৩৮ জঙ্গির তথ্যের খোঁজে পুলিশ

ঘরছাড়া ৩৮ তরুণ-তরুণী দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন পরিবার থেকে। তাদের অবস্থান ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মিলছে না তথ্য। পুলিশ ও গোয়েন্দারা নানামুখী প্রচেষ্টায় তাদের হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। এসব নিখোঁজ তরুণ-তরুণীকে নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। কারণ প্রাথমিক তথ্য অনুসারে তারা সবাই সন্দেহভাজন জঙ্গি। তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের পর এসব নিখোঁজ তরুণ-তরুণীর সন্ধানে সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর দিকনির্দেশনা পাঠিয়েছে সব জেলায়।

পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘যারা নিখোঁজ তারা যেন মা-বাবার কাছে ফিরে আসে, সেটাই আমাদের চাওয়া। তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে যারা উৎসাহ দিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। নিখোঁজরা ফিরে এলে পুলিশ সব ধরনের সহায়তা করবে। তবে কারো বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা থাকলে এই ক্ষেত্রে পুলিশ সহায়তা করবে না। ইতিমধ্যে নিখোঁজদের প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি মা-বাবার উচিত সন্তানরা কোথায় যায়, কী করে তা সার্বক্ষণিক নজরদারি করা।’

সূত্র জানায়, পরিবারসহ বিভিন্ন সূত্রে তথ্য সংগ্রহের পর পুলিশ সদর দপ্তর নিখোঁজদের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে। তালিকার একপর্যায়ে ৫১ জনের তথ্য ছিল। তাদের মধ্যে ১০ জন ইতিমধ্যে পুলিশের অভিযানে নিহত হয়েছে। আর তিনজন ফিরে এসেছে নিজ পরিবারে। পুলিশ সদর দপ্তর আনুষ্ঠানিকভাবে তালিকা প্রকাশ না করলেও সর্বশেষ নিখোঁজের সংখ্যা ৩৮ বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। আর তাদের প্রায় সবাই জঙ্গি সংগঠন নতুন জেএমবির মতাদর্শী বলে তথ্য মিলছে।

পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দেশে বিচ্ছিন্ন জঙ্গি তৎপরতা নির্মূলে নানা প্রচেষ্টা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এরই মধ্যে ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশ কর্মকর্তা, বিদেশিসহ ২২ জনকে হত্যার ঘটনা চরম উদ্বেগ তৈরি করে। যৌথ বাহিনীর অভিযানে নিহত ছয়জনের পরিচয় যাচাইয়ে দেখা যায়, তাদের পাঁচজনই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। এরপর ঈদুল ফিতরের দিন সকালে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলায় পুলিশের দুই কনস্টেবল নিহত হন। সেখানে অভিযানকালে নিহত জঙ্গিও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। তরুণ এসব জঙ্গি মতাদর্শীর বেশির ভাগই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী। এ পরিস্থিতিতে র‌্যাব-পুলিশসহ গোয়েন্দা সংস্থা তথ্যানুসন্ধানে নামে। র‌্যাব প্রথমে ১৮১ জনের একটি নিখোঁজ তালিকা তৈরি করে। পরে তা যাচাই-বাছাইয়ে ৬৮ জনে পৌঁছে। পুলিশ সদর দপ্তর আলাদাভাবে নিখোঁজ তালিকা করে। সেটি যাচাই-বাছাই করে ৫১ জনের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। এ তালিকাভুক্তদের মধ্যে পুলিশের অভিযানে ইতিমধ্যে ১০ জন মারা গেছে। বর্তমানে তালিকায় ৩৮ জনের নাম থাকলেও তারা কোথায় আছে বা কী করছে সেই তথ্য জানা যাচ্ছে না। এ তালিকায় একই পরিবারের চার সদস্য রয়েছে। মঈন উদ্দিন শরীফ, তার স্ত্রী তানিয়া শরীফ, ভাই রেজোয়ান শরীফ ও মা পান্না শরীফ প্রায় দুই বছর ধরে নিখোঁজ বলে জানা গেছে। নিখোঁজদের মধ্যে তেজগাঁওয়ের মোহাম্মদ বাসারুজ্জামান ২০০৭ সালে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। বছর দুয়েক আগে বিয়ে করে এবং পরে নিখোঁজ হয়ে যায়। পরিবারের ধারণা, বাসারুজ্জামান সিরিয়ার সীমান্তবর্তী কোনো এলাকায় আছে। কুষ্টিয়ার মনির হোসেনের ছেলে জুনায়েদ খান ও ইব্রাহিম হাসান খান ২০১৫ সাল থেকে নিখোঁজ আছে। ধানমণ্ডির তৌহিদুর রহমানের ছেলে জুন্নুন সিকদার ২০১৫ সাল থেকে নিখোঁজ। সে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। ২০১৪ সালে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য হিসেবে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করেছিল। পরে জামিন নিয়ে পালিয়ে যায় জুন্নুন। সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের ছেলে আশরাফ মোহাম্মদ ইসলাম প্রায় এক বছর ধরে নিখোঁজ। প্রায় একই অবস্থা ধানমণ্ডির বজলুর রহমানের ছেলে জুবায়েদুর রহিমের ক্ষেত্রে। প্রায় দেড় বছর খবর নেই তার। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের মোহাম্মদ রফিকুল্লাহ আনসারীর ছেলে নজিবুল্লাহ আনসারী চটগ্রাম থেকে নিখোঁজ হয়। লক্ষ্মীপুরের এ টি এম তাজউদ্দিন ওরফে কাওছার দীর্ঘদিন নিখোঁজ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ ওজাকি বছরখানেক ধরে নিখোঁজ হয়। তার আসল নাম সুজিত দেবনাথ। জাপানের এক নারীকে বিয়ে করে জাপানের নাগরিকত্ব নেয় এবং সেখানেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। গাজীপুরের তৌহিদুল ইসলামের ছেলে রিদওয়ান ইসলাম তুহিন বছরখানেক ধরে নিখোঁজ আছে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার সায়মা আক্তার মুক্তা ও তার স্বামী সাইফুল ইসলাম কয়েক বছর ধরে নিখোঁজ। সাইফুল সিরিয়ায় নিহত হয়েছেন বলে পুলিশ তথ্য পেয়েছে। ছয় বছরের ছেলে আমান শেখ ও চার বছরের ছেলে রোমান মুক্তার সঙ্গে আছে। মিরপুরের রাবেয়া আক্তার টুম্পা নামের এক তরুণীর সন্ধান মিলছে না দীর্ঘদিন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নুরুল ইসলাম মারজান ওরফে ফাহাদও দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ। ঢাকার খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা ডাক্তার রোকন উদ্দিন খন্দকার, তাঁর স্ত্রী নাইমা আক্তার, মেয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রেজওয়ানা রোকন, রামিতা রোকন, ছেলে সাদ কায়েস বর্তমানে সিরিয়ায় অবস্থান করছেন বলে পুলিশ প্রায় নিশ্চিত। আশুলিয়ার আবদুল মালেকের ছেলে আবদুর রহমান মাসুদও দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, সারা দেশে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের পর ৩৮ জনের জঙ্গি সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব সন্দেহভাজন যেকোনো সময় বড় ধরনের নাশকতা ঘটাতে পারে—এমন আশঙ্কা রয়েই গেছে। তারা দেশে, না বিদেশে অবস্থান করছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য মেলেনি। সে কারণে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। নিখোঁজদের সন্ধানে প্রতিটি জেলার পুলিশ সুপারদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। -কালের কণ্ঠ



মন্তব্য চালু নেই