিকে এরশাদের সাথে দেখা করে তাকে বলেছিলেন, জামায়াত ক্ষমতায় এসে যাবে, সেটা ঠেকাতে এরশাদের নির্বাচনে যাওয়া উচিত। এখন সৈয়দ আকবরউদ্দিন আমাদের বুঝিয়ে দিলেন তিনি কোনোভাবেই সুজাতা সিং নন। সুজাতা সিং এখনো ভারতের পররাষ্ট্র সচিব থাকলেও তিনি এখন কংগ্রেসের নয়, মোদির সরকারের সচিব হয়ে আছেন। এ কথাটাও সৈয়দ আকবরউদ্দিন প্রচ্ছন্নে আমাদের জানালেন। তবে সুজাতার চক্ষুলজ্জা ফিরে এসেছে কি না আমরা এখনো জানি না।
গত বছর তিনি মোদির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফরের সময় সঙ্গী হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু মোদি সরকার চায়নি তিনি আবার বাংলাদেশের মিডিয়ার মুখোমুখি হন অথবা সুজাতার পুরান বক্তব্য ঘেঁটে মোদি সরকারকে কোনো বিব্রত পরিস্থিতির মুখে ফেলেন। ফলে আমরাও জানতে পারিনি সুজাতা সিংয়ের চক্ষুলজ্জা ফিরেছে কি না। সেই থেকে সৈয়দ আকবরউদ্দিনই মিডিয়ায় বাংলাদেশ ইস্যু সামলাচ্ছেন। অবশ্য ওপরের কথাগুলোর অর্থ এমনও না যে বিড়াল মাছ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। অর্থাৎ সব রাষ্ট্রই নিজের স্বার্থ, সক্ষমতা আর সুযোগ অনুযায়ী অন্যকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে থাকে। এটা বন্ধ হয়ে গেছে বা যাবে, সে কথা এখানে বলা হচ্ছে না। তবে সেটা কূটনৈতিক সীমা, কনভেনশন আর শোভন বা চক্ষুলজ্জা ইত্যাদি সীমায় থেকে অপ্রকাশ্যে চলতেই থাকবে। এটাই স্বাভাবিক।
সৈয়দ আকবরউদ্দিনের এই বক্তব্য একই সাথে এ বছরের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের বাংলাদেশে এসে দাবি করা বক্তব্যকেও নাকচ করে দিয়েছে।
ওইদিকে কলকাতার আনন্দবাজার ১০ জানুয়ারি জানিয়েছে, ‘বিজেপির মুখপাত্র রবিশঙ্কর প্রসাদ এ দিন দিল্লিতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করলেও খালেদাকে তার দলের সভাপতির ফোন করা বা না করা নিয়ে একটি কথাও বলেননি। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক থেকেও সরকারিভাবে কোনো বিবৃতি দিয়ে বিষয়টির মীমাংসা করা হয়নি।’ এই পরিস্থিতি দেখে আনন্দবাজার ওই রিপোর্টের শেষে মন্তব্য করেছে, ‘তবে কি বিজেপি বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না, নাকি বিএনপির সাথে ভবিষ্যৎ বোঝাপড়ার পথ খোলা রাখতেই মুখ বন্ধ রাখার কৌশল।’
প্রথমত : বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের বক্তব্য সংক্রান্ত এই খবরটা নিশ্চিত খবর বা মোদি সরকারের অবস্থান হিসেবে নিতে আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে। কারণ শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি সরকারের সম্পর্কের মধ্যে সাম্প্রতিক এমন কোনো আনুষ্ঠানিক দৃশ্যমান প্রকাশ কিছু দেখা যায়নি যা থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে মোদি কংগ্রেসের মতো ও মাত্রায় হাসিনার সমর্থক হয়ে উঠছেন। বিজেপির নেতা তথাগত রায় মোদির বিজেপি সরকারের ঠিক কেউ নন অথবা এই বিষয়ে কথা বলার সরকারি মুখপাত্র ধরনেরও কেউ নন। তিনি নিজে এটা দাবিও করেননি। এমনকি এ ব্যাপারে তিনি যে সতর্ক তার বক্তব্যে স্পষ্ট। তিনি বলছেন, “যদিও ভারত একটি দেশ। তারা আরেকটি দেশের সঙ্গে কাজ করবে এটি স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে বিজেপি নেতা হিসেবে আমার বলা উচিত না, তার পরও আমি আপনাদের জানাতে চাই।” একই বিষয়ে ৩ জানুয়ারি দৈনিক মানবজমিন বলছে, “আমি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে এটা বলতে পারি না। আমরা একটি দেশের সঙ্গে দেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করি। তবে বাংলাদেশের বিষয়টা ভিন্ন। আপনাদের (উপস্থিতদের উদ্দেশে) বোঝার জন্য বলছি”। অর্থাৎ তিনি মূলত বলছেন, সরকারি প্রতিনিধি তিনি নন ফলে আইনি ও কূটনৈতিক দিক থেকে কথাটা তার বলা উচিত না। এ দিকটায় তিনি সচেতন তবু তার অনুমিত একটা ‘সত্য’ কথা তিনি আমাদের বলবেনই। অর্থাৎ এতটুকু নিশ্চিত বলা যায়, খবরটা কেন্দ্রীয় বিজেপি দলের হয়তো কিন্তু মোদির সরকারের নিশ্চিত অবস্থান হিসেবে না নিয়ে বরং তা নিশ্চিত হতে আমাদের অপেক্ষা করাই উচিত হবে।
দ্বিতীয় কারণ
অপেক্ষা করতে চাওয়া বা নিশ্চয়তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করার আরো কারণ আছে। দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে বিগত পাঁচ বছরে একনাগাড়ে কিন্তু ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন এক রাজনৈতিক বিন্যাস বা পোলারাইজেশন বিরাট তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়েছে। সেই পটভূমির মধ্যে রয়েছে এই কারনটি। গত বছর ২০১৪ সালের ভারতের কেন্দ্রীয় লোকসভা নির্বাচনের (যেটার ফলাফলে মোদি প্রধানমন্ত্রী) সময়ে থেকে এর এক চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে। আর আগামী ২০১৬ সালের মে মাসের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে প্রাদেশিক বা বিধানসভা নির্বাচন। কিন্তু এর সাথে বাংলাদেশের কি সম্পর্ক তা বুঝতে একটু গভীরে যেতে হবে। ফলে পোলারাইজেশনের তাৎপর্য না বুঝলে বাংলাদেশের সাথে এই প্রাদেশিক নির্বাচনের সম্পর্ক বুঝা যাবে না।
আগামী ২০১৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশের সরকারে যেই থাক পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বাংলাদেশ নামটা নানা উছিলায় বারবার উচ্চারিত হতে থাকবে। মনে রাখতে হবে পশ্চিমবঙ্গ বলেছি ভারত বলি নাই। এই নির্বাচনে নির্ধারক ঘটনা হলো, পশ্চিমবঙ্গে মোট ভোটারের ২৮% ভোটার মুসলমান। এটা এখন খুবই নির্ধারক এক তথ্য। ইতোমধ্যে এই মুসলমান ভোটারদের ব্যাপক অংশ ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমুল কংগ্রেসের ভোটার সমর্থক হয়ে নতুন এক সমীকরণে একাত্ম হয়েছেন।
আগে ১৯৪৭ সালের পর থেকে এরা প্রথমে কংগ্রেসের ভোটার, আরো পরে আশির দশক থেকে সিপিএমের ভোটার পরিচয়ে এত দিন ছিল। এরাই এখন মমতার তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে এক অ্যালায়েন্সে একচেটিয়া পোলারাইজ হয়েছেন। আগের কংগ্রেস অথবা সিপিএমের ভোটার থাকায় সময় উভয় ক্ষেত্রে এরা ‘সেকুলার’ ভোটার পরিচয় নিয়ে ছিল। অর্থাৎ সেকুলার পরিচয় তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সঠিক অবস্থান ভাবতেন। কিন্তু এখন মমতা তাদেরকে ‘তারা যা তাই’, অর্থাৎ ‘সাচার কমিটি রিপোর্টের’ ভাষায় অবহেলিত এবং মুসলমান পরিচয়েই গ্রহণ করেছেন। ভারতের বিশ্লেষকেরা বলে থাকেন, ২০০৬ সালের শেষে প্রকাশিত ভারতের মুসলমানদের দুরবস্থাবিষয়ক যে বিস্তারিত সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, ‘সাচার কমিটি রিপোর্ট’ নামে যা পরিচিত, এটা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে এর প্রভাব পড়তে থাকে পশ্চিমবঙ্গের ভোট ও ক্ষমতার প্যাটার্নে। ঘটনার প্রভাবের প্রথম দৃশ্যমান বড় ধাক্কার প্রকাশ ঘটে ২০১১ সালে; যখন বিগত ৩৪ বছর ধরে একনাগাড়ে গেড়ে বসা সিপিএমের বামফ্রন্ট সরকার প্রাদেশিক বিধানসভার নির্বাচনে মমতার তৃণমূলের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
বিধানসভা ২০১১-এর ফলাফলে মোট ২৯৪ আসনের মধ্যে ১৮৪ আসন একাই মমতার পক্ষে যায়। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হন। মুসলমান ভোটারদের সাথে মমতার অ্যালায়েন্স তখনো তেমন পোক্ত হয়নি। কিন্তু মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে ভোটার ভাগিয়ে আনার শুধু তার মুখের প্রতিশ্রুতি নয়, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের যেসব সামাজিক, আইনি বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর সাথে ক্ষমতায় আসা মমতার সরকারের দেয়ানেয়া রফাগুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া সম্পন্ন হয়। এর বড় প্রকাশ মমতা রাজ্যসভায় মুসলমান ভোটারদের নেতা প্রতিনিধি হিসেবে প্রভাবশালী আহমদ হাসান ইমরানকে মনোনীত করে রাজ্যসভায় পাঠান। ভারতের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট লোকসভা আর প্রাদেশিক বিধানসভার সমন্বয়ে আরো একটা আইন প্রণয়নী প্রতিষ্ঠান হলো রাজ্যসভা। রাজ্যসভার সদস্য প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন না। প্রত্যেক প্রাদেশিক সরকারের রাজ্যসভায় সদস্য মনোনয়ন দেয়ার কোটা থাকে।
মুসলমান ভোটারদের সাথে মমতার এই অ্যালায়েন্সের গড়ে নেয়ার পরে এই অ্যালায়েন্সের তাৎপর্যের চরম প্রকাশ ঘটে গত বছর ২০১৪ সালের কেন্দ্রীয় লোকসভা নির্বাচনে। নির্বাচনের ফলাফলে লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গের ভাগে পড়া মোট ৪২টা আসনের ৩৪টি একা মমতা দখল করে। যেটা আগের ২০০৯ সালের নির্বাচনে ছিল মাত্র ২০ আসন। যদি মনে রাখি ২০১৪ সালের কেন্দ্রীয় লোকসভা নির্বাচনের মোদি-ঝড় বা জ্বরের কথা যেখানে প্রায় সব আঞ্চলিক দল উড়ে ধরাশায়ী হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ঝড়েও উল্টা মাত্র দুটো আঞ্চলিক দল, তামিলনাডুতে (মাদ্রাজ) এক আঞ্চলিক দল এবং কলকাতায় তৃণমূল, আগের চেয়ে আরো বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতার আসন সমর্থন নিয়ে উজানে উঠে দাঁড়িয়েছিল। মমতার রক্ষা পেয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ বলা হয় তিনি মুসলমান ভোটারদের সাথে আগেই অ্যালায়েন্স পোক্ত করেছিলেন বলে এই সফলতা আসে।
ওদিকে মোদি ঝড়ের গত নির্বাচনের পরে আরো কিছু প্রতিক্রিয়া আছে। ওই নির্বাচনের সময় থেকে ওঠা মোদি-ঝড়ের সুবিধায় বিজেপিও পশ্চিমবঙ্গে তাদের মোট ভোটের শেয়ার বাড়িয়ে আগের ৪% থেকে ১৭%-এ নিতে সমর্থ হয়। ভোটার পোলারাইজেশন ট্রেন্ড বিচারে দেখা গেছে, বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস এদের সেকুলার ব্লক আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আর তাদের ভোটাররা ছুটছে তৃণমূলের দিকে। আর এই ছুটাছুটিতে আবার বিজেপি ভোট বেড়েছে সম্ভবত মোদির দেখানো অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্নের কারণে। ফলে পশ্চিমবঙ্গে ২০১৬ প্রাদেশিক নির্বাচনে ক্ষমতা পেতে বিজেপি প্রচণ্ডভাবে আকাক্সক্ষী ও আগ্রাসী দল হয়ে উঠেছে। তাই আগামী ২০১৬ নির্বাচনে ‘২৮% মুসলমান’এই তথ্যটা প্রধান ফ্যাক্টর ও একে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে, দলগুলো নিজের নির্বাচন কৌশল সাজানো শুরু হয়ে গেছে। কারণ সবাই বুঝে গেছে, ‘২৮% মুসলমান’ ভোটারের বাক্স এখন মমতার হাতে। যা সহজে বদল হচ্ছে না। ফলে বাকি হিন্দু ও অন্যান্য ৭২% ভোটার ভাগ হবে তৃণমূল, বিজেপি, বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসসহ সবার মধ্যে। ফলে ‘মুসলমান’ শব্দটা ইতোমধ্যে মমতার সাথে গাঁটছড়া বেঁধে ফেলেছে, আর বাকি বিরোধী বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেসের কাছে আক্রমণের শব্দ ‘মুসলমান’, আর শব্দটা সরাসরি মুখে নিলে ইজ্জত যায় তাই টেনেটুনে এর আরো নতুন অনেক অর্থ হচ্ছে যেমন ‘জঙ্গি’, ‘অনুপ্রবেশকারী’, ‘জামাত’, ‘বাংলাদেশী’ ইত্যাদি।
এককথায় এই শব্দগুলোর সূত্রেই বাংলাদেশ নামটা বহু বিচিত্রভাবে আ্সা শুরু হয়েছে। এসবের সারকথা, এগুলো পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ভোটারদের মমতার দিকে পোল বদলের বিরুদ্ধে অন্যদের নির্বাচনী প্রতিক্রিয়া। আর এসব নির্বাচনী প্রপাগান্ডার ট্যাগ আমাদের ওপরও নানা উৎপাত নিয়ে আসছে।
বাংলাদেশের দিক থেকে দেখলে, আমরা এখন মোদি-হাসিনার সম্পর্ক কেমন সে বিষয়ে এই চারটি দল যে যখন যেভাবে বললে নিজের নির্বাচনী কৌশল অনুযায়ী পক্ষে বা বিপক্ষে কাজে লাগে সেভাবেই নানা ব্যাখ্যা দিতে দেখতে পাচ্ছি, আগামীতে আরো পাব। বিজেপি নেতা তথাগত রায় বাংলাদেশে এসে যে বয়ান দিয়েছেন তা এই আলোকে দেখাই বুদ্ধিমানের হবে। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে এই বক্তব্যগুলো সত্য-আধাসত্য-মিথ্যা যাই হোক এগুলো মূলত একেবারেই পশ্চিমবঙ্গের দলগুলোর আঞ্চলিক নির্বাচনী স্বার্থমূলক বক্তব্য, তাও আবার একেবারেই নির্বাচনী প্রচারনার অংশমাত্র। কোনোমতেই এই বক্তব্য বা প্রচারনা মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ভারত সরকারের বৃহত্তর স্বার্থ বয়ান নয়, ফলে আমাদের জন্য সেভাবে দেখা হবে মারাত্মক ভুল।
তৃতীয় কারণ
তৃতীয়ত, নরেন্দ্র মোদি তার সরকার ও বিজেপি দলের মধ্যে ব্যবহারিক একটা সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ফারাক বজায় রাখতে চান। এ নিয়ে আগেই গত ২০১৪ নির্বাচনের প্রচারণা চলার সময় থেকে তিনি মিডিয়াতে ধারণা দিয়ে আসছেন। এখন বাস্তবেও এর প্রমাণ রাখছেন। যেমন কেন্দ্রীয় বিজেপির সভাপতি অমিত শাহকে কলকাতার আগামী ২০১৬ নির্বাচনে দলকে জিতিয়ে আনার প্রকাশ্য বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন মোদি। তিনি একক দায়িত্বে এখন কলকাতায় দলকে জেতানোর জন্য মমতার চরম বিরোধী হয়ে সর্ববিধ কৌশল ঠিক করবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি আবার সেই মমতার সাথেই সখ্যতার এক কার্যকর সম্পর্ক রেখে চলবেন বা চলতে চান। অর্থাৎ বিজেপি দলের প্রাদেশিক স্বার্থ আর কেন্দ্রীয় সরকারের স্বার্থ এ দুটোকে আলাদা রেখে একটা ব্যবহারিক ফারাক মোদি নিজের কর্মকাঠামোর মধ্যে বজায় রাখতে চান। এই হলো সরকার ও দলের ফারাক বিষয়ে মোদির ভাবনা।
পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ দায়িত্বের কাজে নেমে অমিত শাহ সারদা অর্থ কেলেঙ্কারি ও বর্ধমানের খাগড়াগোড়ে বোমা হামলা নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা র ও তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ (nia)-কে যতটা সম্ভব প্রভাব বিস্তার করে নিজের ষড়যন্ত্র প্রপাগান্ডায় শামিল করেছেন। কিন্তু এই কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও সাড়া দিয়ে ততদূরই এগিয়েছে যতদূর নিজ মূল কাজ কেন্দ্রীয় সরকারের বৃহত্তর স্বার্থে পরিচালিত হয় তা যেনো ক্ষুন্ন না হয়। অমিত শাহ এমনকি খাগড়াগোড়ে বোমা হামলা নিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দাদের বাংলাদেশ সফর করিয়েছেন। অমিত শাহ বিজেপির কেন্দ্রীয় সভাপতি হলেও তিনি মোদির সরকারের কেউ নন, সরাসরি কোনো পদে বা মন্ত্রিসভায় তিনি নেই। তাই নিজে সামনে না এসেও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান আর মোদির পররাষ্ট্র প্রশাসনের মাধ্যমে হাসিনা সরকার ও তার গোয়েন্দা বাহিনীর সাথে সম্পর্ক করিয়েছেন, সফর বিনিময় করিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদিকে না জড়িয়েই তিনি এটা করাতে পেরেছেন। কারণ ভারতের পররাষ্ট্র বিভাগ যেকোনো প্রাদেশিক ইস্যুতে পররাষ্ট্র বিষয়ে সার্ভিস সহায়তা দিতে পারে। যেহেতু মোদি এসব বিষয়ে নিজেকে জড়াবেন না, তাই ওই প্রতিষ্ঠানগুলোও মোদির বৃহত্তর স্বার্থ নীতির ওপর আঁচ-প্রভাব না ফেলে, না ফেলার সীমার মধ্যে থেকে যতদূর সম্ভব অমিত শাহকে সমর্থন দিতে পারে এভাবে কাজ করেছে। যেমন অমিত শাহ কলকাতার জনসভায় মমতাকে বাংলাদেশ থেকে জঙ্গি আমদানি করেছেন, আশ্রয় দিচ্ছেন, সারদা কেলেঙ্কারির অর্থ খাগড়াগোড়ে বোমা হামলায় মমতা ব্যবহার করেছেন এসব অভিযোগ এনে আক্রমণ করেছেন। সারদা অর্থ কেলেঙ্কারি কথার অর্থ, সারদা হলো বাংলাদেশের ডেসটিনির মতো এক কোম্পানির নাম; আর ডেসটিনির মতোই কলকাতায় প্রকাশ হয়ে পড়েছে সারদার অর্থ কেলেঙ্কারি। মমতাকে সারদা অর্থ কেলেঙ্কারির, ‘জঙ্গী’, ‘অনুপ্রবেশকারী’, ‘জামায়াত’, ‘বাংলাদেশী’ এসব শব্দে অভিযোগ তুলে পর্যুদস্ত করা অমিত শাহের পশ্চিমবঙ্গে জেতার নির্বাচনী কৌশল। কিন্তু অমিত শাহ বিজেপির কেন্দ্রীয় সভাপতি হলেও এগুলো ঠিক আবার মোদি সরকারের বাংলাদেশ নীতিকে প্রতিফলিত করে না।
মোদির কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের বৃহত্তর কেন্দ্রীয় স্বার্থের পক্ষে কাজেই মূলত নিমগ্ন থাকতে চায়। তাই মোদি সরকারের এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পার্লামেন্টে লিখিত বিবৃতিতে বলেছেন, সারদার অর্থ পাচার আর বোমা হামলা, আর বাংলাদেশ এগুলোর মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। কেন্দ্রীয় তদন্ত প্রতিষ্ঠান ঘওঅ তারও ফরমাল ফাইন্ডিং রিপোর্টে একই কথা বলেছে। এমনকি তারা রিপোর্টে বাংলাদেশ বা জেএমবির নাম আনেনি, তবে সন্দেহের পর্যায়ে খুঁজে নিশ্চিত হতে হবে ধরনের কিছু কথা সেখানে রেখেছে। অর্থাৎ অমিত শাহের কলকাতার পাবলিক বক্তৃতা যা অভিযোগ তুলেছেন সে কথার সাথে মোদির মন্ত্রী সামঞ্জস্য রাখেনি। এই অসামঞ্জস্য নিয়ে মিডিয়ায় কথাও উঠেছে। এখানে নেপথ্যে বলে রাখা যায়, আমাদের অর্থমন্ত্রী সপ্তাহ দুয়েক আগে কলকাতায় বিজনেস চেম্বারের এক সভায় গিয়ে এক কলকাতার সাংবাদিককে বলেছেন, ‘সারদার টাকা ঘুরপথে গিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা হয়েছে এবং সেখান থেকে সেই অর্থ বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন জেএমবিকেও দেয়া হয়েছে, এমন কোনো তথ্য মেলেনি’। আর এসব তর্ক থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থেকেছেন মোদি। দলের অবস্থানকে প্রাধান্য দিয়ে সে ভিত্তিতে সরকারের বক্তব্য সাজাতে যাননি। তবে এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, দল আর সরকারের মধ্যে ফারাক রাখার নীতি মোদির অনুসরণ করার কারণ ঠিক কোনো নৈতিক বা কনস্টিটিউশনাল বাধ্যকতার দিক ভেবে নয়। মূল কারণ হলো, মোদি সারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকতে চান তাই তিনি বুঝেন যেন অভিযোগ না আসে যে, তিনি কোনো একটি বা দু’টি প্রদেশ বা রাজ্যের দিকে কান্নি মারা প্রধানমন্ত্রী। তিনি গুজরাট বা পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থের দিকে কান্নি মারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই পরিচয় তিনি একেবারেই চান না। সে জন্য এই নীতিগত অবস্থান।
আবার পশ্চিমবঙ্গের ২০১৬ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সরকারের সাথে চার প্রাদেশিক দল বা শাখা দল তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেস তারা সবাই নিজ ভোটারের কাছে দেখাতে চায় তাদের সম্পর্ক খুবই ভালো এবং নিজ নিজ নির্বাচন কৌশলের পক্ষে বাংলাদেশ আছে। এমনটা দেখানোর একটা সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা সবার আছে। যদিও এই দল চারটির সবার ইস্যু একটাই পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ভোটার। তবে সেখানে তফাত হলো মমতার অবস্থান মুসলমান ভোটারদের পক্ষে আর বাকি তিন দলের বিপক্ষে। যেমন আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে মুখ্যমন্ত্রী মমতার আসন্ন বাংলাদেশ সফরে অনুমান করি, নিজের নির্বাচন কৌশলকেন্দ্রিক যে ধারণা আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে দেবেন তা হলো মমতা ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ’ বা জঙ্গি অনুপ্রবেশ ঘটছে এই বয়ান মানেন না, আমাদেরকে বোঝানো। কারণ মনে রাখতে হবে নির্বাচনী কৌশল হিসেবে কল্পিত ‘জঙ্গি অনুপ্রবেশ’-এর বিরুদ্ধে বলা বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেস কমবেশি তাদের সবার অবস্থান যা মমতার অবস্থানের বিরোধী। আর মমতা বাদে বাকি তিন দল প্রত্যেকের বয়ান কমবেশি সারদা অর্থ কেলেঙ্কারির, ‘জঙ্গি’, ‘অনুপ্রবেশকারী’, ‘জামায়াত’, ‘বাংলাদেশী’ এসব অভিযোগ দিয়ে সাজানো। অনেকে অবাক হতে পারেন কিন্তু ‘সেকুলারিজমের’ বড়াই করা কমিউনিস্ট সিপিএমের বয়ানও কমবেশি এটাই। সিপিএমের বাংলাদেশী কাউন্টার পার্ট হলো মেনন-ইনু, মূলত মেননের দল। সে জন্য তারাও হাসিনা সরকারকে নিজেদের রাজনৈতিক মিত্র বা কাছের সমভাবাপন্ন মনে করে।
অতএব তৃতীয় এ কারণে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের বক্তব্যকে নিশ্চিত মোদি সরকারের অবস্থান বলে সিদ্ধান্তে না গিয়ে আমি তাই অপেক্ষার কথা বলছি।
সারকথা, আগামী ২০১৬ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক দল বা শাখার বক্তব্যগুলো তাদের নির্বাচনী কৌশলের আলোকে দেখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ঝাঁপিয়ে পড়া যাবে না। তা বোমা হামলা, জঙ্গি ‘অনুপ্রবেশকারী’ অথবা হাসিনাকে সমর্থন এমন যে ইস্যু হোক। মোদি সরকারের অবস্থান সরাসরি মোদির মুখ থেকে বা কোনো মুখপাত্রের মুখ থেকে শুনলে তবেই তা নিশ্চিত বলে বুঝতে হবে।
অমিত শাহের খালেদাকে ফোন বিষয়ে
অমিত শাহের ফোন করা বা না করা যাই হোক তা থেকে একই কারণে এটা মোদি সরকারের অবস্থান হিসেবে নিশ্চিত ধরে নেয়া যাবে না। কারণ আগেই বলেছি অমিত শাহ মোদি সরকারের কেউ নন, কোনো মুখপাত্রও নন। কিন্তু মোদি সরকারের হাসিনার প্রতি মনোভাবে বাংলাদেশের চলমান খালেদা ‘অবরোধ’ পরিপ্রেক্ষিতে কি নেতিবাচক হয়ে গেছে? হ্যাঁ হয়েছে। কংগ্রেসের মতো করে হাসিনার পক্ষে তো নয়ই বরং ডায়লগ ও নতুন নির্বাচনের পক্ষে মোদির ভারত সরকার ঘুরতে যাচ্ছে এই প্রাথমিক ইঙ্গিতকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে। ফলে তা তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছি। অমিত শাহর কথিত ফোনের প্রেক্ষিত থেকে তা নয় বরং বিশেষ কিছু মিডিয়া রিপোর্ট থেকে। যেমন এ মাসে ৭ জানুয়ারি টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বিএনপির নজরুল ইসলাম খানের সাক্ষাৎকার বিষয়ে একই দিনে দু-দুটো রিপোর্ট টাইমস অব ইন্ডিয়া ছাপিয়েছে। এ ছাড়া পরের দিন টাইমস অব ইন্ডিয়ায় সম্পাদকীয় বিভাগের রুদ্রনীলের ব্লগে লেখা মূল্যায়ন, রুদ্রনীল ঘোষের নিজের নামে বাংলায় প্রায় একই সারকথা মানবজমিন ৯ জানুয়ারি ২০১৫ পত্রিকার লেখা ‘রাজনৈতিক অস্পৃশ্যতা ঘুচাতে এখনই সংলাপ দরকার’। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৯ জানুয়ারি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় একই মূল্যায়নের একেবারে সম্পাদকীয় লিখে নিজেরই আগের অবস্থান উলটে দেয়া।
ভারতে যেসব মিডিয়া বিজেপিকে বেশি কাভারেজ দেয় এর মধ্যে জি-নিউজ টিভি, টাইমস অব ইন্ডিয়া এবং আনন্দবাজার অন্যতম। বিশেষত গত নির্বাচনের পর অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে অ্যাসাইনমেন্টে আসার পর থেকে আনন্দবাজার অমিত শাহকে দেয়া সার্ভিস সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। অমিত শাহ যখন গত অক্টোবর থেকে সারদা আর বোমা হামলা নিয়ে নির্বাচনী প্রপাগান্ডায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন তখন থেকে তার প্রধান মিডিয়া হাতিয়ার আনন্দবাজার। নিরলস সার্ভিস দিচ্ছে পত্রিকাটি। এই সার্ভিসে আনন্দবাজার এমন জায়গায় গেছে যে সোর্স ছাড়া খবর, গোয়েন্দা সূত্রের নামে চালানো বাপ-মাহীন রিপোর্ট, একেবারে মমতা ও বাংলাদেশের অনুপ্রবেশী মুসলমান বা জামায়াতের বিরুদ্ধে অমিত শাহের প্রপাগান্ডার কার্বন কপিও ছাপা হয়েছে। এই চক্রের ফ্যারে পড়ে সেসব প্রপাগান্ডা আবার বাংলাদেশের প্রথম আলোও জড়িয়ে গিয়েছিল। সেও আনন্দবাজারের সূত্রে খবর ছাপিয়ে বাংলাদেশেও প্রপাগান্ডা আমদানি করেছিল। প্রপাগান্ডা টার্গেট ছিল, মমতার রাজ্যসভার সদস্য ইমরান-সারদা-বর্ধমানের বোমা হামলা জামায়াত এসব কিছুকে এই সূত্রে গেঁথে গল্প লেখা। এক সন্ধ্যায় আওয়ামী ঘরানার তিন টিভি আবার প্রথম আলোর ওই মিথ্যা রিপোর্টের বরাত দিয়ে খবর প্রচার করেছিল। মাত্রাছাড়া টের পেয়ে অথবা কোনো কারণে প্রথম আলো সে অবস্থান থেকে সরে এসেছিল দু’দিন পরে। আর ড্যামেজ কন্ট্রোল ও ব্যালেন্স করতে সেবার শুধু ইমরানের পালটা ডিফেন্স বক্তব্য নিয়ে রিপোর্ট ছাপে। ওপরে বলেছি এসব প্রপাগান্ডা মোদি সরকারের মন্ত্রী এবং ঘওঅ অনুসন্ধান রিপোর্ট সবাই নাকচ করে দিয়েছে। কিন্তু নাকচ হলেও আনন্দবাজার ভুল স্বীকার করেনি, ক্ষমা চায়নি। এখন আমরা দেখছি সেই আনন্দবাজার খোদ নিজ সম্পাদকীয়তে উল্টো অবস্থান ব্যক্ত করেছে। খালেদাকে আটকে রাখার উদ্বেগ, গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেগ ইত্যাদি জানিয়ে উল্টো হাসিনাকে অভিযুক্ত করে বলছে এগুলো হাসিনার ‘কেমন ধরনের গণতন্ত্র?’, এগুলো হাসিনার ‘প্রতিহিংসার ক্রিয়া’, ‘অর্থনৈতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়িবার আশঙ্কা প্রবল’, ‘মৌলবাদীরা তাহার সুযোগ লইতে পারে’ ইত্যাদি। আনন্দবাজারই এখন বিএনপি-জামায়াত জোটের পক্ষে সাফাই দিয়ে বলছে, ‘বিএনপি ও তাহার জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর যৌথ আন্দোলন সহজেই হিংসাত্মক হয়, তাহা সত্য। কিন্তু অতিরিক্ত দমননীতি জনসাধারণের এক বৃহৎ অংশের ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাহিরে আসার পথটিই রুদ্ধ করিতে পারে, স্বাভাবিক নিষ্ক্রমণের পথ না পাইয়া এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ অন্তর্ঘাতেই বিস্ফোরণের পথ খুঁজিবে’। হাসিনাকে দোষী করে তাকে নমনীয় হতে বলছে আর খালেদার আন্দোলন ন্যায্য বলে সাফাই দিয়েছে। আনন্দবাজারের এই অবস্থান পরিবর্তন বিজেপির অমিত শাহের অবস্থান পরিবর্তন বলে মনে করার ইঙ্গিত বলে মনে করার কারণ আছে। তবুও এখনই এটাকে মোদি সরকারের অবস্থান বলে নিশ্চিত বুঝতে দেরি করতে বলব। যদিও অবশ্যই এটা প্রাথমিক ইঙ্গিত বলে মনে করা যেতে পারে।
মোদির সাথে অমিত শাহর সম্পর্ক
মোদির সাথে অমিত শাহর সম্পর্ক কী, কেমন তা জানা থাকলে নজরুল ইসলাম খানের সাক্ষাৎকার থেকে আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় পর্যন্ত ঘটনাবলির আঁকা গ্রাফ থেকে বের হওয়া ইঙ্গিতগুলোর সম্ভবত কিছু তাৎপর্য উদ্ধার করা যেতেও পারে। বলা হয়ে থাকে, রাজনীতিতে রাজনীতিক নেতাকে অনেক ডার্টি কাজ করার বা ময়লা ঘাটার প্রয়োজন অনুভব করতে হয়। এগুলোর আবার খাস প্রমাণ না থাকলেও কানাঘুষায় বা আধাপ্রমাণে তা অপ্রকাশিত থাকে না। ফলে এতটুকুই ডার্টি কাজ মূল নেতা করলে আবার তার ইমেজের বিরাট কালো দাগ লেগে ক্ষতি হওয়ার জন্য যথেষ্ট। সেটা এড়াতে মূল নেতা তা খুব কাছের বিশ্বস্ত একজনকে দিয়ে করিয়ে থাকেন। মোদির তেমনই বিশ্বস্ত লোক হলেন অমিত শাহ। মোদির প্রথমবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অমিত শাহের উত্থান। আর সর্বশেষ ২০১৪ সালের কেন্দ্রীয় লোকসভার নির্বাচনে উত্তর প্রদেশ জয় করে আনার জন্য গুজরাট থেকে অমিত শাহকে অ্যাসাইমেন্ট দিয়ে পাঠান মোদি। নির্বাচনের মোট ৫৪০ আসনের মধ্যে ওই উত্তর প্রদেশ হলো একা সবচেয়ে বড় ভাগের আসন সংখ্যার (৮০) রাজ্য। সে জন্য এই অ্যাসাইনমেন্ট। পাঠানোর আগে অমিত শাহকে তখন কেন্দ্রীয় বিজেপির সেক্রেটারিও করে দেয়া হয়। নির্বাচনের ফলাফলে চমক দেখিয়ে তিনি ৮০ আসনের ৭২টিই একা বিজেপির পক্ষে আনেন। তবে সে জন্য তার দুর্ধর্ষ নামের সাথে আরো কালি লেগেছিল। এই নির্বাচনের কয়েক মাস আগে উত্তর প্রদেশের মুজাফফরনগরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অভিযোগে আদালতের মামলাগুলোতে তিনি আসামি। তার অ্যাসাইমেন্টের সফলতার কৌশল বড় অদ্ভুত, সময়ে অবিশ্বাস্য।
দাঙ্গার অভিযোগ তার নামে আসে কিন্তু তিনিই আবার কোনো সংখ্যালঘু অথবা সময়ে জাত-ধারণায় কোনো উঁচুজাত অথবা নিচুজাতের কাউকে ওই স্থান থেকে বিজেপির হয়ে নির্বাচন করিয়ে এবং জিতিয়েও আনতে পারেন। এসব ডার্টি কাজে গুজরাট থেকে উত্তর প্রদেশ পরিক্রমায় তার নামে যতগুলো মামলা আছে এর সব পেন্ডিং আর তিনি জামিনপ্রাপ্ত। গুজরাটের পর থেকে এ পর্যন্ত তিনি আর কখনো কোনো বিজেপি সরকারে সরকারি পদ নেননি, আড়ালে ক্ষমতাধর থেকেছেন। চলতি মোদি সরকারেরও তিনি কেউ নন। তিনিই হলেন এখন কেন্দ্রীয় বিজেপির সভাপতি এবং পশ্চিমবঙ্গের ২০১৬ নির্বাচনে দলকে জেতানোর অ্যাসাইনমেন্টে মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটে অমিত শাহের মোদির হয়ে আগমনী বার্তা দেয়ার ভূমিকা নিয়ে থাকতে পারেন। অর্থাৎ মোদি এখনই সরকারকে জড়াতে চান না, হয়তো কিছু প্রস্তুতি বাকির কারণে। এমনটা হতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে এ কাজ তার পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী অ্যাসাইমেন্টের সাথে সম্পর্কিত কিছু নয়। অসম্ভব নয় যে, এটা মোদির আলাদা অ্যাসাইনমেন্ট। অর্থাৎ অমিত শাহ আর মোদির অবস্থানের এখানে এক হতে পারে। এখানে তিনি মোদির আগমনী বার্তার বাহক। ফলে এটা দল-সরকারের ফারাকের দিক থেকে বুঝতে চাওয়া ভুল হবে। বরং মোদির আগমনী বার্তা মানে মোদি যে রাজনৈতিক অবস্থান নিতে যাচ্ছেন তা আগাম জানাচ্ছেন অমিত শাহ এভাবে অনুমান করতে সমস্যা নেই। আপাতত এই পর্যায়ে এটা অনুমান হিসাবেই থাক। তবে বেশি দিন নয়, এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে সম্ভবত এটা আরো স্পষ্ট পরিষ্কার হয়ে সবার কাছে ধরা দেবে। -অন্য দিগন্ত
মন্তব্য চালু নেই