২০১৪ সালের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ও ১৫’র প্রত্যাশা

ক্যালেন্ডার থেকে চিরতরে বিদায় নিল আরও একটি বছর। এ বছরে কি অর্জন করতে পেরেছি এবং কি পারিনি তার হিসাব মেলাতে ব্যস্ত অথচ প্রত্যাশা মাফিক কিছুই মিলছে না। দীর্ঘ সময়ে অনেক কিছুই অর্জন করতে পারতাম কিন্তু তার বেশির ভাগ-ই হয়নি। বরং আপাত দৃষ্টিতে হারানোর পাল্লাটাই বেশি ভারি। যেভাবে হয়েছে তা না হয়ে উল্টোও হতে পারত কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তা হয়নি। সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অর্জনের সাথে বর্জনের চিত্র মেলাতে চাইলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। এমনটাই কি কাম্য ছিল? দীর্ঘ ৩৬৫ দিনের পথ-পরিক্রমায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গে বিশৃঙ্খলার চিত্র মারাত্মকভাবে ফুটে উঠেছে। অর্জন যে একেবারেই নাই তা নয় বরং বর্জনের পাশে অর্জনকে দাঁড় করালে অর্জনকে খুব বেশি রোগা মনে হয়। কথিত আছে, যে দিনটা যায় সেটাই ভালো যায়, সামনে যে দিন আসে সেগুলোই খারাপ। এ কথাটি যদি সত্য হয় তবে প্রশ্ন জাগে-আগামী দিনগুলো কতটা খারাপ হতে পারে? ’১৪ সাল জুড়েই ছিল চরম অস্থিরতা। প্রাকৃতিক দূর্ঘটনার চেয়ে মানবসৃষ্ট দূর্ঘটনার সংখ্যাই ছিল বেশি। প্রাকৃতিক দূর্ঘটনার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে তা অল্প দিনেই কেটে ওঠা সম্ভব কিন্তু মানবসৃষ্ট দূর্ঘটনার ক্ষতি কি কোন দিনই কাটিয়ে ওঠা যাবে? রাজনৈতিক বাগ-বিতন্ডা থেকে শুরু করে সামাজিক অপরাধের উলঙ্গ মহড়া চলেছে গোটা বছর জুড়ে। মানুষ দুবেলা খেতে পেরেছে ঠিক কিন্তু জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ঘুমাতে পারেনি। গুম, খুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বছর হিসেবে ২০১৪ কে ইতিহাসে কালো অধ্যায় হয়ে থাকতে হবে।

গণতন্ত্রের প্রতি আঘাত, বাক-স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় অন্যায়ভাবে শৃঙ্খল পড়ানোর চেষ্টা ও দমন-পীড়নের বছর হিসেবেও ’১৪ সালকে ভুলে যাওয়া সহজ হবে না। শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈরাজ্য, গার্মেন্টস শিল্প ও অন্যান্য শিল্পে অস্থিতিশীলতা, জিএসপি সুবিধা বন্ধ এবং সড়ক ও নৌ দুর্ঘটনায় হাজার হাজার মানুষের অকালে প্রাণ হারানোর জন্যও চিহ্নিত থাকবে বিদায়ী বছরটি। মাদক দ্রব্যের সয়লাব, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, চোরাকারবারীদের চরম দৌরাত্ম্য, নারীর প্রতি সহিংসতা ও দেশব্যাপী বিদ্যুত বিপর্যয়ের কথা খুব দ্রুত ভুলবার নয়। প্রতিবেশি ভারতের বিশ্বাসঘাতকতা, বর্হিবিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন ও দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবনমন দীর্ঘদিন আলোচনায় থাকবে। বিদায়ী বছরে দেশের বিশিষ্টজনদের মধ্য থেকে কিছু ‍বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, শিক্ষক, বিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিদায় দেশে মারাত্মক শূণ্যতার সৃষ্টি করেছে। বিদায়ী বছরে অর্জনও কম ছিল না। দেশের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টিকারী বাজেট, জাতীয় সংসদের স্পিকার ও একজন সাংসদের দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থার নেতৃত্ব পাওয়া কম কিসে। দেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম চাল রফতানি করার স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনও দেশকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিকভাবে আরও অনেকগুলো নতুন দিকপাল উন্মোচিত হয়েছে। বছরের প্রথম দিন দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে কোটি কোটি নতুন বই তুলে দেওয়ার কৃতিত্বও অর্জিত হয়েছে। তবে মন খারাপ করেই বলতে হয়, যোগ-বিয়োগ করে বর্জনের চেয়ে অর্জনের সংখ্যা একেবারেই কম ।

বিদায়ী বছরের পুরোটা জুড়ে সর্বাধিক আলোচিত ঘটনা ছিল গুম ও খুন। অনেকগুলো খুনের ঘটনা ঘটলেও তার মধ্যে র‌্যাবের হাতে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, রাজধানীর বিহারী পল্লিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগে ১০ জন এবং সুন্দরবনে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ১৩ জন নিহত হওয়ার ঘটনাই সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে । এ ছাড়াও রাজধানীতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত নেতা নুরুল ইসলাম ফারুকী, ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হত্যা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যা, রাজধানীর মগবাজারে তিন খুন ও কেরানীগঞ্জে চার খুনের ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। সড়ক ও নৌ দুর্ঘটনার মধ্যে নাটোরের বড়াই গ্রামের দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ এবং পিনাক-৬ নামক লঞ্চ ডুবিতে শত শত মানুষের প্রাণহানির ঘটনা বছরজুড়েই আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় সাংবাদিক ও এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক জগলুল আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুও ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। বিদায়ী বছরের শেষ মূহুর্তে রাজধানীর শাহজাহানপুরের রেলওয়ে কলোনিতে ৬০০ ফুট গভীর পাইপের মধ্যে ৪ বছরের শিশু জিহাদ পড়ে যাওয়া এবং সরকারী উদ্ধারকর্মীদের বিফলতায় তার মৃত্যুও সম্ভবত দেশের সর্বাধিক আলোচিত ঘটনা হয়ে থাকবে। এছাড়া সংখ্যালঘুদের উপর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। দেশে গুমের সংস্কৃতি গত দুবছর ধরে ব্যাপক আলোচিত হলেও ’১৪ সালে এবি সিদ্দীকির গুম এবং উদ্ধার হওয়ার ঘটনাই সর্বাধিক আলোচিত হয়েছে। এছাড়াও গুম বিরোধী আন্দোলনে গুম হওয়ার মানুষদেরকে ফেরত পাওয়ার দাবি বারবার উত্থাপিত হয়েছে। ডাক্তার ও চিকিৎসকের সম্পর্কের অবনতিতেও ’১৪ সাল চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বিদায়ী বছরের সারা দেশব্যাপী ডাক্তাররা একাধিকবার ধর্মঘট ও কর্মবিরতি পালন করেছে। লোডশেডিংয়ের ভয়াবহ অবস্থা এবং ১লা নভেম্বর সারাদেশব্যাপী বিদ্যুত বিভ্রাটের কারণে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার উপলক্ষ্য তৈরি হয়েছিল। এছাড়াও ক্ষনে ক্ষনে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে জনমনে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।

ফরমালিন আগ্রাসন ও খাদ্য দ্রব্যে ভেজাল মিশ্রনের জন্য ’১৪ সালকে ভুলে যাওয়ার উপায় নাই। ফরমালিন নামক নিষিদ্ধ বিষ মিশিয়ে সব ধরণের খাদ্য দ্রব্যকে মানুষের জীবনের জন্য হুমকির মাধ্যম বানানো হয়েছিল। প্রশাসনের চেষ্টাও ফরমালিনের আগ্রাসন রোধ করা সম্ভব হচ্ছিল না। এছাড়াও বাজারে ভেজাল ওষুধে সয়লাব হয়েছে। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং শিক্ষার মান কমে যাওয়ার চিত্র বার বার উম্মোচিত হয়েছে। তবুও প্রশাসন প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করতে কার্যকরী কোন ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেনি। পাশের হার বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার মান নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন। বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট বিক্রির কথা বেশ গুরুত্ব নিয়েই আলোচিত হয়েছে। দেশের কতিপয় গ্রহনযোগ্য ব্যক্তিদেরকে নিয়ে অযথা বাড়াবাড়ি করায় সৃষ্টি হয়েছে নানা বিতর্ক। দোষারোপের রাজনীতির বলি হতে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সকল বিদেশিরা বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে তাদেরকে আমন্ত্রন করে পদক দেয়া হয়েছে। তবে লজ্জার কথা, তাদেরকে যে পদক দেয়া হয়েছে তার পুরোটাই ভেজাল। স্বর্ণের নামে তামা দিয়েই গড়া হয়েছিল সে পদক। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার কয়েকজনকে রাজাকার সম্মোধন করা হয়েছে। বঙ্গুবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা জিয়াউর রহমানের মত সর্বজনস্বীকৃত ব্যক্তিদেরকে বিরুদ্ধবাদীরা নানা অযৌক্তিক বক্তব্য দিয়ে পরস্পরের প্রতি নতুন প্রজন্মের খারাপ ধারনা সৃষ্টির পায়তাঁরা করা হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রীদের উদ্ভট কথাবর্তায় সারা বছর জুড়েই ছিল চরম বিতর্ক। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার জন্যও বিদায়ী বছরকে মনে রাখতে হবে।

ধর্ম নিয়ে সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দীকির কটূক্তি মুসলিম জনগোষ্ঠীর হৃদয়ে আঘাত হেনেছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কিছু নামকাওয়াস্তের মুসলিম শিক্ষক-শিক্ষিকা ইসলাম ও এর পালনীয় বিধি-বিধান নিয়ে কটুক্তি করেছে। ’১৪ সাল জুড়েই শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা বিরাজমান ছিল। বিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে স্বশস্ত্র আন্দোলন, নিজেদের মধ্যে কোন্দল, শিক্ষার্থী হত্যা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করার ঘটনা ঘটেছে কয়েকবার। বিদেশী সংস্কৃতি বিশেষ করে ভারতীয় অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে দেশিয় সংস্কৃতির প্রায় বিদায় হয়েছে বিদায়ী বছরে। সে সকল অপসংস্কৃতির প্রভাবে আত্মহত্যা এবং বিচ্ছেদের মত ঘটনাও ঘটেছে। সারা বছর জুড়ে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে অনেক পণ্যই সাধারণ মানুষে ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ছিল। বিদায়ী বছরে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ দল নির্বাচনে অংশগ্রহন না করলেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের মোট সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৫৩ টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্ধন্ধীতায় সংসদ সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে! দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক অনাকাঙ্খিত ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড ঘটেছে। বিরোধী মতকে দমনের নগ্ন পদচারণাও হয়েছে বিদায়ী বছরে।

বিদায়ী বছরের বিদায়ের সাথে অপ্রাপ্তি, হতাশা কিংবা ক্ষোভের পুরোটাই দেশবাসী ভুলে যেতে চায়। নতুন স্বপ্ন বুনতে চায় নতুন বছরকে ঘিরে। ২০১৪ সালে যা হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি জাতি আর দেখতে চায় না। সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহনের মাধ্যমেই শুরু হোক ’১৫। দূর হোক সকল অপ্রাপ্তির হতাশা। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তির পরশ লাগুক। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অপরাধমুক্ত একটি বাংলাদেশের ছবি অঙ্কিত হোক আগামী দিনের জন্য। শিক্ষাক্ষেত্রের নৈরাজ্যও দূর করা হোক। দেশীয় সংস্কৃতির চর্চায় আত্মনিয়োগ করা প্রত্যেকের দায়িত্ব হোক। গ্রহনযোগ্য ব্যক্তিদেরকে সকল বিতর্কের উর্ধ্বে রাখা হোক। রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতিকে চিরতরে বিদায় করার উদ্যোগ নেয়া জরুরী। সর্বোপরি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসলে কোন উন্নয়ণ ধারাবাহিক করা সম্ভব নয়। কর্তৃপক্ষকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানাই। নতুন বছরটি যেন আমাদেরকে নিরাশ না করে তার জন্য সকলের সচেতনতা জরুরী।



মন্তব্য চালু নেই