রাণীনগরে বন্ধ হয়ে গেছে শতাধিক চাতাল রাইস মিল
কাজী আনিছুর রহমান, রাণীনগর (নওগাঁ) সংবাদদাতা: ধানের আমদানি কম, প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে এলসি’র মাধ্যমে চাল আমদানি, সরকারি ভাবে খোলা বাজারে চাল বিক্রয় ও স্থাণীয় উৎপাদিত চালের বিক্রয় মূল্য কম থাকা, গত বছর জৈষ্ঠ্য মৌসুমে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থাকায় মিল মালিকরা মানসম্পন্ন ধান সংগ্রহ করতে না পারা, অটো রাইস মিলের দাপট সহ নানা সংকটে চালের দাম দফায় দফায় কমে যাওয়ায় উত্তর জনপদের খাদ্য ভান্ডার হিসেবে খ্যাত নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার ড্রাম বয়লারের রাইস মিল গুলো দিন দিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই রাণীনগর উপজেলার ১শ’ ৩৪ টি চাল কলের মধ্যে প্রায় ১শ’ ২৬ টির মত বন্ধ হয়ে গেছে। এই চাতালগুলোতে এক সময় শ্রমিকদের কর্মচাঞ্চল লক্ষ করা গেলেও নানা সংকটের কারণে এখন অধিকাংশ চাতাল বন্ধ হওয়ায় শত শত শ্রমিক হারিয়েছে তাদের কর্মসংস্থান।
রাণীনগর উপজেলো খাদ্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে রাণীনগর সদর, কুজাইল বাজার, আতাইকুলা, হরিশপুর, বেতগাড়ী, ত্রিমোহনী, কুবড়াতলী, কৃষ্ণপুরও আবাদপুকুর এলাকায় চাতাল তৈরি শুরু হয়। বর্তমানে এই উপজেলায় ১৩৪ টিরও বেশি সরকারি লাইসেন্স ভূক্ত চাউল কল আছে। এই চাতালগুলোতে যে পরিমান চাল উৎপাদন হতো তা দিয়ে জেলার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হতো। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা যেমন তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে লাভবান হতো তেমনি এই চাতালগুলোতে সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় দেড় হাজার দরিদ্র নারী-পুরুষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান। এলাকার চাষীদের উৎপাদিত ধানের নায্যমূল্যও নিশ্চিত হতো। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত চাল ব্যবসায়ী ও মালিক-শ্রমিকদের অনেকেই দারিদ্রতা জয় করে পুঁজিপতি বনে গেছেন। কিন্তু এখন সেই সুদিন দূর্দিনে পরিণত হতে চলেছে। চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে ১৯হাজার ১শ’১০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছে যা চাল আকারে ৭৩ হাজার ২শ’ ৯৮ মেট্রিক টন।
গত বছর ইরি মৌসুমে সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে মাত্র ৬ হাজার ২শ’ মেট্রিক চাল ক্রয় করা হয়। ধান কাটার মৌসুমের শুরুতেই অটো রাইস মিল মালিকরা কম দামে তাদের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান কিনে গুদামজাত করে সারা বছর চাল তৈরি করে। ফলে বছরে তারা বাজারের চাহিদা মত চাল বিক্রি করে ব্যাপক মুনাফা অর্জন করছে। ক্ষুদ্র চাতাল ব্যবসায়ীদের উৎপাদিত চাল ভাল মূল্যে বিক্রয় করতে না পাড়ায় গুদামে মজুত থাকার কারণে আসন্ন মৌসুমে রাইস মিল মালিকরা পুঁজির অভাবে ধান কাটার শুরুতে পর্যাপ্ত ধান কিনে মিল চালু করা নিয়ে শংকায় রয়েছে। যে কারণে অটো রাইস মিলের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় টিকে থাকা দুরহ হয়ে পড়েছে। ফলে চাতাল ব্যবসায় মন্দার কারণে বেকার হয়ে পড়েছেন শত শত নারী-পুরুষ শ্রমিক। এসব চাতাল ও মিল রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ঋন সহায়তার দাবি জানান চাতাল মালিকরা।
মেসার্স সাখাওয়াত হোসেন চাউল কলের সত্ত্বাধিকারি বিশিষ্ট চাতাল ব্যবসায়ী মোঃ মোফাজ্জল হোসেন হেলাল জানান, এবারে আমার বেশকিছু অবিক্রিত রয়েছে। বাজার দর কমে যাওয়ার ফলে অনেক লস হবে। ড্রাম বয়লারের চাল এই মূহুর্তে বাজারে কেনা-বেচা নেই বললেই চলে। এই অবস্থায় বাজার থাকলে আসন্ন ইরি-বোরো মৌসুমে যথা সময়ে মিল চালু করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। বে-সরকারি ব্যাংকগুলো আমাদের মত ছোট ব্যবসায়ীদের ঋন দিতে খুব বেশি মনোযুগী না। অপর দিকে অটো রাইস মিল মালিকদেরকে অধিক পরিমান ঋন দেওয়ার কারণে মৌসুমের শুরুতেই প্রচুর পরিমান ধান তারা সংগ্রহ করে সারা বছর মিল চালায়। কিন্তু আমরা চাতাল ব্যবসায়ীরা এই পরিমান ধান সংগ্রহ করতে না পারায় বাজার ওঠানামার কবলে পড়ে লোকসান গুনতে হয়। ফলে এক পর্যায় ধান অভাবে চাতাল বন্ধ হয়ে যায়।
রাণীনগর চাউল কল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শ্রী শীতানাথ ঘোষ জানান, বর্তমান ধানের বাজার মূল্যের সাথে চালের দাম কম থাকায় প্রতিমন চালের মূল্যে প্রায় একশ’ টাকা লোকসান গুনতে হয়। গত দুই মাস আগেও জিরা জাতের চাল ১৩শ’ ৫০ টাকা দরে, স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৯শ’ ১০ টাকা প্রতি মন বিক্রয় হলেও বর্তমানে মান ভেদে জিরা জাতের চাল ১২শ’ ২৫ থেকে ৫০ টাকা এবং স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৮শ’ ২০ টাকা দরে বাজারে বিক্রয় হওয়ায় মিলারদের বড় ধরণের লসের ঘ্যানী টানতে হবে।
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোঃ মোহাজের হোসেন জানান, রাণীনগর উপজেলায় ৮টি ইউনিয়নে চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে কি পরিমাণ ধান চাল কেনা হবে এমন লক্ষ্যমাত্রা এখন পর্যন্ত সরকারি ভাবে পাইনি। তবে আশা করছি আগামী মাসে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার নির্দেশনা পাব।
মন্তব্য চালু নেই