রাজনদের ভাগ্য শুধু মিডিয়ার শিরোনাম!
১৩ বছরের শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন চিরতরে চলে গেলো না ফেরার দেশে। সে চলে গেলো এক বুক কষ্ট নিয়ে। তার সে চলে যাওয়াটা ছিলো বড্ড অভিমানের। সে চলে যাওয়ার শেষ বেলায় নিয়ে গেলো চোর উপাধী। আর আমাদেরকে বলে গেলো মিথ্যুক, প্রতারক, অবিবেচক। রাজন এর হত্যার ভিডিওটি দেখে কোনো হৃদয়বান মানুষ স্বাভাবিক থাকতে পারবে কিনা আমার সন্দেহ হয়। সহসা দু’চোখ অশ্রুশিক্ত হওয়ার কথা। একজন শিশুকে মারতে মারতে মেরে ফেলা;উল্লাসের জন্য ভিডিও ধারণ করা কতটা অমানবিক সে বিচারের দায়ভার পাঠকের উপর দিলাম।রাজনের এর মৃত্যুর পর কেউ ভিসিডি নির্মাণ করে ব্যবসা করছে । কেউ প্লাকার্ড হাতে সমবেদনা জানিয়ে মিডিয়ায় আলোচিত ও পরিচিত হচ্ছেন। শোকবার্তা জানিয়ে কেউ কেউ মানবতাবাদীদের কাঁতারে শামিল হতে চাচ্ছেন। এতোসব ফলোআপ রাজনদের হতভাগ্য জীবনের জন্য কী কোনো সুখবর বয়ে আনবে? রাজনদের ভাগ্যশুধু মিডিয়ার শিরোনাম ! রাজন এর মৃত্যুর পর সাংবাদিকরা নির্ঘুম,বড় বড় হরফে প্রিন্ট মিডিয়ায় শিরোনাম।ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় শিরিজ নিউজ। মন্ত্রীসভার প্রেসব্রিফিং। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের বিবৃতি। মনে হলো আজই রাজনের পরিবার রাজন হত্যার বিচার পেয়ে যাবে। কিন্তু ফিরে দেখা ইতিহাসের বাঁকে চোখ রাখলেই একথা অস্বীকার করার সুযোগ কোথায়?তদন্তের ফ্রেমে বন্দি যে আজ সুবিচার। আমরা কী দেখি মানবতার ফেরিওয়ালাদের একটু আওয়াজ, দেনদরবার। আবার অদৃশ্য কোনো শক্তির কাছে রাতের গভীরে সিজদায় নতজানু।অবশেষে যেই শীত সেই ঠান্ডা।শুধু মজলুম মানুষের প্রতি জুলুমবাজদের ধারাবাহিক ক্ষমতা প্রদর্শন।আর মাজলুমানের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর ।মাঝখানে কেবল সময়ক্ষেপন, প্রতারনা। আজ হয়তো রাজনকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত, কাল হয়তো নতুন কোনো খবরের সন্ধান পেলে বাসি হয়ে যাবে রাজনদের সব শিরোনাম। পাঠক নতুনের খোঁজে উন্মুখ থাকে, মিডিয়ার মালিকেরা অর্থ উপার্জনে যতোসব ফন্দি খোঁজে।সব মিলে ব্যবসা ভালোই জমে। ইতিপূর্বে নারায়নগঞ্জের সাত খুনের আসামী নুর হোসেনকে দেশে এনে বিচার করার আশ্বাস থাকলেও সে প্রতিশ্রুতি আজো আলোর মুখ দেখেনি।আমিন বাজারে ডাকাত সন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছয় ছাত্রকে পুলিশি হত্যা।এসব মামলা গুলো আজ হিমাগারে। আদৌ কী নিহতের পরিবার সুবিচার পাবে?রাজন এর মৃত্যুর পর সমবেদনা জানাতে রাজনের পরিবারের সাথে দেখা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন শিশু রাজন হত্যার ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি ও উৎকোচ গ্রহণের বিষয়ে তদন্ত চলছে। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরই দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাজন হত্যায় জড়িতদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। দায়ীদের বিরুদ্ধে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সৌদিতে আটক কামরুল ইসলামকেও দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। (ফেসবুকে দিতেই নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করা হয়, দৈনিক প্রথম আলো,১৪ জুলাই ২০১৫) সামিউল ইসলাম রাজনকে কামরুল ও তার সহযোগীরা প্রায় আধা ঘন্টা ধরে তার উপর পাশবিকতা চালায়। যে ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে সেটা প্রায় ২৮ মিনিট ৫২ সেকেন্ডর।অবাক ও বিস্ময়ের বিষয় দীর্ঘ সময়ে শিশুটিকে ফ্রাঙ্কলিন স্টাইলে হত্যা করে ফেললো ।অথচ প্রশাসনের সামান্য সহানুভূতি ও দায়িত্বানুভূতিতে বেঁচে যেতে পারতো শিশু রাজন। কিন্তু গরিবদের জন্য আর কে লড়ে? কেউ বাঁচাতে আসলো না। শিশু রাজন হত্যার পর সেই তোড়জোড় দেখছি। কিন্তু এটা কী আসলে নতুন কোনো ঘটনা! খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে নতুন কোনো ইস্যুতে মুছে যাবে রাজনের নাম। অনেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বিভিন্ন নামে, বেনামে,শিরোনামে আন্দোলন করছে কিংবা করবে।বিচারের জন্য হুংকার ছাড়বে কিছু দিন পর এই মানুষ গুলোর ও পাত্তা পাওয়া যাবে না। রাজনের মৃত্যুর প্রতিবাদে সারা দেশে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ নিন্দা ও ক্ষোভে ফুঁসে উঠে। বিশেষ করে গণজাগরণ মঞ্চ, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, যুবমৈত্রী, ব্লাস্ট, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, যুব ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মানবাধিকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গুলো রাজন হত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের বিচার দাবি করে। উল্লেখ্য গত ১৩ জুলাই গণজাগরণ মঞ্চ‘ রাজনের জঘন্য হত্যাকা-ে জেগে উঠুক বাংলাদেশের বিবেক’এমন স্লোগান নিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করে।অনুষ্ঠানে শিশু অধিকার কর্মী শামসুন্নাহার নীলা বলেন এভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে শিশু হত্যা আমরা কোনোভাবেই চাই না। অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে ,এ বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের কাজ করার দায়িত্ব। গণজাগরণ মঞ্চ এর একাংশের মুখপাত্র ডা: ইমরান এইচ সরকার রাজন হত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে হত্যার সাথে জড়িতদের দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।অন্যদিকে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন ২০০৩ সালের অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় খুনের ঘটনার বিচার হয়নি। আইন করে খুনিদের রক্ষার ঘটনাও আছে।শঙ্কা হচ্ছে আমরা বোধ হয় আমাদের মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলছি। যখন পদের ও ক্ষমতার জন্য আইনের তোয়াক্কা করি না, তখন সাধারণ মানুষ কেনো আইনের তোয়াক্কা করবে? মানুষ প্রতিবাদ পর্যন্ত করছে না, বাধা দিচ্ছে না। অভিজিৎ হত্যা, পয়লা বৈশাখে নারী লাঞ্চনার ঘটনা আমাদের সামনে ঘটেছে। অথচ কেউ বাধা দেয়নি। আমরা বোধ হয় পৈশাচিকতা থেকে বের হতে পারবো না। সুশসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এই সম্মেলনে বলেন নাগরিকের সোচ্চার না হলে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হবে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এর জন্য দায়ী। আসলে এসব প্রতিবাদসভা, বিবৃতি কী আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কানে যায়? রাজনের পিতা মাতার কান্নার শব্দ কী আমাদের নেতা নেত্রীদের কর্ণকুহুর ও হৃদয়ে ধাক্কা দেয়? আজো নুর হোসেন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা গা ফুঁলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নারায়নগঞ্জের সাতখুনের মামলা এখন কুলকিনারাহীন। এভাবেই কী রাজন হত্যার বিচার গুম হয়ে যাবে? বিচারহীনতার সংস্কৃতির জয় হবে? “এখনো আশ্বাসেই আটকে আছে দ্রুত বিচার” (দৈনিক প্রথম আলো, ৩ আগস্ট২০১৫) অতীতের বিচারহীনতার রেকর্ড মুছে ফেলে রাজনের হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদেরকে শাস্তিই হোক ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতির দৃষ্ঠান্ত ।
লেখক:
ইয়াসিন মাহমুদ
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মন্তব্য চালু নেই