বিচার বিভাগ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে : বিচারপতি মাহমুদুল

প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বলেছেন, বিচার বিভাগ এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

তিনি বলেন, বিচার বিভাগ ধ্বংস হয়ে যাক তা আমরা চাই না। বিচার বিভাগ সম্পর্কে ভাল কিছু শুনলে মনটা ভরে যায়। আর খারাপ কিছু শুনলে মনে হয় আগেই মরে যাওয়া ভাল ছিল।
মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্ট ভবনের শহীদ শফিউর রহমান মিলনায়তনে ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বিরাজমান পরিস্থিতি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

বিচারপতি মাহমুদুল আমিন বলেন, বিচারব্যবস্থা পৃথিবীর সব দেশেই আছে। তবে বর্তমানে স্বেচ্ছাচারী (অটোক্রেটিক) না গণতান্ত্রিক (ডেমোক্রেটিক) সরকারব্যবস্থায় আছি, তা আপনারা চিন্তা করবেন। গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষতায় থাকলে জনগণের জন্য আইন করে। আর স্বেচ্ছাচারী সরকার থাকলে তার কথামতো চলতে হয়; তার সুবিধামতো আইন হয়।

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক প্রসঙ্গে প্রাক্তন এই প্রধান বিচারপতি বলেন, তিনি এখন প্রেস কনফারেন্স করেন। এ বিষয়ে সংসদেও আলোচনা হয়। অথচ এই সংসদেই একজন নেতা তাকে বলেছিলেন স্যাডিস্ট (হতাশাগ্রস্ত)। তাহলে একজন স্যাডিস্টকে আপিল বিভাগে নেওয়া হলে কীভাবে? এখন তো প্রমাণ হলো আসলেই তিনি স্যাডিস্ট। তিনি সুপ্রিম কোর্টের সর্বনাশ করছেন।

তিনি আরও বলেন, এখন তো শুনি একেক জনের কাছে এক-দেড়শ মামলা রয়েছে রায় লেখার অপেক্ষায়। এটা দুঃখজনক। এই বিপুলসংখ্যক রায় লেখার অপেক্ষায় থাকার কারণে বিচার বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্টের সর্বনাশ হয়েছে।

বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বলেন, এ রায় লেখা পড়ে থাকার জন্য দোষ আইনজীবীদের। আইনজীবীদের ঐক্যবদ্ধভাবে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। বিচার বিভাগকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু আইনজীবীরা তা করছেন না।

আইনজীবীদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, আপনারা রাজনীতি করবেন, কিন্তু তা আদালতের বাইরে। আদালত অঙ্গনে আপনাদের পরিচয় আপনারা আইনজীবী। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আপনারা কাজ করবেন। জুডিশিয়ারি বাঁচাতে হলে আপনাদের ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে হবে।

মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হওয়া নাগরিকত্ব আইন বিষয়ে তিনি বলেন, শুনেছি এটি সংসদে পাশের অপেক্ষায় রয়েছে। এ বিষয়ে পত্রিকায় যে সংবাদ দেখেছি, তা খুবই বিপদজনক। যেকোনো নাগরিককের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে পারবে সরকার।

রাজাকারদের নাগরিকত্ব বিষয়ে তিনি বলেন, ওই আইনে আছে, একজন রাজাকার যদি থাকে তার সম্পদ তার ছেলে মেয়েরা পাবে না। রাজাকারা তো চলে গেছে ৪০-৪২ বছর আগে। আমরা যেভাবে চলছি তা তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার মনে হচ্ছে।

তিনি বলেন, বাবার শাস্তি ছেলে ভোগ করবে? ফৌজদারি আইনে একজনের শাস্তি আরেকজন ভোগ করতে পারে না। গণতান্ত্রিক সরকারের এসব থাকার কথা নয়; জনগণের জন্য আইন হওয়ার কথা। আমরা কোথায় যাচ্ছি?

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের রায় লেখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের সময় নিয়ম ছিল হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকেরা এজলাসে বসে রায় ঘোষণা করবেন; আইনজীবীরা বসে শুনবেন; কোন কিছু বাদ গেলে তা বলবেন। আর আপিল বিভাগ শুধু আদেশ অংশ ঘোষণা করতেন। পূর্ণাঙ্গ রায় আসবে পরে। তাই আমি মনে করি না যে অবসরের পর রায় লেখা বেআইনি হবে। তবে অবসরের পর রায় লিখতে হলে কোনভাবেই আদেশ অংশ পরিবর্তন করা যাবে না। আদেশ অংশ পরিবর্তন করতে হলে রিভিউ করতে হবে। এটা না করে ছয় মাস বা এক বছর বা দেড় বছর পর যদি কেউ রাতের অন্ধকারে রায়ের আদেশের অংশ পরিবর্তন করে তবে সেটি হবে ফৌজদারী অপরাধ। আমরা তো সেটা করলাম, সেটি ঠিক হয়নি। এ কারণেই প্রধান বিচারপতি বলছেন এটা বেআইনি।
অবসর পর রায় লেখা নিয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, এখন তো শুনি হাইকোর্টে কেউ কেউ প্রকাশ্য এজলাসে রায় দেন না; সংক্ষিপ্ত আদেশ দেন। আগে এটা ছিল না। এখন মাসের পর মাস পূর্ণাঙ্গ রায় দেওয়া হয় না। বিচারপ্রার্থীদর ভোগান্তি হয়; জজ সাহেব সম্বন্ধে নানা আলাপ-আলোচনা হয়। তিনি রায় লিখতে পারেন না বলেই প্রকাশ্যে রায় বা আদেশ দেন না। এখন নাকি রুল দেওয়া নিয়ে সিনিয়র জুনিয়র বিতর্ক হয়, সিনিয়র এজলাস থেকে নেমে যান, এটি দুঃখজনক; লজ্জজনক।

এ জন্য দায়ী আইনজীবীরা। কারণ আইনজীবীদের দায়িত্ব কাউকে খালাস করে দেওয়া বা কাউকে শাস্তি দেওয়া নয়। তাদের দায়িত্ব ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আদালতকে সহায়তা করা।

এ অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন ড. কামাল হোসেন, হাইকোর্ট বিভাগের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী, ড. শাহদীন মালিক, সুব্রত চৌধুরী, এসএম খসরুজ্জামান, জাহিদুল বারী প্রমুখ।



মন্তব্য চালু নেই