১০৩ বছর পর ছিটমহলে ভূমি জরিপ

১০৩ বছরেরও বেশি সময় পর বিলুপ্ত ১১১টি ছিটমহলে ডিজিটাল ভূমি জরিপ শুরু হয়েছে। জেলার ফুলবাড়ীর সদরের সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়ায় শুক্রবার ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের সার্ভে সেটেলমেন্ট ট্রেনিং বিভাগের কারিগরি উপদেষ্টা (আবাসিক) ও ক্যাম্প অফিসার জাকির হোসেনের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি দল জরিপ কার্যক্রম শুরু করেছে।

জাকির হোসেন জানান, এ পদ্ধতিতে দ্রাঘিমা ও অক্ষাংশের সাহায্যে জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) পদ্ধতিতে দাসিয়ারছড়ার ভূমির অবস্থান চিহ্নিত করে চারটি কন্ট্রোল পয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছে। এজন্য সার্ভে অব বাংলাদেশ আর্মি কর্তৃক স্থাপিত কুড়িগ্রাম সদরের কাঁঠালবাড়ী কলেজ মাঠে স্থাপিত একটি পিলারকে একক ধরে ১৬৪৩ দশমিক ৪৪ একর আয়তনের দাশিয়ারছড়ার কালিরহাট, বোর্ডেরহাট, কামালপুর ও রাশমেলায় চারটি জিপিএস নির্ণয় মেশিন স্থাপন করে মান নির্ণয় করা হয়।

তিনি আরও জানান, প্রাপ্ত মানের সাহায্যে মাঠ পর্যায়ের জরিপদল ইটিএস (ইলেকট্রিক্যাল টোটাল স্টেশন) মেশিনের সাহায্যে প্রতি প্লট জমির ডাটা সংগ্রহের পর ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করবে। এরপর এই ম্যাপের ভিত্তিতে জমির মালিকদের পরচা সরবরাহ করা হবে। জমির আপত্তিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে।

জাকির হোসেন আরও জানান, একমাত্র ডিজিটাল পদ্ধতিতে নির্ভুল ভূমি জরিপ জমির মালিকদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দূর করতে সহায়ক হবে। দুই দেশের (বাংলাদেশ-ভারত) প্রশাসন (ডিসি-ডিএম ) ছিটমহলের জমির সিএস নকশা, খতিয়ানসহ নথিপত্র দিতে না পারায় ছিটমহলের মানুষের জমি নিয়ে নানা উদ্বেগ উৎকণ্ঠার প্রেক্ষিতে সরকার ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ কার্যক্রম শুরু করে। ব্লু প্রিন্ট (পূর্বের ম্যাপের সঙ্গে মিল রেখে) পদ্ধতির পরিবর্তে কিস্তর পদ্ধতির (ক্যাডাস্টাল সার্ভে) মাধ্যমে এ জরিপ সম্পন্ন করা হবে। এ জরিপ কার্যক্রম এক মাসব্যাপী চলবে। সর্বশেষ প্রায় ১০৩ বছর আগে (১৯১২-১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে) ছিটমহলগুলোতে ব্রিটিশ সরকারের সময়ে সেটেলমেন্ট ভূমি জরিপ হয়েছিল।

এ উপলক্ষে ফুলবাড়ী উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দাসিয়ারছড়ার কারিরহাট বাজার কমিউনিটি সেন্টারে বিকেলে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মেছবাহ উল আলম প্রধান অতিথি ছিলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, ভূমি জরিপ ও রেকর্ড অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আনোয়ার হোসেন, পরিচালক (জরিপ) আনোয়ার হোসেন, কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবেন্দ্রনাথ উঁরাও, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নজির হোসেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) নবী নেওয়াজ, উপজেলা সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার আক্তারুজ্জামান, বিলুপ্ত ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের নেতা গোলাম মোস্তফা, আলতাব হোসেন।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মেছবাহ উল আলম বলেন, ‘অধুনালুপ্ত ছিটমহলবাসীর জমির মালিকা সচিব।’

জরিপের আগে দাশিয়ারছড়ায় জমি নিয়ে বিরোধের জেরে কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৩১ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়িত হবার একদিন পর গত ২ আগস্ট জমি নিয়ে বিরোধের ঘটনায় ১০ জন আহত হয়েছিল। ওইদিন আউয়াল খন্দকারের ছেলেদের সঙ্গে সিরাজুদ্দিন খন্দকারের ছেলেদের সংঘর্ষ বাধে। এরপর ১৮ আগস্ট ছোট কামাত গ্রামের আব্দুল হামিদ ও হাসমত নামের দুই ভাইয়ের মধ্যে জমির দখল নিয়ে সংঘর্ষ বাঁধে। এতে পাঁচজন আহত হয়। এ নিয়ে আদালতে একটি মামলাও হয়। এটিই ছিটমহলের প্রথম মামলা।

প্রকৃতপক্ষে ছিটমহলগুলোর কোথাও বাংলাদেশ বা ভারত কোনো দেশের বিধি মেনে জমি বেচাকেনা হয়নি। ফলে বেশিরভাগ জমির আইনসম্মত কোনো দলিল বা নিবন্ধন নেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা দেওয়ানি দরবারিদের সাক্ষী রেখে স্ট্যাম্পে বা সাদা কাগজে নামসই বা টিপ দিয়ে চুক্তির মাধ্যমে বেচাকেনা হয়েছে।

রংপুর জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার আব্দুল মান্নান জানান, সদ্য বিলীন হওয়া ছিটমহলগুলোর অধিকাংশ জমিরই নথিপত্র খুঁজে পায়নি দুই দেশের প্রশাসন (ডিসি-ডিএম)। সে কারণে বিরোধ এড়াতে ডিজিটাল জরিপ পদ্ধতির মাধ্যমে নির্ধারণ হবে জমির প্রকৃত মালিক।
কোচবিহারের বাংলাাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন স্থলবন্দর চ্যাংরাবান্দায় দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (প্রশাসনিক পর্যায়) বৈঠকে শুধুমাত্র বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ১৯টি ছিটমহলের এবং ভারতের পক্ষ থেকে ৫৪টি ছিটমহলের নথিপত্র সরবরাহ করা হয়েছে। অথচ ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতে বিলীন হয়েছে। এর ফলে ভারতের ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর জমি বাংলাদেশে যুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সাত হাজার ১১০ দশমিক শূন্য দুই একর জমি ভারত পেয়েছে।

এর আগে মূলত যারা যে অবস্থানে আছে (রেকর্ড অব রাইট) তাদের সে অবস্থানে রেখেই বাংলাদেশে যুক্ত হওয়া ১১১টি ছিটমহলে গত ১৫ অক্টোবর প্রাক জরিপের মাধ্যমে খতিয়ান ও ম্যাপ প্রস্তুতের কাজ শুরু হয়। সরেজমিনে কলমি নকশা ও খতিয়ান ফরমের অনুকরণে জমির হাল তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

গত বছরের ১৫ নভেম্বর থেকে ৩০ দিন পর্যন্ত চলে এ জরিপ কার্যক্রম। জরিপ কাজকে সমন্বয় করার জন্য জেলা প্রশাসককে সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) সদস্য সচিব করে আট সদস্য বিশিষ্ট জেলা ওয়ার্কিং কমিটি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে(ইউএনও) সভাপতি এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি)সদস্য সচিব করে আট সদস্য বিশিষ্ট উপজেলা ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়। মাঠ পর্যায়ে কাজ করার জন্য কানুগোর নেতৃত্বে সাত সদস্য বিশিষ্ট ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়।

দাশিয়ারছড়ায় এরকম দুইটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। এই ওয়ার্কিং গ্রুপ জমির মাপজোক, মালিকানা সংক্রান্ত পুরোনো নথিপত্র বিশ্লেষণ এবং দখলের ওপর ভিত্তি করে প্রাক জরিপ সম্পন্ন করে খসড়া খতিয়ান প্রদান করে। জরিপ চলার সময় বিরোধীয় জমির আপত্তি নিষ্পত্তি করা হয়।

ছিটমহলের কলমি নকশা ও মালিকানার হাল তথ্য হস্তান্তর সম্পর্কে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মেছবাহ উল আলম বলেন, ‘অধুনালুপ্ত ছিটমহলবাসীর জমির মালিকা নিশ্চিত করতে প্রাক জরিপ শেষে ডিজিটাল পদ্ধতির সাহায্যে চূড়ান্ত জরিপ ও ম্যাপ তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছে। কারণ বিলুপ্ত ছিটমহলে বসবাসকারীদের কাছে এই মুহূর্তে জমির মালিকানার কোনো কাগজপত্র নেই। তাদের মালিকানা নিশ্চিত এবং ভোগান্তি দূর করতে সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছে।’

বৃহস্পতিবার সকালে কুড়িগ্রাম কালেক্টরেট সম্মেলন কক্ষে ভূমির কলমি নকশা ও মালিকানার হাল তথ্য হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন ভূমি সচিব।

তিনি আরো বলেন, ‘৬৮ বছরের বঞ্চনার অবসান হলেও তাদের জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধ ও সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং এটি এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এজন্য তাদের জমির মালিকানা দেয়ার জন্য আমরা প্রাক জরিপ করি। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করা হয়। বিবেচনা করা হয় দীর্ঘদিন থেকে ভোগদখলের বিষয়টি। এভাবে খসড়া মালিকানা তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এইসব তথ্য রেকর্ড করে বই তৈরি করা হয়। আর এই বই আজ আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হল।’

জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিনের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসাবে বক্তব্য দেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব এবং ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আব্দুল জলিল। এ সময় জেলা পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও সুধীজন উপস্থিত ছিলেন।

ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আব্দুল জলিলের হাতে অনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ছিটমহলের ভূমির কলমি নকশা ও মালিকানার হাল তথ্য হস্তান্তর করেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মেছবাহ উল আলম।

কানুনগো আজাহার আলী জানান, কুড়িগ্রাম জেলার তিনটি উপজেলার ১২টি বিলুপ্ত ছিটমহলের ভূমির প্রাক জরিপের তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম সদরের হলোখানা ইউনিয়নের লক্ষীকান্ত মৌজায় অবস্থিত বিলুপ্ত ছিটমহল ডাকুরহাট ডাকনির কুঠির প্রায় ১৪ একর জমির মালিক কাউকে পাওয়া যায়নি। সিএস ও এসএ রেকর্ড মোতাবেক ছিটনং ১৬৬ ও রাজ্য কোচবিহার হিসাবে অন্তভুক্ত ছিল। জমির পরিমাণ ছিল ১৪ দশমিক ২৭০ একর। কিন্তু আরএস রেকর্ডে এটিকে গাইবান্ধা জেলার অন্তর্গত করে জমির পরিমাণ দেখানো হয় ১৩ দশমিক ৪৮০ একর। ইতোমধ্যে এ ভুল সংশোধন করা হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই