৫ সূর্যসন্তানের শাহাদাৎ বার্ষিকী আজ

আজ ২৩ অক্টোবর যশোরের মনিরামপুরের ৫ সূর্যসন্তানের ৪৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী। ১৯৭১ সালের এই দিনে এদেশের স্বাধীনতাকামী পাঁচ সূর্যসন্তান আসাদ, তোজো, শান্তি, মানিক ও ফজলু পাকহানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনে শহীদ হন। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এ শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

জানা যায়, যশোর জেলা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে কেশবপুর সড়কের চিনাটোলা বাজারের পূর্বপাশে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধচলাকালে ২৩ অক্টোবর সকালে নির্মম হত্যার শিকার হন যশোরের এ ৫ সূর্য সন্তান।

সরেজমিনে হরিহর নদীর পাড়ে ৫ সূর্যসন্তানের কবরস্থানে গিয়ে দেখা যায়, অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে শহীদদের সেই বধ্যভূমি।

স্থানীয় ব্যাংক কর্মকর্তা জাহিদ ইকবাল জাদু জানান, কয়েক বছর আগে শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য বামদলের পক্ষ থেকে বধ্যভূমিতে একটি অসম্পূর্ণ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। যার আংশিক কাজ শেষ হলেও, বৃহৎ অংশ এখনো বাকি।

এ ব্যাপারে মনিরামপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন জানান, কমান্ডের পক্ষ থেকে উল্লেখিত ৫ শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে আমরা সরকারকে অবহিত করেছি।

এদিন শহীদ হওয়া ৫ জনের মধ্যে মাশফিকুর রহমান তেজো ১৯৬১ সালে গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি এবং ১৯৬২ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি লন্ডন থেকে একচুয়ারি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ১৯৬৯ এ লন্ডন থেকে দেশে ফিরে কৃষকদের মধ্যে কাজ করা শুরু করেন তিনি। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন।

শহীদ আসাদুজ্জামান আসাদ ছিলেন যশোর এমএম কলেজের ভিপি। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের নেতা। ১৯৬৯র গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের সর্বদলীয় ছাত্র সংগঠনের আহ্বায়কও ছিলেন আসাদ।

সিরাজুল ইসলাম শান্তি ছিলেন জেলা কৃষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। আর আহসান উদ্দিন খান মানিক ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের জেলা শাখার সভাপতি। এরা সবাই প্রগতিশীল আন্দোলনের রূপকার ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) সঙ্গে এদের নিবিড় সম্পর্ক ছিল।

একাত্তরের যুদ্ধের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের জন্য বসে না থেকে যশোর এবং খুলনা জেলা কমিটি হানাদারদের সঙ্গে লড়বার সিদ্ধান্ত নেন এবং দেশকে শক্রমুক্ত করার জন্যে মাগুরার শালিখা থানার পুলুম ও খুলনার ডুমুরিয়া এলাকায় ঘাঁটি গড়ে তোলেন। এ সময় দলের যশোর জেলা সম্পাদক ছিলেন শামসুর রহমান। পার্টির অন্য কর্মীদের সমন্বয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্যে একটি নিয়মিত বাহিনী আর একটি গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলা হয়।

যুদ্ধের শুরুতেই এই কর্মীরা থানা ও ফাঁড়ি লুট করে অস্ত্র সংগ্রহের পর হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যশোর-খুলনার বেশ কিছু এলাকা শত্রুমুক্ত করেন। তোজো, আসাদ, শান্তি, মানিক ও ফজলু এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তখন তাদের একটিই স্বপ্ন ছিল দখলদার বাহিনীকে হটানো।

এদিকে, ইস্টার্ন ফেডারেল ইন্সুরেন্স কোম্পানির স্পেশাল অফিসার তোজো অফিসের গাড়ি নিয়ে যশোর হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ভারতে চলে যান। তোজো ভারতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করার জন্য আলোচনা করেন। কলকাতায় কংগ্রেস, সিপিএম নেতাদের সাথেও তিনি এই ইস্যুতে কথা বলেন। শেষ পর্যায়ে তোজো নিজের গাড়িটি তৎকালীন অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদকে দিয়ে আসেন প্রধানমন্ত্রীর কাজের সুবিধার জন্য। এরপর তোজো দেশে ফিরে আসেন যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্যে।

’৭১ এর আগস্টের দিকে কমিউনিস্ট পার্টির পুলুম ঘাঁটি ভেঙে যায়। ফলে, পার্টির কর্মীরা ডুমুরিয়া এলাকায় আশ্রয় নেন। ডুমুরিয়া এলাকা থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যাত্রা করেন তোজো, শান্তি, মানিক, আসাদ ও ফজলু। পথে মনিরামপুর উপজেলার রতে স্বরপুর গ্রামের আব্দুর রহমানের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র এ পাঁচ যুবক। কিন্তু পাকহানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকারদের চোখ এড়াতে পারেননি তারা। স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার আব্দুল মালেক ডাক্তারের নেতৃত্বে মেহের জল্লাদ, ইসাহাক, আব্দুল মজিদসহ বেশ কয়েকজন রাজাকার তাদের আশ্রয়স্থল চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে ওই ৫ স্বাধীনতাকামী যুবককে আটক করে।

এরপর তাদের চোখ বেঁধে চিনাটোলা বাজারের পূর্বপাশে হরিহর নদীর তীরে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। তাদের শরীরে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্ত বের করে তাতে লবণ দেয়া হয়। এভাবে অমানুষিক নির্যাতন চলে ওই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত।

ওই নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শী চিনাটোলার শ্যামাপদ নাথ জানান, সেদিন তিনি ছিলেন ২৪ বছরের টগবগে যুবক। শ্যামাপদ সে সময় চিনাটোলা বাজারে মুটেগিরির কাজ করতেন। রাজাকারদের নির্দেশে ওইদিন শ্যামাপদকে হরিহর নদীর ওপর ব্রিজ পাহারার দায়িত্ব দেয়া হয়।

তিনি জানান, ওই দিন রাত ৮টার দিকে চোখ বাঁধা অবস্থায় মুক্তি সেনা কমরেড আসাদুজ্জামান আসাদ, কমরেড মাশিকুর রহমান তোজো, কমরেড সিরাজুল ইসলাম শান্তি, কমরেড আহসান উদ্দিন খান মানিক ও কমরেড ফজলুর রহমান ফজলুকে ব্রিজের পাশে আনা হয়।

শ্যামপদ আরো জানান, এ সময় তার দায়িত্ব ছিল ব্রিজের আশেপাশে যেন কোন লোক চলাচল না করে। এর পরপরই তাদের নিয়ে যাওয়া হয় চিনাটোলা ব্রিজ থেকে একটু দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সৈয়দ মাহমুদপুর গ্রাম সংলগ্ন হরিহর নদীর তীরবর্তী স্থানে। তার কিছুক্ষণ পর রাজাকার কমান্ডারের বাঁশি বেঁজে ওঠার সাথে সাথে গর্জে ওঠে শত্রুর রাইফেল। মুহূর্তের মধ্যে পাঁচ তরতাজা যুবকের নিথরদেহ লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।

রাজাকারদের ভয়ে সেদিন কেউ এগিয়ে না আসলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরদিন সকালে তিনি (শ্যামাপদ) এবং স্থানীয় আকব্বর আলী নদীর তীরে যেখানে ওই ৫ মুক্তিকামী যুবককে হত্যা করা হয় সেখানে একটি বড় কবর খুড়ে একই কবরে তাদের সমাহিত করেন।

এদিকে, প্রয়াত ৫ শহীদের মৃত্যুবার্ষিকীতে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট যশোর জেলা বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে সকাল ১০টায় প্রয়াতদের সমাধিস্থল মনিরামপুরের চিনাটোলায় শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, শোক নিরবতা পালন ও শপথ পাঠ করা হবে। এরপর সকাল ১১টায় কৃষক সংগ্রাম সমিতি মনিরামপুর থানা কমিটির উদ্যোগে চিনাটোলা বাজারে এক স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। বিকেল সাড়ে ৩ টায় জাতীয় ছাত্রদল যশোর জেলা কমিটির উদ্যোগে যশোর দড়াটানা শহীদ চত্বরে অপর একটি স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে।



মন্তব্য চালু নেই