হানিফ ফ্লাইওভারে ‘মরণফাঁদ’

মোটরসাইকেল আরোহীদের জন্য ‘মৃত্যুফাঁদে’ পরিণত হয়েছে ঢাকার মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ‘এক্সপানশন জয়েন্ট’; গত দুই বছরে অন্তত নয়জনের মৃত্যু হয়েছে সেখানে।

ফ্লাইওভারের কয়েক জায়গায় সড়কের সমান্তরালে কংক্রিটের সংযোগস্থলগুলো মোড়ানো হয়েছে ইস্পাতের পাত দিয়ে, যাকে ‘এক্সপানশন জয়েন্ট’ বলা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই জোড়ায় স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ফাঁক থাকায় তা দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০১৩ সালের অক্টোবরে চালু হওয়া ১১ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ফ্লাইওভার দিয়ে গুলিস্তান থেকে শনিরআখড়া ও পোস্তগোলা পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়। চার লেইনের ফ্লাইওভারে উঠতে ছয়টি এবং বের হতে সাতটি পথ রয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক জানান, সড়ক বা সেতুতে ‘এক্সপানশন জয়েন্ট’ কতটুকু ফাঁক থাকলে যানবাহনের সমস্যা হবে না, তা ঠিক করা আছে।

মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের এক্সপানশন জয়েন্টগুলোতে পৌনে এক থেকে এক ইঞ্চির মতো ফাঁক তৈরি হয়েছে, যা সেই মাত্রার চেয়ে বেশি বলে মনে করছেন এই বিশেষজ্ঞ।

মোটরসাইকেলের তুলনামূলক সরু চাকা লম্বালম্বি ওই ফাঁকে পড়লে চালক নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। বাহনের গতি বেশি থাকলে ঘটছে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা।

পুলিশের খাতায় আসা দুর্ঘটনার তথ্য অনুযায়ী এসব দুর্ঘটনায় অন্তত নয়জন নিহত হয়েছেন, আহতের সংখ্যা শতাধিক।

গত জুলাই মাসে এরকম এক দুর্ঘটনায় আহত হন চঞ্চল আহমেদ নামের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “ফ্লাইওভারে ওঠার পর সরু ফাঁকে মোটরসাইকেলের চাকা পড়ল; আমি নিয়ন্ত্রণ হারালাম। ভাগ্য ভালো যে শুধু আহত হয়েছি; পেছনে কোনো গাড়ি থাকলে নিশ্চিত মৃত্যু হত।”

প্রায় একই অভিজ্ঞতা হয়েছে কাঁটাবনের মোটরসাইকেল মেকানিক মো. ইউনূসের।

“ওইখানে গিয়া হঠাৎ মনে হইলে বালুতে যেমনে পিছলায়া যায় চাক্কাডা সেইরকম পিছলাইল। আমি কুনো রকমে গাড়ি খাড়া করাইয়া দেহি দুই জোড়ার চিপার মইদ্দে আটকাইছে।”

ইউনূস জানান, এই ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনায় পড়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত মোটরসাইকেল নিয়ে আরও অনেকেই তার দোকানে গেছেন।

“এইরকম অন্তত পাঁচটা মোটরসাইকেল আমি সারাই করছি। এক্কেবারে ভাইঙ্গাচুইরা গেছিল।”

গত ৩১ আগস্ট রাতে মোটরসাইকেলে ফ্লাইওভার পার হওয়ার সময় চাকা পিছলে গেলে পেছন থেকে আসা থাকা বাসের চাকায় প্রাণ যায় জহিরুল ইসলাম (৪০) ও আমজাদ হোসেন পাশার (৪২)।

ওয়ারি থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা বলেন, “দুই জয়েন্টের মাঝখানে লোহার মতো কিছু একটা দেওয়া আছে। স্পিড বেশি থাকলে বা বৃষ্টি হলে অনেক সময় পিছলে যায়। জহিরুল ও আমজাদের মৃত্যু এভাবেই হয়েছে বলে আমাদের ধারণা।”

এর আগে গত ২৪ জুলাই একইভাবে মৃত্যু হয় মুজিবুর রহমান নামে আরেক মোটরসাইকেল আরোহীর। ৭ জুন নিহত হন দুই সহোদর নজরুল ইসলাম (৩৫) ও মেহেদী হাসান (২৮)।

যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক মো. আব্দুল্লাহ বলেন, “দুর্ঘটনার ধরনগুলো প্রায় একইরকম। দ্রুতবেগে যাওয়ার সময় মোটরসাইকেল জয়েন্টে পিছলে পড়ছে। পরে অন্য কোনো গাড়ি তাদের চাপা দিচ্ছে। জয়েন্টগুলো পার হওয়ার সময় একটু উনিশ-বিশ হলেই ঘটছে দুর্ঘটনা।”

চলতিবছর ১১ ফেব্রুয়ারি শামীম রেজা নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী একইভাবে মারা যান। দ্রুতবেগে ফ্লাইওভার অতিক্রমের সময় পিছলে পড়ে গত বছরের ২ নভেম্বর জ্যাকি হোসেন নামে এক স্কুল ছাত্র নিহত হন, আহত হন তার পেছনে থাকা আরও দুজন।

বাংলাদেশ সড়ক যোগাযোগ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) অগাস্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নিবন্ধন নিয়ে ঢাকার রাস্তায় চলাচল করছে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৭টি মোটরসাইকেল।

পরিসংখ্যানের বাইরেও প্রচুর মোটর সাইকেল চলাচল করছে জানিয়ে মেয়র হানিফ উড়াল সড়কে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে ‘এক্সপানশন জয়েন্টগুলো’ মেরামতের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সেইসঙ্গে চালকদের আগে থেকে সচেতন করতে ফ্লাইওভারে বার্তা রাখারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে এ ফ্লাইওভারের ব্যবস্থাপনা, টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে ওরিয়ন গ্রুপ।

‘এক্সপানশন জয়েন্টের’ অতিরিক্ত ফাঁক নিয়ে এ কোম্পানির কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।বিডিনিউজ২৪



মন্তব্য চালু নেই