ভুল স্বীকার করে মাহ্ফুজ আনাম কি ভুল করলেন?
কোনো সমাজে যদি ভুল স্বীকারের রেওয়াজ না থাকে, তবে তাকে কি সুস্থ ও পরিণত সমাজ বলা যাবে? ভুলকে অন্যায় বা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা কি সমাজমানসের সুস্থতার লক্ষণ? দর্শন ও মনস্তত্ত্ব বলে ভুল স্বীকারের ক্ষমতা ব্যক্তির সৎসাহসের প্রমাণ দেয়। কোনো সমাজে ভুল স্বীকার করে কেউ যদি অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়, তাহলে সেই সমাজ সততা ও সত্য থেকে দূরে সরে যায়। প্রকারান্তরে সেখানে কপটতা ও মিথ্যারই জয়জয়কার চলতে থাকে।
ভুল স্বীকার অন্যায় নয়, অপরাধ তো নয়ই; ভুল স্বীকার মানুষের একটি প্রশংসনীয় গুণ বলেই বিবেচিত হয়। বিবেচ্য বিষয় হলো, কেউ একই ভুল বারবার করছে কি না, ভুলটি ইচ্ছাকৃত ছিল কি না। কিন্তু সেই বিচার বাদ দিয়ে বিষয়টিকে নিয়ে ব্যক্তিগত মানহানি বা রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা ঠুকে দেওয়ার মধ্যে বরং ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে হয়রানি করা বা শাস্তি দেওয়ার মনোভাবের প্রকাশ ঘটে। তবু এ ক্ষেত্রে একই ভুল বারবার হয়েছে কি না বা ভুল ইচ্ছাকৃত ছিল কি না, সে আলোচনা আমরা করব। তার আগে ভুল ও ভুল স্বীকার নিয়ে আরও কয়েকটি কথা বলা দরকার।
আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে থাকেন, তোমার মা-বাবার প্রতি কোন কারণে তুমি সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ, আমি সব সময় নির্দ্বিধায় বলেছি, ভুল করার অধিকারসহ স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য। বলা হয়ে থাকে, ভুলত্রুটির মধ্য দিয়েই মানুষ শেখে। একজন সম্পাদক কখনোই ভুল করেন না, করবেন না বা ভুল করতে পারেন না—এমন ভাবনা অন্যায্য। মানবসমাজে এ ধরনের যুক্তি অচল। এই অপূর্ণতা নিয়েই মানুষ। ধর্মগ্রন্থে বারবার ভুল ও ভুল স্বীকার, ক্ষমা ও দয়ার প্রসঙ্গ এসেছে।
আমাদের সমাজ যে দিনে দিনে নির্দয় হয়ে উঠেছে, তার প্রমাণ প্রায় প্রতিদিন শিশু নির্যাতন আর ভয়ংকর মাত্রায় শিশু হত্যার ঘটনা থেকে পাওয়া যায়। যে শিশু, সে তো অন্যায়-অপরাধের আওতার বাইরে, বরং তার জীবন ভুলভ্রান্তিরই আওতায় থাকে। তা থাকে বলেই সে শেখে, বাড়ে, বড় হয়। কিন্তু এই সমাজ যে ভুল ও অন্যায়ের মধ্যে গুলিয়ে বসে আছে, তাই এটি শিশুর প্রতিও নির্দয়। এরই সূত্র ধরে চলে আসে অসহিষ্ণুতা, ক্ষমতার দাপট, ধৈর্যহীনতাসহ নানান মানবিক অক্ষমতা। যে সমাজ ভুলকে ধারণ করতে পারে না, সেই সমাজ অমানবিক হয়ে ওঠে। হয়ে পড়ে অবক্ষয়গ্রস্ত। তার মূল্যবোধের ভারসাম্য নষ্ট হয়। আমরা প্রতিনিয়ত লক্ষ করছি, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানছি সমাজে কতভাবে দুর্নীতি অর্থাৎ অন্যায় হচ্ছে, কত অবিচার, বঞ্চনা ও নিষ্ঠুরতার কাহিনি জমছে। এসবের প্রতিকার আমরা করি না। সৎ ও ন্যায়বান মানুষ বারবার নিষ্ঠুর অন্যায়ের শিকার হয় এখানে। তাই রবীন্দ্রনাথকে দেখি এই বাস্তবতায় তিক্ত হয়ে শেষে ঈশ্বরের কাছে নালিশ জানাতে: ‘প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’ আমরা অন্যায়কে কবির ভাষায়, তৃণসম দহন করতে পারি না, কিন্তু ভুল ঘটলে—তাও ভুল স্বীকারের পরে বুঝে—ব্যক্তির ওপর হামলে পড়ছি। এ হলো অক্ষমের বীরত্ব!
মানুষের উত্তরণ ও বিকাশ কীভাবে ঘটে? নিজের ভুলগুলো বুঝতে পারলে তবে। এভাবেই শিখতে শিখতে মানুষ অভিজ্ঞ হয়। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লে আমরা দেখব কীভাবে পাকিস্তান আন্দোলনের একজন মাঠের কর্মী, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো মার্কিনপন্থী গণতন্ত্রীর শিষ্য ক্রমে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মহানায়কের ভূমিকায় পৌঁছে যান। ভুলগুলো শুধরে শুধরে তিনি এগিয়েছেন। ভুল স্বীকার না করলে শোধরাতেন কী করে? অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমার যদি কোনো ভুল হয় বা অন্যায় করে ফেলি, তা স্বীকার করতে আমার কোনো দিন কষ্ট হয় নাই, ভুল হলে তা সংশোধন করে নেব, ভুল তো মানুষেরই হয়ে থাকে।’ (পৃ: ৮০)
বঙ্গবন্ধু বাঙালি চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ ছিলেন। আত্মজীবনীতে এ বিষয়ে লিখতে গিয়ে তাঁর ভাষায় তিক্ত অভিজ্ঞতার রেশ স্পষ্ট ধরা পড়ে। সেটি হলো বাঙালির পরশ্রীকাতরতা। তিনি লিখেছেন, ‘বোধ হয় দুনিয়ার কোনো ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, “পরশ্রীকাতরতা”।…এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে।’ (পৃ: ৪৮) বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ কেবল বৈষয়িক ও স্থাপনাগত উন্নয়নে বাস্তবায়িত হবে না, তা আসবে প্রধানত উন্নত মানুষ সৃষ্টির মাধ্যমে। কিন্তু তারা যদি আজও ভুল ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে না শেখে, তাহলে বঙ্গবন্ধু-কন্যার সকল প্রয়াস সত্ত্বেও এ উন্নয়নের ভিত থেকে যাবে দুর্বল।
আচ্ছা, এ ভুল কি ডেইলি স্টার সম্পাদক একাই করেছিলেন? না, বরং একজন সম্পাদক ব্যতীত বাকি সব সম্পাদকই করেছিলেন। তাহলে একজনকে কেন শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা? এর নৈতিক ভিত্তি কী? মনে হবে না এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? আচ্ছা, মাহ্ফুজ আনাম কি ইচ্ছাকৃতভাবে এ ভুল করেছেন? যদি তা-ই হতো, তবে তাঁর মতো বিখ্যাত বিতার্কিক বাকপটু মানুষের পক্ষে সেদিন তরুণ সাংবাদিক মুন্নী সাহাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া কোনো কঠিন কাজ ছিল না। কিন্তু সেটি হতো কপটাচার। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল করে (অর্থাৎ অন্যায় করে) কেবল তারাই কপটতার আশ্রয় নিয়ে আত্মরক্ষা করে থাকে। এ সমাজ কি বলতে চাইছে সততার অহংকার গুঁড়িয়ে দেব, সবার মতো কপট হওয়াই বাঞ্ছনীয়? আচ্ছা, এই প্রবীণ সাংবাদিক ও সম্পাদক কি এই একই ধরনের ভুল বারবার করেছেন? যদি আমরা আলোচ্য ২০০৮-০৯-এর সময়ের এবং সামগ্রিকভাবে ডেইলি স্টার-এর মোদ্দা ভূমিকা বিচার করি, তাহলে দেখব আদর্শের দিক থেকে এই পত্রিকা অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র, বাক্স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতাসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, নাগরিক অধিকার, নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন, শিশু অধিকার ও সুরক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ ইত্যাদির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। মনে করুন ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সংখ্যালঘু নির্যাতনের সময় ডেইলি স্টার-এর মূল কাগজ ও শুক্রবারের সাময়িকীর সচিত্র প্রতিবেদনগুলোর কথা। মনে করুন আমেরিকার ইরাক আক্রমণের পরে লাল ব্যানার শিরোনামগুলোর কথা, এক–এগারোর পরে শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হলে মাহ্ফুজ আনামের স্বনামে লেখা কলামের কথা। মনে করুন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে এই পত্রিকার ভূমিকা। মনে করুন এই পত্রিকার শিশু, নারী, সংখ্যালঘু, বনবনানী, নদী-খাল-বিল, মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধের অনুকূল অসংখ্য খবর ফিচারের কথা। গণমাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশকে বিদেশিদের কাছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, ভালোভাবে পরিচয় করাচ্ছে ডেইলি স্টার, সেটি প্রধানত ইতিবাচক ভাবমূর্তিই তো।
তা ছাড়া মাহ্ফুজ আনাম বিশ্বাস করেছিলেন সরকারের একটি অংশ সামরিক বাহিনীর একটি অঙ্গের ওপর। দেশের সামরিক বাহিনীর ওপর আস্থা রাখা কি দেশদ্রোহ? আমরা জানি, বিশেষ পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনীর কেউ কেউ ক্ষমতার পক্ষে বা জন্য নানা ভূমিকা নেয়, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার, সুশাসনের মানদণ্ডে মানা যায় না। এর বিরুদ্ধে কথা বলা, সংগ্রাম করার ঐতিহ্য আমাদের আছে। আর তাই মাহ্ফুজ আনাম সেই দিন ডিজিএফআইকে বিশ্বাস করে খবর ছাপানোকে তাঁর সম্পাদক-জীবনের একটি ব্যর্থতা ও ভুল বলে স্বীকার করেছেন। একে দেশদ্রোহ আখ্যায়িত করলে ডিজিএফআইসহ অনেককেই টানতে হবে।
এখানে এ কথা টেনে আনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে বহু নিন্দিত ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীনের দুই বছরেই প্রথম আওয়ামী লীগের বাইরের কোনো সরকার পঁচাত্তরের পরে বঙ্গবন্ধুকে ভালোভাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছিল। তাঁর জন্মদিন পালন করেছে, মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর কবরে গেছেন সরকারপ্রধান। এই সরকার পূর্ববর্তী বিএনপি সরকারের নেতিকরণ এমনভাবে করেছিল যে তাতে ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বাড়তি সুবিধা পেয়েছিল। এই সরকার তারেক রহমানের দুর্নীতি প্রকাশ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে, অন্তত বহুকালের জন্য তাঁকে মাইনাস করার পটভূমি তৈরি করে দিয়েছে। এ কথাও মানতে হবে, ফখরুদ্দীন আহমদের নির্দলীয় সরকার দুই বড় দলের তীব্র সংঘাতময় ক্ষমতা-দ্বন্দ্বের পরে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। হ্যাঁ, তা বলে এই সরকারের ভুল কি ছিল না? ছিল। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বাড়াবাড়ি হয়েছে, মাইনাস টু তত্ত্ব ভুল ছিল। তবে তারা চেয়েছিল রাজনীতিতে অচলায়তন ভাঙতে, সংঘাতের বাস্তবতা দূর করতে। লক্ষ্য ঠিকই ছিল, পথ হয়তো ঠিক ছিল না।
আমার পর্যবেক্ষণে বুঝতে পারি, শেখ হাসিনা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বঙ্গবন্ধুর মতোই চিন্তায় সৃজনশীলতাকে স্থান দেন, উত্তরণ ও এগিয়ে যাওয়ার জন্য ভুল থেকে শিখে পথ নির্ধারণ করতে জানেন। আশা করি, এই অসুস্থ অপরিণত ব্যক্তি-নিধনের হুজুগ বন্ধ করতে তাঁর কাছ থেকে সময়োচিত পরামর্শ আসবে।
ব্যক্তিগতভাবে বলব, কোনো কোনো সময় বা ক্ষেত্রে ডেইলি স্টার এমন অনেক নীতি বা অবস্থান নিয়েছে, যার সঙ্গে আমি একমত হইনি। কিছু বিষয়ে আমার দ্বিমত বা ভিন্নমত রয়েছে। কিন্তু মাহ্ফুজ আনাম যে একজন সৎ, বিজ্ঞ সাংবাদিক, সফল সম্পাদক, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সম্প্রতি ভুল স্বীকার করে তাঁর এই সততার গৌরব আরও বৃদ্ধি করেছেন তিনি।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
মন্তব্য চালু নেই