জনভোগান্তির নেপথ্যে সরকারি দলের নেতারা

বাস-মিনিবাসের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষায় থাকতে হবে না, ভাড়া কমে যাবে—এমন আশ্বাস দিয়ে মালিক সমিতি সিটিং সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দিলেও সেই মালিকেরাই এখন তা মানছেন না। গত চার দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বাস-মিনিবাসে যাত্রীদের চলমান দুর্ভোগ থেকে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।

সাধারণ যাত্রী ও যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন ব্যক্তিদের অভিযোগ, এই জনভোগান্তির নেপথ্যে রয়েছেন মালিক-শ্রমিক সমিতির সঙ্গে যুক্ত সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা ও সমর্থকেরা।

ঢাকাসহ সারা দেশের মালিক সমিতির নেতৃত্বে রয়েছেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান ও ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের নেতা খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। আর দেশের পরিবহনশ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। এই মন্ত্রীর পারিবারিক মালিকানায় ঢাকায় কনক পরিবহন নামে বাস চলে।

৪ এপ্রিল মালিক সমিতি সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৫ এপ্রিল থেকে যা কার্যকর হয়। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মাঠে নামেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালত। তবে এ বিষয়ে বিআরটিএর কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না বলে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। সূত্র বলছে, ১৫ এপ্রিল বিকেলে এক বৈঠক করে বিআরটিএ জানিয়ে দেয়, মালিক সমিতির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তারা ঢাকায় পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে। অভিযান শুরুর পর অনেক মালিক বাস-মিনিবাস চালানো বন্ধ করে দেন। পাশাপাশি তাঁরা ঠাসাঠাসি করে যাত্রী নিয়ে সিটিং সার্ভিসের ভাড়াও আদায় করছেন।

চার দিন পর গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের কাছে বাস-মিনিবাসে মানুষের ভোগান্তির বিষয়টি উল্লেখ করে নিজের অসহায়ত্বের কথাই জানান। তিনি বলেন, ‘কেউ নানা অজুহাতে যদি গাড়ি না চালায়, আমরা কি আমাদের দেশের বাস্তবতায় জোর করে গাড়ি নামাতে পারব? আর গাড়ির সঙ্গে যারা জড়িত, তারা খুব সামান্য মানুষ না, তারা অনেকেই খুব প্রভাবশালী।’ মন্ত্রী স্বীকার করেন, ব্যস্ত সময়ে যে পরিমাণ বাস-মিনিবাস চলে, সে তুলনায় কম চলছে। জনগণের দুর্ভোগ ও কষ্ট হচ্ছে।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, আজ বিকেলে মালিক-শ্রমিকনেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক হবে। এরপর বিভিন্ন বাস-মিনিবাস কোম্পানির মালিকদের নিয়ে বৈঠক করা হবে।

মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো অতীতেও নানা দাবি আদায়ে ধর্মঘট ডেকে জনগণকে জিম্মি করেছে। চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ, সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের প্রাণহানির ঘটনায় গত ফেব্রুয়ারিতে বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। এর প্রতিবাদে নৌপরিবহনমন্ত্রীর বাসায় বসে মালিক-শ্রমিকনেতারা ধর্মঘটের ডাক দিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশ অচল করে দেন।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা এবং যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকজনের সন্দেহ, মালিকদের সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত মূলত বাস-মিনিবাসের ভাড়া বাড়িয়ে নেওয়ার কৌশল।কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে গত চার দিন যত্রতত্র (লোকাল) বাস থামিয়ে গাদাগাদি করে যাত্রী তুলে সিটিং সার্ভিসেরই ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। কিছুদিন পর হইচই থেমে গেলে ভাড়া বাড়িয়ে কিছু পরিবহন কোম্পানি পুনরায় সিটিং সার্ভিসে চলা শুরু করবে। কারণ সিটিং সার্ভিসেরও চাহিদা আছে। অতীতে ভাড়া বৃদ্ধির জন্য লোকাল বাস-মিনিবাসকে সিটিংয়ে পরিণত করা হয়েছে। এবার সিটিংকে লোকাল করে সব বাসেরই ভাড়া বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। বিআরটিএ মালিকদেরই ফাঁদে পা দিয়েছে। এবারও সিটিং সার্ভিস ইস্যুতে জনভোগান্তির পেছনে সরকারি দলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার ভূমিকার বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে।

সিটিং সার্ভিস মোটরযান আইনে নেই। আইন প্রণয়নের দায়িত্ব সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএর। আর আইন প্রয়োগের দায়িত্ব পুলিশ ও বিআরটিএর। কিন্তু অতীতে সেই আইন প্রয়োগ হয়নি।

বিআরটিএ, যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও সাধারণ মালিকদের তথ্যমতে, দু-তিন দিন ধরে ঢাকায় চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের ৪০ শতাংশ বন্ধ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে আজিমপুর থেকে গাজীপুর পথে চলাচলকারী ভিআইপি পরিবহনের অধিকাংশ বাস-মিনিবাসই বন্ধ। সিটিং সার্ভিস নাম দিয়ে চলা এই বাসে উঠলেই যাত্রীকে ৫০ টাকা গুনতে হয়।

যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন ব্যক্তিদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকায় সিটিং সার্ভিস নাম দিয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। মেশকাত, সুপ্রভাত, গাজীপুর পরিবহন, লাব্বাইক পরিবহন একাধিকবার লোকাল থেকে সিটিং এবং সিটিং থেকে লোকালে পরিবর্তন করা হয়েছে। কেরানীগঞ্জ থেকে মিরপুর চিড়িয়াখানা পর্যন্ত চলে দিশারি পরিবহন। এই কোম্পানির বাসে কেরানীগঞ্জ থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত যত্রতত্র যাত্রী তোলা হয়। গুলিস্তান থেকে আবার সিটিং হয়ে যায়। এভাবে একেক সময় একেক ব্যবস্থায় চলে ঢাকার পরিবহন।

ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘যাত্রীদের সুবিধার কথা ভেবেই আমরা সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কদিন সময় দিলে ঠিক হয়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, গণমাধ্যমে সিটিং সার্ভিসের বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণেই তাঁরা তা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন। এখানে সন্দেহ করার কোনো বিষয় নেই। সবার সহযোগিতা পেলে শৃঙ্খলায় চলে আসবে।

অবশ্য পরিবহনমালিকেরা যখন যা খুশি তা করেন বলে দাবি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরীর। তিনি বলেন, এবার ভাড়া কমানোর কথা বলে সিটিং সার্ভিস বন্ধ করা হয়েছে, কিন্তু ভাড়া কমেনি। উল্টো যাত্রীদের মারধর ও বাস থেকে জোর করে নামিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সরকার ও গণমাধ্যম কয়েক দিন হইচই করে থেমে যাবে। একপর্যায়ে যাত্রীরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। মনে হচ্ছে, এটাই মালিকদের উদ্দেশ্য।খবর  প্রথম আলো’র।



মন্তব্য চালু নেই