অনেকটাই কেটেছে আতঙ্ক আর উদ্বেগ, ফিরছে স্বস্তি
রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিসান বেকারিতে নৃশংস জঙ্গি হামলার পর উদ্বেগে ছিল দেশের মানুষ। আতঙ্কে ছিলেন বিদেশিরাও। ভয়াবহ ওই হামলার দু’মাস পর সে আতঙ্ক আর উদ্বেগ অনেকটাই কেটেছে। ধীরে ধীরে ফিরে আসছে স্বস্তি। বিদেশিরা এখন গুলশান এলাকায় নির্বিঘ্নেই চলাফেরা করছেন, যাচ্ছেন হোটেল-রেস্তোরাঁয়ও। ওয়ালমার্টসহ আন্তর্জাতিক বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোও নিয়মিত দেশে আসছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা মনে করছেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে এত বড় হামলার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারায় সবকিছু অনুকূলে এসেছে। এরই মধ্যে হামলার মূল হোতা তামিম চৌধুরী পুলিশের অভিযানে নিহত হয়েছে। হামলার অর্থ ও অস্ত্রদাতাসহ নেপথ্য হোতাদেরও চিহ্নিত করা গেছে। গত ১ জুলাই রাতে গুলশানের স্প্যানিশ রেস্তোরাঁ হলি আর্টিসান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। সেখানে অবস্থানরত অতিথিদের জিম্মি করে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করে। জিম্মিদের উদ্ধারে গিয়ে ওই রাতেই ঘটনাস্থলে পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিহত হন। পরের দিন ভোরে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ড’ নামে কমান্ডো অভিযানে পাঁচ জঙ্গি ও এক সহযোগী নিহত হয়।খবর সমকালের।
ঘটনার রাতেই নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞের দায় মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) স্বীকার করেছে বলে জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী মার্কিন সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্সের ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়। তবে বাংলাদেশে জঙ্গি দমনে নিযুক্ত পুলিশের বিশেষ সংস্থা কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট শুরু থেকেই বলছে, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির একটি অংশ ওই হামলায় জড়িত। ওই অংশটি নব্য জেএমবি নামে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। তদন্তেও তাই বেরিয়ে আসে। ওই হামলার ঘটনায় দায়ের মামলায় পুলিশ এখন পর্যন্ত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমকে সরাসরি গ্রেফতার দেখিয়েছে। তবে জড়িত প্রায় সবাইকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। মামলায় এ পর্যন্ত ৪২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রত্যক্ষদর্শী ১২ জন আদালতে ঘটনার বিবরণ দিয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন। ৩০ জন পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
গত রোববার কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, হলি আর্টিসান বেকারিতে হামলার ঘটনায় দায়ের মামলায় বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। এরই মধ্যে হামলার পরিকল্পনাকারী নব্য জেএমবির অন্যতম সমন্বয়ক তামিম চৌধুরী পুলিশের অভিযানে নিহত হয়েছে। হামলার অস্ত্রদাতা, প্রশিক্ষক ও অর্থদাতাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
গুলশান হামলার পর জঙ্গি দমনে বড় সফলতা : আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গি দমনে নিয়মিত কার্যক্রম চালালেও মূলত গুলশান হামলা মামলা তদন্ত করতে গিয়েই এ ক্ষেত্রে বড় সফলতা আসে। গুলশানের পর দেশে অন্তত বড় তিনটি হামলা ঠেকানোও সম্ভব হয়। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা জানান, তামিম চৌধুরী সম্পর্কে গত বছর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জানতে পারলেও মূলত গত ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পর তার বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়। সে যে গুলশান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ও সমন্বয়ক তাও বেরিয়ে আসে। হামলার অপারেশন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করে তামিমেরই ঘনিষ্ঠ অনুসারী নুরুল ইসলাম মারজান। পাশাপাশি তদন্তে বেরিয়ে আসে জাহাঙ্গীর, রিপন, ইকবাল, খালিদ, মানিকের মতো দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের নাম। ওই জঙ্গিদের গ্রেফতারে টানা অভিযানের মধ্যেই গত শনিবার সকালে নারায়ণগঞ্জে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে তামিম চৌধুরী তার দুই সহযোগীসহ নিহত হয়।
ফিরেছে স্বস্তি : কূটনৈতিকপাড়ায় হামলার পর বিদেশিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেক দেশ তাদের নাগরিকদের চলাফেরায়ও সতর্কতা জারি করে। বিদেশি তৈরি পোশাক ক্রেতারাও (বায়ার) ঢাকায় আসতে শঙ্কাবোধ করছিলেন। তবে দু’মাসের মধ্যে জঙ্গি দমনে বড় সফলতায় সে আতঙ্ক আর উদ্বেগ অনেকটাই কেটে গেছে। পুলিশের ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি জোনের উপকমিশনার জসিম উদ্দিন গতকাল বুধবার বলেন, এখন আর বিদেশিদের মধ্যে আতঙ্ক নেই। তারা গুলশানের রাস্তায় নির্বিঘ্নে চলাফেরা করছেন। বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় খেতে যাচ্ছেন, আড্ডা দিচ্ছেন। বিদেশি বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠাগুলোও নিয়মিত গুলশানে বিভিন্ন বায়িং হাউসে আসছে। তিনি বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে নিয়মিত দূতাবাসগুলোতে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। কূটনীতিকদের অফিস এবং বাসায় গিয়ে তাদের সমস্যার কথা জানা হচ্ছে। সে অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থাও নিচ্ছে পুলিশ।
দু’মাস পর সেই হলি আর্টিসান : ভয়াবহ ওই হামলার দুই মাস পর এখনও ৭৯ নম্বর সড়কের মাথায় অবস্থিত হলি আর্টিসান বেকারির দিকে উঁকি দিয়ে তাকান দেশি-বিদেশি পথচারীরা। পুলিশ এখনও হলি আর্টিসানের আশপাশে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রেখেছে। হামলার পর হলি আর্টিসানে গিয়েছেন পুলিশের এমন দুই কর্মকর্তা বলেন, হামলার পর যে অবস্থা ছিল রেস্তোরাঁটি এখনও সে অবস্থায়ই রয়েছে। মেঝেতে-দেয়ালে রক্তের দাগ শুকিয়ে রয়েছে। দেয়ালে গুলির চিহ্ন রয়েছে। চেয়ার-টেবিলগুলোও এলোমেলো। মামলার তদন্তের প্রয়োজনেই রেস্তোরাঁটি খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এখনই নেওয়া যাচ্ছে না বলে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
পাঁচ জঙ্গির মরদেহ এখনও মর্গে : কমান্ডো অভিযানে নিহত হওয়ার পর পাঁচ জঙ্গি নিবরাস ইসলাম, রোহান ইমতিয়াজ, মীর সামিহ মোবাশ্বের, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম পায়েলের মরদেহ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ময়নাতদন্ত করা হয়। ওই অভিযানে নিহত হলি আর্টিসানের সহকারী বাবুর্চি সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের মরদেহও সেখানে ময়নাতদন্ত হয়। এর পর থেকে তাদের মরদেহ সিএমএইচের মর্গে রাখা হয়েছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ওই ছয়জনের মরদেহ থেকে সংগ্রহ করা ডিএনএ নমুনা তাদের স্বজনদের সঙ্গে মিলিয়ে পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এখন স্বজনরা চাইলেই মরদেহ নিতে পারে। তবে গতকাল পর্যন্ত কেউ মরদেহ নিতে আবেদন করেনি।
মন্তব্য চালু নেই