হাত দিলেই মামলা…

কয়দিন লাগে রেলওয়ের কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে? এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকে বলেছেন, নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে ১ মাস, ৬ মাস, ১ বছর সময় লাগতে পারে। সেখানে ৮ বছরেও রেলওয়ের ৬৮ ক্যাটাগরিতে ৭ হাজার ১৪০টি শূন্য পদে কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে পারবে না। এটা কি করে হয়! এক শ্রেণীর কর্মকর্তাদের অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে ২০০৬ সাল থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়া ঝুলে রয়েছে।

অপর একটি মহল বলছেন, নিয়োগ প্রক্রিয়া যতো দেরি হবে ততোই তদবির বাড়বে। আর এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তাদের পকেট ভারী হবে। এসব কারণে দিনের পর মাস এবং বছরের পর বছর পার হচ্ছে কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হচ্ছে না।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ২০১০ সালের ১১ আগস্ট ও ২০১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করার সময় সীমা বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ বিগত দিনে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেনি। এ নিয়ে সাধারণের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে আর কতোদিন সময় লাগবে?

অথচ জনবল সঙ্কটের দোহাই দিয়ে রেল উন্নয়নে কোনো প্রকল্পই যথাসময়ে বাস্তবায়ন করতে পারছে না। শুধু জনবল সঙ্কটের কথা বলে পার পেয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে ৪০টি প্রকল্পের মধ্যে ৩২টি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি নেই। কিন্তু ব্যয় ঠিকই দেখানো হয়েছে বলে রেল সূত্র জানায়।

আগামী ২০১৫ সালের মধ্যে আরো ৩ হাজার লোক অবসরে যাবে। এর মধ্যে জনবল নিয়োগ না করলে রেল সেক্টরে বিপর্যয় নেবে আসবে। ইতোমধ্যে ৪৪০টি রেল স্টেশনের মধ্যে ১২৫টি স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। তবে রেলওয়ে পরিচালক (সংস্থাপন) ইঞ্জিনিয়ার মো. ইব্রাহীম খলিল বলছেন, ‘এ সেক্টরে ৬৮ ক্যাটাগরিতে ৬ হাজার ১৭২ লোক নিয়োগ এখন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’

রেলওয়ের নির্ভরযোগ্য অপর একটি সূত্র জানায়, রেল কর্তৃপক্ষের কাজে গাফলতির কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আর এ ফাঁকে, ‘কাজ নেই মজুরি নেই’ ভিত্তিতে কর্মরত কর্মচারীরা আদালতে মামলা করার সুযোগ পায়।

২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে পুনরায় জনপ্রশাসনের ছাড়পত্র প্রাপ্তির পর রেল কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে কয়েকটি ক্যাটাগরিতে লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়। এতে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ আবেদন জমা পড়ে। ছাড়পত্রে বলা ছিল ২০১২ সালের ১১ আগস্টের মধ্যে নিায়োগ সম্পন্ন করা।

কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষের আজ-কাল করতে করতে নিয়োগ পিছিয়ে যায়। এই সুযোগে ‘কাজ নেই মজুরি নেই’ ভিত্তিতে কর্মরত কর্মচারীরা বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ১৫টি মামলা করে। ইতোমধ্যে ১১টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। প্রশাসন থেকে আবারো নিয়োগের জন্য সময় দেয়া হয়। কিন্তু তারপরও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেনি রেল কর্তৃপক্ষ।

রেল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, ৬ হাজার ১৭২ পদের মধ্যে ১ হাজার ৪৪১ খালাসী ও ওয়েম্যান রয়েছে ২ হাজার ৭১১, টেলিফোন অপারেটর ২০, স্টোর টেন্ডেল ১৪, এএসএম ৯১, সহকারী শিক্ষক ৩৩, গার্ড (গ্রেড-২) ৭৬, স্টোর মুন্সি ২৬, টাইম কিপার ৩১, পার্শ্বেল সহকারী (গ্রেড-২) ১২, ম্যাটোরিয়াল চেকার ৮ ও কাউন্টার (গ্রেড-২) ৭ জন নিয়োগের জনপ্রশাসনের ছাড়পত্রের মেয়াদ গতবছর ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে।

নতুন করে জনপ্রশাসনের ছাড়পত্র না পেয়েই ২০১০ সালে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করার জন্য প্রার্থীদের  বর্তমানে মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে।

অপরদিকে ৯৯০ জন চতুর্থ শ্রেণী ও ৩৪৮ জন তৃতীয় শ্রেণীর লোক নিয়োগেও নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠে। চতুর্থ শ্রেণীর পদে শুধু মৌখিক পরীক্ষায় নিয়োগ দেয়া হয়। আর তৃতীয় শ্রেণী পদে লিখিত ও মৌখিক দু’টো পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়। এ নিয়োগে অনিয়ম করা হয়েছে এমন অভিযোগ এনে অনেকেই মামলা দায়ের করেছে।

ইঞ্জিনিয়ার মো. ইব্রাহীম খলিল বাংলামেইলকে জানান, নিয়োগ নিয়ে একের পর এক জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় ২০০৬ সালের পর আর জনবল নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে ৬৮টি ক্যাটাগরির মধ্যে ২০টির নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বর্তমান ৪০ ক্যাটাগরির নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কোনো সমস্যা না হলে আগামী তিন মাসের মধ্যে নিয়োগ শেষ করা যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

তিনি বলেন, ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আদেশ পালনের চেয়ে আদালতের মামলা নিষ্পত্তি করাই এখন বড় সমস্যা। এক মামলা খারিজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেক মামলা দায়ের করা হয়। এখনো ৪টি মামলা রয়েছে। এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের হস্তক্ষেপ কামনা করে চিঠি পাঠানো হয়েছে।’

উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে চারদলীয় জোট সরকারের সময় এ নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে চারদরীয় জোট সরকারের সময়ের সব নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। বিষয়টি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়কে জানানো হলে ২০০৮ সালে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০০৯ সালে নতুন করে নিয়োগ পরীক্ষা নেয়ার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমতি চাওয়া হয়।

কিন্তু ২০০৯ সালে বিভিন্ন পদে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে ৭৪ জন ভিন্ন ভিন্নভাবে আদালতে মামলা দায়ের করেন। তারা রেলওয়ের কর্মচারীদের কাছ থেকে স্বাক্ষর ছাড়া কম্পিউটারে তৈরি অপ্রকাশিত পাস করা পরীক্ষর্থীদের তালিকা দাখিল করেন আদালতে।

দাখিল করা ওই কাগজের ভিত্তিতে আদালত তাদেরকে নিয়োগ দেয়ার জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। কিন্তু এর মধ্যে একজন মারা যাওয়ায় আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ৭৩ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এর পরও নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা আরো কয়েকজন পরীক্ষার্থী আদালতে মামলা দায়ের করেন।

এছাড়া ‘কাজ নেই মজুরি নেই’ ভিত্তিতে কর্মরত কর্মচারীদের পক্ষ থেকে তাদের চাকরি স্থায়ী না করা পর্যন্ত সব নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার জন্য আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। সেই প্রেক্ষিতে আদালত তাদের নিয়োগ স্থায়ী না করা পর্যন্ত সব নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। আদালতের মামলা এখনো নিষ্পত্তি করা হয়নি। এছাড়া আদালতের আদেশে ৭৩ জনকে নিয়োগ দেয়া হলেও চাকরি পাওয়ার আগেই ওই কর্মচারীদের মধ্যে থেকে আরো মামলা করা হয়। যে মামলা এখনো চলমান।

রেলপথ মন্ত্রী মুজিবুল হক বাংলামেইলকে বলেন, ‘১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের সময় লোকসান কমানোর নামে রেলকে ছোট করার চিন্তা করে গোল্ডেন হ্যান্ডসেকের মাধ্যমে দক্ষ জনবল ছাটাইয় করা হয়। কিন্তু পরবর্তী সরকারের সময় এর পরিধি বাড়ানো হলেও দীর্ঘদিন ধরে রেলের কোনো লোকবল নিয়োগ দেয়া হয়নি বললেই চলে। যার ফলে রেলকে কোনো মতে সচল রাখার জন্য ড্রাইভার, গার্ডসহ বেশকিছু পদে অবসরে যাওয়া লোকদের পুনরায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে চালানো হচ্ছে।’



মন্তব্য চালু নেই