২৩ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে সেদিন যা ঘটেছিল

দুই বছর আগে দেশবাসীকে কাঁদিয়ে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চির বিদায় নিয়েছিল ছোট্ট জিহাদ। তাকে উদ্ধারে রাতভর অভিযান চালায় ফায়ার সার্ভিস। স্থানীয়রাও কম জাননি। টর্চ, দড়ি থেকে শুরু করে জিহাদকে উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন তারা। টেলিভিশনের এপার থেকে দেশবাসীও দোয়া করেছেন জিহাদের উঠে আসার জন্য। তবে সেই রাতে পাওয়া যায়নি জিহাদকে।

২৩ ঘণ্টার সেই ‘আলোচিত’ অভিযান
২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা। অন্যান্য দিনের মতো বন্ধুদের সঙ্গে শাহজাহানপুরে রেলওয়ে মাঠের পাশে খেলছিল ছোট্ট জিহাদ। তবে হঠাৎ করেই ওয়াসার ঢাকনা খোলা পাম্পের পাইপে পড়ে যায় সে। জিহাদকে পাইপে পড়তে দেখেন তার দুই বন্ধু এবং পাশের বাড়ির এক নারী। পাইপ থেকে নিচে পরে যাওয়ার পর শুরু হয় হইহুল্লোর।

সাড়ে ৪টায় ঘটনাস্থলে পৌঁছে ফায়ার সার্ভিস। এলাকার সড়কগুলো সরু থাকায় ঘটনাস্থলে পৌঁছতে বিলম্ব হয় তাদের। শুরু হয় অভিযান। পাইপের গর্তে প্রথমে টর্চ দিয়ে তল্লাশি চালায় তারা। ভেতরে দেয়া হয় অক্সিজেন। এরপর দড়ি ফেলা হয়। ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা জিহাদের সাড়া পাওয়ার অপেক্ষায় থাকলেও দড়ি ধরে উঠে আসেনি জিহাদ।

সন্ধ্যার পর ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জিহাদের জন্য পাইপের গর্তের ভেতর টর্চলাইট, মোবাইল এবং জুস পাঠান। তাদের ধারণা ছিল জিহাদ বেঁচে থাকলে সে এগুলো গ্রহণ করবে। তবে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। জুসের প্যাকেটভর্তি বাজারের ব্যাগটিও তুলে নিলেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।

ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ৯টা। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রি. জে. আলী আহমদ খান তখন চট্টগ্রামে। ঢাকার পথে বিমানে রওনা হওয়ার আগে ঘটনাস্থলে উপস্থিত পরিচালকদের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন তিনি।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা পরিকল্পনা করেছিলেন, পাইপের পাশে নতুন একটি সুড়ঙ্গ করে সেখান দিয়ে পানির প্রেসার দেয়া হবে। অন্যদিক থেকে জিহাদ উঠে আসবে। তবে সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে ফায়ার সার্ভিস। কারণ এতে জিহাদকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব নাও হতে পারে।

রাত দেড়টায় ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা পাইপের ভেতরে ঢোকার সিদ্ধান্ত নেন। তবে পাইপের প্রস্ত এতটাই সরু ছিল যে তিনি জিহাদকে উদ্ধার করে ফিরতে পারবেন কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ ছিল। ভেতরে অক্সিজেনও ছিল কম। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে তাকে নিচে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।

জিহাদকে উদ্ধারে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে তরুণরা ড্রোন ক্যামেরাসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে উপস্থিত হন। জিহাদকে উদ্ধারের জন্য ব্যাকুল ছিলেন তারা। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের পাইপের কাছে আসতে দেয়া হয়নি।

সারাদেশের মানুষ সে রাতে জেগেছিল। টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে জিহাদের ফেরার অপেক্ষা করছিলেন তারা। রাত ২টার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ (বর্তমান র্যা ব মহাপরিচালক)। উপস্থিত হন গোয়েন্দা সংস্থার মহাপরিচালকরা। পাইপের ভেতর ক্যামেরা দিয়ে সার্চ করানোর সিদ্ধান্ত নেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

শুরু হয় ক্যামেরা পাঠিয়ে সার্চিং অভিযান। ২৮০ ফুট গভীর পর্যন্ত তল্লাশির পর রাত ৩টায় সংবাদ সম্মেলন ডাকেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ক্যামেরায় টিকটিকি, তেলাপোকাসহ অন্যান্য কীটপতঙ্গের অস্তিত্ব পাওয়ার দাবি করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বললেন, জিহাদ ভেতরে নেই। সত্যিই সে পাইপে পড়েছিল কি না, এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি। অনেকটা হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন তিনি।

রাত ৪টায় জিহাদের বাবা নাসির ফকিরকে শাহজাহানপুর থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। জিহাদকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে কি না জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাকে।

ওদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পরও অভিযান চালিয়ে যায় ফায়ার সার্ভিস। অভিযানের শুরুতে ফায়ার সার্ভিসের টার্গেট ছিল জিহাদকে জীবিত উদ্ধার করা। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পর জিহাদকে ‘অন্তত’ উদ্ধারের চেষ্টা করছিল তারা।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল। এখনো উদ্ধার হয়নি জিহাদ। বিকেল ২টা ৫৫ মিনিটে সংবাদ সম্মেলন করলেন ফায়ার সার্ভিসের ডিজি। জিহাদকে না পেয়ে এবার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধার অভিযান সমাপ্তের ঘোষণা দেন তিনি।

জিহাদকে উদ্ধার করতে এবার এগিয়ে এলেন শাহ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, শফিকুল ইসলাম ও রাহুল দাস নামের তিন যুবক। তাদের বানানো বর্শার সাহায্যেই অচেতন অবস্থায় জিহাদকে উদ্ধার করা হলো। সময়টা ফায়ার সার্ভিসের ডিজির আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির ঘোষণার ৫ মিনিট পর।

এর মাধ্যমেই শেষ হয় জিহাদকে উদ্ধারের শ্বাসরুদ্ধকর ২৩ ঘণ্টার অভিযান।

উদ্ধারের ৩০ মিনিট পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক এম নিয়াজ মোর্শেদ তাকে মৃত ঘোষণা করেন।



মন্তব্য চালু নেই