১০ দিনে মারা হলো ৬ সাপ

২৫ বছর পর ফিরে এলো সেই ভাইপার, আতঙ্কে গোটা এলাকা

বিষাক্ত রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোরা সাপের আতঙ্কে দিন পর করছেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার বাধাইড় এলাকার কৃষকরা। গত ১০ দিনে ৬টি রাসেল ভাইপার মারা হয়েছে ওই এলাকায়। কৃষকরা ধান কাটতে গিয়ে দেখা পাচ্ছেন এ সাপের। আতঙ্কে আশেপাশের মাঠগুলোতে ধান পেকে গেলেও কেউ জমিতে নামতে রাজি হচ্ছেন না।

শনিবার জুমার পাড়া এলাকার কৃষক রবিউল ইসলামের জমিতে ধান কাটতে যায় লোকজন। ওইসময় ধানের ভেতরে লোকজন রাসেল ভাইপার সাপ দেখতে যায়। পরে সেটিকে মারা হয়। যারা কৃষক রবিউল ইসলামের ধান কাটছিল পরে তারা ধান না কেটে চলে যায়।

এর আগে, ১৩ নভেম্বর শিবরামপুর শালবান্দা গ্রামের সমশের আলীর নার্সারিতে রাসেল ভাইপার দেখতে পাওয়া যায়। ওই সাপটিও মারা হয়। ১১ নভেম্বর সাইধাড়া বাথানপাড়া এলাকায় খাইরুল ইসলামের জমিতে একটি, শিবরামপুর পশ্চিম পাড়ায় সাহেব আলীর জমিতে ধান কাটতে গিয়ে ১০ নভেম্বর একটি, আগের দিন ৯ নভেম্বর লগনপাড়া গ্রামে হোসেন আলীর জমিতে একটি ও ৪ নভেম্বর এসতার আলীর ধানের জমিতে একটি রাসেল ভাইপার সাপ মারা হয়।

2015_11_14_21_57_25_yGo6HljVrUm4qlliXBURf9n0Z7Gmyh_original

শিবরামপুরের জহুরুল ইসলাম ২২ বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছেন। তিনি জানান, দ্বিগুণ মজুরি দিয়েও জমির ধান কাটতে রাজি হচ্ছে না। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। একই এলাকার কৃষক শাহজাহান আলী ৬০ বিঘা জমিতে ধানের চাষ করেছেন। তিনি জানান, তার ৬০ বিঘা জমির ধান পেকে গেছে। সাপের ভয়ে কেউ ধান কাটতে রাজি হচ্ছে না।

জুমারপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুর রাজ্জাক জানান, ১০ দিন ধরে প্রায় প্রতিদিনই বিষাক্ত এ সাপ পাওয়া যাচ্ছে। শনিবার পর্যন্ত রাসেল ভাইপার সাপ মারা হয় ৬টি। এরপর থেকে কৃষকরা ভয়ে মাঠে নামছেন না। দ্বিগুণ মজুরি দিয়েও মিলছে না শ্রমিক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ ভয়ঙ্কর রাসেল ভাইপারের দংশনে গত ১৫ অক্টোবর উপজেলার সাঁইধাড়া গ্রামের ইয়ামিন কালু (৫০) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে গত বছরের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সাপের দংশনে প্রাণ হারায় আরো অন্তত ৫ জন। গত বছর এ সাপের দংশনে কয়েকজনের মৃত্যুর পর এ অঞ্চলে বিষধর এ সাপের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

2015_11_14_21_57_52_vUIpXds65khXqxx5r3QB9B4SSvxMLk_original

চিকিৎসকরা বলছেন, এ সাপের দংশনে মানবদেহে পচন শুরু হয়। এর কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হয়। কোনো প্রতিশেধকেই বাঁচানো সম্ভব হয় না।

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও সহকারী অধ্যাপক ডা. আবু শাহীন  বলেন, এই সাপ বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত। ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে দেখা মিলেনি। তবে গত বছরের জুনে নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার আগ্রাদ্বিগুণ গ্রামের জামাল নামের কৃষককে প্রথমে দংশন করে। সেদিনই তাকে রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর বিভিন্ন অ্যান্টি স্নেক ভেনম দিলে তিনি স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন। তবে ৩ দিন পর তার পায়ে কামড়ের জায়গায় পচন ধরে। ওই সময় মেডিকেল জরুরি টিম করে তার যে পায়ে কামড় দিয়েছিল সেই পা অর্ধেকটা কেটে ফেলতে হয়। কিন্তু ৮ দিনের মাথায় তার পা থেকে সারা শরীরে পচন ছড়িয়ে পড়লে তিনি মারা যান।

এর এক মাস পর চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার বরেন্দ্রা গ্রামের আব্বাস আলীর ছেলে আক্কাসকে (১৮) হাতের আঙ্গুলে সাপ কামড় দেয়। তিনিও রামেক হাসপাতালে ভর্তি হন। এ রোগীকে দেখে সেই সাপে কাটার লক্ষণই দেখা গিয়েছিল। ৬ দিন পর হাত কেটে ফেলে দেয়ার পরও তিনি মারা যান। এরপর একই বছরের ২৫ নভেম্বর তানোর উপজেলার শিবরামপুর গ্রামের নওসাদ আলীর ছেলে তাজিমুদ্দিদের (২৫) পায়ে সাপ কামড় দেয়। একইভাবে তারও পা কাটার পর তার সারা শরীর পচন ধরে ৯ দিন পর মারা যান।

অধ্যাপক ডা. আবু শাহীন আরও জানান, এই বিষধর সাপ বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর এর কোনো ভ্যাকসিন বা ইনজেকশন নেই। সে কারণে তাদের বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘তিনজনের মৃত্যুর পর আমরা আন্তর্জাতিক বিষ গবেষণা কেন্দ্রের (জার্মানি) সাহায্য চেয়ে চিঠি দিয়েছিলাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে জার্মানি থেকে একটি গবেষণা টিম গত বছর তানোরের শিবরামপুর গ্রামের মাঠে মাঠে গিয়ে সেই বিষধর সাপ ধরে এনেছে। এ সাপের নমুনা সংগ্রহ করে বিশেষজ্ঞ দল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে।’

2015_11_14_22_51_05_MfxymYsYbh5RGWHJmMlvC2iG8qDM0F_original

ডা. আবু শাহীন জানান, রাসেল ভাইপার নামের এই সাপটি বরেন্দ্র এলাকায় বিস্তার লাভ করেছে। এই সাপ বছরে দুইবার বাচ্চা দেয় এক সঙ্গে ২০ থেকে ৩০টি। আর লম্বা হয় দুই থেকে তিন ফুট পর্যন্ত। এই সাপ ২৫ থেকে ৩০ বছর আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা যেত।

স্থানীয় বাধাইড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান হেনা বলেন, উপজেলার জুমারপাড়া, শিবরামপুর ও সাইধাড়া এলাকায় ধান কাটার কৃষক পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েকদিন ধরেই ক্ষেতে ধান পেকে গেলেও কৃষকরা জীবন বিপন্নের ভয়ে মাঠে নামছে না। এ নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। তিনি জানান, এ সাপের অস্তিত্ব সবচেয়ে বেশি ধানের ক্ষেতে। তাই ক্ষেতে নামছেন না কৃষকরা।বাংলামেইল



মন্তব্য চালু নেই