হাসপালে পেট্রোল বোমায় আহত রোগিদের আহজারি

গাইবান্ধায় ঢাকাগামী নৈশ্য কোচে পেট্রোল বোমা হামলায় দগ্ধ লিয়াকত আলী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। স্ত্রী সন্তানদের পেটের ভাত যোগার করার জন্য কাজের খোঁজে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এখন তার বাঁচা মরা সমান। চিকিৎসা করার মতো সাধ্যও তার নেই ।

কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীর দিন মজুর সাজু মিয়াসহ চার জন কাজের সন্ধানে নদীপার হয়ে আসেন পাঁচপীর বাজারে। সেখান থেকে রাতে বাসে ওঠেন। এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়েন চলন্ত বাসে। এরপর আর কিছু বলতে পারেন না তারা।

হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় কাতর সাজু মিয়া জানান, মা, বোন, স্ত্রী সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেয়ার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। কিন্তু পেট্রোলবোমা সব কিছু শেষ করে দিয়েছে। ছোট সন্তান, বৃদ্ধা মা আর বউয়ের কথা মনে পড়লেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন। বলেন, ‘মা’গো মরে গেনু, বাঁচাও মোকে।’

শুক্রবার রাতে গাইবান্ধার তুলশীঘাট বুড়িরঘর এলাকায় ঢাকাগামী নৈশ্যকোচে পেট্রোলবোমা হামলার ঘটনায় শিশুসহ প্রাণ হারিয়েছে ছয় জন। এছাড়া দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন লিয়াকত আলী আর সাজু মিয়ার মতোই অন্তত ৩৯ জন।

মৃত ও অগ্নিদগ্ধদের এ তালিকায় রয়েছে দিনমজুর, মাটিকাটার কামলা, বাসাবাড়ির কাজের মেয়ে। পুলিশি প্রহরায় যাত্রীবাহী নৈশ্যকোচে পেট্রোলবোমা হামলায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছে জেলার সর্বস্তরের মানুষ। কাজের সন্ধানে অন্য জেলার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হওয়া শ্রমজীবীদের মধ্যে আরো বেশি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

রাত সাড়ে নয়টার দিকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছীচা পাঁচপীর থেকে ওইসব খেটে খাওয়া মানুষ যাত্রা শুরু করেছিল ঢাকার উদ্দেশে। সঙ্গে ছিল পুলিশি পাহারা। রাত ১১টার দিকে তুলশীঘাট বুড়িরঘর এলাকায় পৌঁছুলে ওঁৎ পেতে থাকা দুর্বৃত্তরা অতর্কিত পেট্রোলবোমা হামলা চালায় বাসটিতে। নিরাপত্তাজনিত কারণে আগে থেকেই বন্ধ ছিল দরোজা। কিন্তু ছুড়ে মারা পেট্রোলবোমা সামনের গ্লাসে সজোরে আঘাত করে ভেতরে ঢুকে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বাসের ভেতরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। দগ্ধ হয় অন্তত ৩৯ জন যাত্রী। আর বাসের ভেতরে পুড়ে মারা যায় তিন যাত্রী। পরে আরো দুজনের মৃত্যু হয়। তারা হলেন- সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সৈয়দ আলী (৪২), পশ্চিম চন্ডিপুর গ্রামের হালিমা বেওয়া (৪২), সুমন মিয়া (২২) ও তার মেয়ে শিল্পী দাস (১০) এবং রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যাওয়া মোহম্মদ তারা মিয়ার ছেলে সুজন (১০)।

দগ্ধ যাত্রীদের মধ্যে রয়েছেন- সুন্দরগঞ্জের উজান বোচাগাড়ি গ্রামের মতলব (৫০), সাজেদুল (৪) মঞ্জুরুল (২৮), আলম মিয়া (২৫), জোসনা (২২), চন্ডিপুর গ্রামের আশরাফুল (২৭), শফিউল (৩৪), সিরাজুল (২৫), সফিউল (৩৫), সাধনা (৩৫), ফারাজিপাড়া গ্রামের তারা মিয়া (৩৫), সোনাভান (৩৫), সীচা গ্রামের মাসুদ (২৪), কফিল উদ্দিন (৩৬), রহিম (২৬), তানজিনা (৫), রফিকুল (২৫), আমজাদ (২৮), জাহেদুল (৪০), তানজিলা (১৫), তাবিজতোলা গ্রামের সাহেদুল (১৮), উত্তর সীচা গ্রামের রফিকুল (২৭), সাঘাটা উপজেলার উল্লা বাজার এলাকার জ্যোতি (১৮), ফুলছড়ি উপজেলার বরমতাইড় গ্রামের শহীদ(২৩), সদর উপজেলার মালিবাড়ি সরকারপাড়ার কাইছার(৪৩), ফকিরপাড়া গ্রামের আবুল কালাম আজাদ (২৫), পলাশবাড়ি উপজেলার কুমিদপুর গ্রামের আমিনুল (২২), কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার পাত্ররখাতা গ্রামের জাফর আলী (৩৫), গোয়ানপাড়া গ্রামের বুলবুলি(২২), মমেনা (১৮), ইয়াজুল (৩৬), রংপুরের বদিউজ্জামান বিদ্যুৎ(২৪), রেজাউল (৩০), জাবের মিয়া (৩০), জুলি আকতার (১৮), আশরাফুল (২৫), সাজু মিয়া (২৫), সাইদুল (২৩) ও জাহাঙ্গীর (৩৫)। এরা সবাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ২০ জনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. এহছানে এলাহী, পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম, সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার দুর্ঘটনার পর পরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম জানান, ঘটনাস্থলসহ গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী সড়কে র‌্যাব, বিজিবির পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নাশকতাকারীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

উল্লেখ্য, শুক্রবার রাত ১১টার দিকে গাইবান্ধা জেলার তুলসীঘাট এলাকায় ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে ঢাকাগামী নাপু এন্টারপ্রাইজের যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোলবোমায় দেয়া আগুনে চালক, হেলপার ও শিশুসহ ৬ জন নিহত হয়েছে। দগ্ধ হয় ৩৯ যাত্রী।



মন্তব্য চালু নেই