বাড়ছে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার, ঝরছে প্রাণ

দেশে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার বাড়ছে। জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে শীর্ষ ব্যবসায়ী এবং নানা পেশা ও শ্রেণির মানুষ বৈধভাবে পাওয়া এসব অস্ত্র ব্যবহার করছে প্রতিপক্ষ ঘায়েল ও আধিপত্য বিস্তারে। এমনকি অবৈধভাবে ভাড়াও দেওয়া হচ্ছে এসব বৈধ অস্ত্র।

প্রকাশ্যে এসব অস্ত্র উঁচিয়ে একদিকে যেমন ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে; তেমনি ব্যবহার হচ্ছে চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক সংঘর্ষ, এমনকি সরকারি উচ্ছেদ অভিযান ঠেকাতে পর্যন্ত। এসব অস্ত্র দিয়ে ঘটছে মৃত্যুর ঘটনাও। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সবগুলো নির্বাচনেই এসব অস্ত্রের অবৈধ প্রদর্শন দেখা গেছে আশঙ্কাজনক হারে।

শুধু যে অস্ত্র প্রদর্শন বা ফাঁকা গুলি, তা-ই নয়; এসব অস্ত্র থেকে করা গুলিতে দিন দিন বাড়ছে নিহতের সংখ্যাও। মারা যাচ্ছেন নিজের রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। এমনকি নিস্তার পাচ্ছেন না নিরীহ পথচারী, গৃহবধূ, সাধারণ মানুষও। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো প্রায়ই যে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে, নিজেদের মধ্যে খুন-খারাবির ঘটনা ঘটছে, তাতে ওই দলের জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের বৈধ অস্ত্রই ব্যবহার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।

সর্বশেষ সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে ক্ষমতাসীন দলের পৌর মেয়র হালিমুল হক মিরু তার শটগান থেকে গুলি ছুড়লে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সাংবাদিক আবদুল হাকিম শিমুল। শোক সইতে না পেরে মারা যান শিমুলের নানিও। দলের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় সেখানে সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন ওই সাংবাদিক।

এ সময় গুলিতে ওই দলের আরো দুই কর্মীও আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছেন মেয়র মিরু। ক্ষমতাসীন দলের একজন জনপ্রতিনিধির গুলিতে সাংবাদিক নিহতের ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় চলছে। স্থানীয়দের পাশাপাশি বিক্ষুব্ধ সাংবাদিক মহল। নিন্দার ঝড় বইছে।

এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও আলোচনায় এসেছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের বিষয়টি। ঘটনার দিনই পুলিশ মিরুর শটগান ও গুলির খোসা জব্দ করে। কিন্তু এখনো লাপাত্তা মিরু ও তার কাছে থাকা বৈধ আরো ৩৪ রাউন্ড গুলি। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নিহতের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দলীয় ও প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অথচ গত চার দিনে শাহজাদপুর ছাড়াও পাবনা, নড়াইল ও শেরপুর জেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করা হলেও দলীয় বা প্রশাসনিকভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া গত বছরের শেষদিন খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জেড এ মাহমুদকে লক্ষ্য করে গুলি করে তার নিজ দলের প্রতিপক্ষ। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে নিহত হন পথচারী এক নারী। সে ঘটনায় ওই অস্ত্রের ব্যাপারে কোনো অনুসন্ধান চালানো হয়নি।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, কোনো বৈধ অস্ত্রধারীর বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করা হলে তা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত হয়ে থাকে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলসহ ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রতিমন্ত্রী এ ধরনের ঘটনায় কতগুলো অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল ও এসব অস্ত্র মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, সে-সংক্রান্ত কোনো তথ্য দিতে পারেননি।

তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, খসড়া হিসাব মতে দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা প্রায় সোয়া ২ লাখ। এর মধ্যে ২০ হাজার অস্ত্রের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। গত আট বছরে ১০ হাজারের কিছু বেশি অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। পরে সাড়ে তিন হাজার লাইসেন্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে এর মধ্যে মাত্র ১৫৬টি লাইসেন্স বাতিল করা হয়। তদন্ত হচ্ছে আরো ১৬২টির বিরুদ্ধে।

শুধু শাহজাদপুরের ঘটনাই নয়, এর আগেও বিভিন্ন সময় বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার হয়েছে। গত ২০১৫ সালের ২ অক্টোবর ভোরে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দহবন্দ ইউনিয়নের গোপালচরণ এলাকায় চাচার সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়ে সম্প্রতি খুন হওয়া সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটনের ছোড়া গুলিতে আহত হয় দরিদ্র শিশু সৌরভ।

২০১৪ সালের ২৫ মে রাজধানীর শান্তিবাগের একটি ফ্ল্যাটে বৈধ অস্ত্রের গুলিতে খুন হন মতিঝিল থানা জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মিলন। ২০১২ সালের এপ্রিলে নড়াইলের কালিয়ায় স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা তার বৈধ অস্ত্র নিয়ে হামলা করেছিলেন স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে।

একই বছর দিনাজপুরে স্থানীয় এক ইউপি চেয়ারম্যান তার লাইসেন্সকৃত বন্দুক নিয়ে অতিথি পাখি শিকার করতে গেলে স্থানীয় প্রশাসন তাকে আটক করে। সে বছরের ১৮ মে ময়মনসিংহে নবগঠিত পাগলা থানার স্থান নির্ধারণ নিয়ে বিরোধের জের ধরে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াস উদ্দিন আহমেদ প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখান। এ সময় তিনি দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়েন।

২০১০ সালের ১৪ আগস্ট রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভোলার সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের লাইসেন্সকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে খুন হন যুবলীগ নেতা ইব্রাহিম। ২০০৯ সালের ৯ জুন কামরাঙ্গীরচর থানার সুলতানগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মনিরের লাইসেন্সকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে মো. হাসান (১৭) নামের কাঠের দোকানের এক কর্মচারী খুন হন।

২০০২ সালে ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের শিক্ষক স্বপন কুমার গোস্বামী খুন হন এক সরকারি কর্মকর্তার লাইসেন্সকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে। এর কিছুদিন পর রাজধানীর জিগাতলা এলাকায় চলচ্চিত্র পরিচালক ড্যানি সিডাকের লাইসেন্সকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে নিহত হন তার মেয়ে।

বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার ও এমন বিশৃঙ্খলায় উদ্বিগ্ন দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দিয়েই দায় সারছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার অস্ত্রটি নিয়মনীতি মেনে ব্যবহার করছেন কি না বা এগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হচ্ছে কি না, তা নিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে না।

এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ বলেন, দেখতে হবে এসব অস্ত্র কাদের হাতে। ধনবান ক্ষমতাধরদের হাতে। দুর্বলের হাতে নেই। অস্ত্রের মালিক যিনি, অস্ত্র পাওয়ার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব আছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাদের লোকজনকেই অস্ত্র দেওয়া হয়। কিন্তু পরে আর ওই সব অস্ত্রের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হয় না।

তিনি আরো বলেন, কারা অস্ত্র পাচ্ছে, কিভাবে পাচ্ছে, কিংবা অস্ত্রের মালিক কারা, সে বিষয়ে ঠিকমত তদন্ত করলে এমন অবৈধ ব্যবহার হতো না। তা ছাড়া যারা বৈধ অস্ত্রের এমন অবৈধ ব্যবহার করছেন, তাদের বিরুদ্ধে যদি দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেত, আইনানুযায়ী শাস্তি দেওয়া যেত, তাহলে এমন ঘটনা ঘটত না। কিন্তু তা হচ্ছে না।

একইভাবে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, যাদের অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হলো, তাদের আদৌ অস্ত্র পাওয়ার যোগতা আছে কিনা, সেটা দেখা হয় না। আর এসব অস্ত্রের অপব্যবহার হলেও তাদের আইনের আওতায় আনা হয় না। ফলে অপব্যবহার কমছে না। অস্ত্র পাওয়াটা বেশ কঠিন। কিন্তু এসব অস্ত্রের বেশির ভাগই দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিক প্রভাবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, দিন যত যাবে, ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে অভ্যন্তরীন কোন্দল ও ক্ষমতার রাজনীতি তত বাড়বে। সুতরাং সামনের দিনগুলোতে সরকার সতর্ক না হলে হানাহানি সংঘর্ষ আরো বাড়বে। বিশেষ করে জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে যে সব অস্ত্র রয়েছে, সেগুলোর ব্যবহারের ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নেওয়া উচিত। অবৈধ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি দলীয়ভাবেও শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই নিয়ন্ত্রন সম্ভব।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র আরো জানায়, গত আট বছরে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে প্রায় চার হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে মন্ত্রণালয়ে। একই সময়ে অবৈধ কাজে ব্যবহারের জন্য সারা দেশে প্রায় ৫০০ বৈধ অস্ত্রধারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ৩১৮টির লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫৬টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে ১৮৭৮ সালের আর্মস অ্যাক্ট ও ১৯২৪ সালের আর্মস রুলসের আওতায় সামরিক, বেসামরিক, অন্য ব্যক্তিদের কিছু শর্তসাপেক্ষে শর্ট ও লং ব্যারেলের অনিষিদ্ধ বোরের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়।

সরকারের উপসচিব ও সশস্ত্র বাহিনীর মেজর ও এর ওপরের কর্মকর্তা ও সমমর্যাদার কর্মকর্তাদের বাইরে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী-শিল্পপতি যারা বছরে অন্তত তিন লাখ টাকা কর দেন এবং পরপর তিন বছর একইভাবে কর দিয়েছেন তারা আবেদন ও লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন আরো অন্যান্য শর্তপূরণ সাপেক্ষে। এই অস্ত্র তাদের ব্যক্তিগত ও সম্পদের নিরাপত্তার জন্য দেওয়া হয়।

এর মধ্যে পিস্তল, রিভলবার ও শটগানের লাইসেন্স দেওয়া হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। বন্দুকের লাইসেন্স দেয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। এক ব্যক্তির নামে সর্বোচ্চ দুটি লাইসেন্স থাকার বিধান রয়েছে। লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র, পেশা, বার্ষিক আয়, করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর দাখিল করতে হয়।

আবেদনকারীর নাম-ঠিকানা, পেশাসহ জীবনবৃত্তান্ত যাচাই-বাছাই ছাড়াও অতীত অপরাধের রেকর্ড যাচাই করে পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এসব বিষয়ে ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। দুষ্কৃতকারী, সন্ত্রাসী বা ফৌজদারি আইনে সাজাপ্রাপ্ত কোনো অপরাধীকে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার নিয়ম নেই।

কিন্তু বেশির ভাগ অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মকানুন মানা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লাইসেন্স বিভাগের কর্মকর্তারা। তারা জানান, লাইসেন্স পাওয়ার একটি শর্তের মধ্যে বছরে ৩ লাখ টাকা আয়কর রিটার্ন দাখিলের যে বিধিটি রয়েছে তা মানা হচ্ছে না। এসব অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। লাইসেন্স নেওয়ার সময় যে ঠিকানা দেওয়া হচ্ছে, ওই ঠিকানারও হদিস মিলছে না। ফলে এসব বৈধ অস্ত্র দেশের আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের এক কর্মকর্তা।



মন্তব্য চালু নেই