রানা প্লাজা ধসের বর্ষপূতি আজ

হাইকোর্টের নিদের্শনা অনুযায়ী তদন্ত কমিটি হয়নি , প্রতিবেদন বহু…দূর

সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় আহত ও নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ গত বছরের ৩০ এপ্রিল কিছু নির্দেশনা দেন। নির্দেশনায় ভবনের মালিক সোহেল রানা এবং ৫ গার্মেন্টস মালিকের সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞার আদেশ ছিল হাইকোর্টের। ঢাকা জেলার ডিসি, এসপি, জেলা রেজিস্ট্রারকে এ আদেশ কার্যকরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে আদেশে অভিযুক্তদের সম্পদ যেন অন্য কোনো নামে হস্তান্তর হতে না পারে সেজন্য নিবন্ধন পরিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের (আইজেআর) পক্ষ থেকে দেশের সব ভূমি নিবন্ধকের (সাব রেজিস্ট্রার) প্রতি সার্কুলার জারি করতে বলা হয়। এছাড়াও ভবন মালিক রানাসহ ওই ৫ জনের ব্যাংক হিসাব থেকে কোনো অর্থ অন্যত্র স্থানান্তর যেন না হতে পারে সে বিষয়েও সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতি সার্কুলার জারি করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে দেয়া হয় নির্দেশ। বিজিএমইএ’র তত্ত্বাবধানে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের বিষয়েও আদেশ দেয়া হয়। এরপর আদালতের সব আদেশের বিষয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে একটি প্রতিবেদন দাখিল করতে আইজেআরকে নির্দেশ দেয়া হয়।
বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ ও নির্দেশনা দেন। এছাড়া সারাদেশে যেসব গার্মেন্ট কারখানা ঝুকিপূর্ণ তা অবিলম্বে বন্ধ করতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের প্রধান কারখানা পরিদর্শককে নির্দেশ দেয়া হয়।
এদিকে শুনানিতে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে এক কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য প্রস্তাব করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি আদালতে বলেছিলেন, ‘ভবন মালিক ও গার্মেন্ট মালিকদের কাছ থেকে ৬শ কোটি টাকা আদায় করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে। যার মধ্যে ভবন মালিক দেবে তিনশ কোটি টাকা ও গামের্ন্ট মালিকরা দেবে বাকি তিনশ কোটি টাকা।
তবে ওই ঘটনায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন আদালত। অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেছিলেন, ‘আপনার ব্যক্তিগত মতকে সাধুবাদ জানাই। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার এখানে কী করেছে সেটাই প্রশ্ন।’
অন্যদিকে ২৮ এপ্রিল গ্রেপ্তারের পর রানা প্লাজার মালিক সাভার থানা যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক সোহেল রানা এবং পাঁচটি গার্মেন্টের ৪ মালিক বজলুস সামাদ আদনান, মাহমুদুর রহমান তাপস, আনিসুর রহমান ওরফে আনসিুজ্জামান এবং আমিনুল ইসলামকে আদালত কক্ষে কড়া পুলিশ প্রহরায় হাজির করা হয়। এসময় সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেন সরকার, সাভার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, হাবিবুল ইসলামসহ (প্রধান পরিদর্শক, কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিদপ্তর) সংশ্লিষ্টরাও আদালতে হাজির হন।
এ বিষয়ে আদালতের দেয়া স্বঃপ্রণোদিত রুলের ওপর শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, আইনজীবী হাবিবুল ইসলাম ভূইয়া, কেএম সাইফুদ্দিন, ব্যারিস্টার সারাহ হোসেন, ড. ইউনুস আলী আকন্দ, ব্যারিস্টার হাসান এমএস আজিম, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আলামিন সরকার, মোহাম্মদ হোসেন লিপু প্রমুখ।
শুনানি শেষে ক্ষতিগ্রস্তদের কাকে কী পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে তা গুরুত্ব বিবেচনা করে তা নির্ধারণ করার জন্য নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি, ঢাকা জেলার ডিসি, এসপি, বিজিএমইএ, ৫ গার্মেন্টের প্রতিনিধি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত, শ্রম মন্ত্রণালয়, বুয়েটের একজন করে প্রতিনিধি এবং মেডিসিন, মনোবিদ, অর্থনীতিবিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। আদেশ পাওয়ার পর এক মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছিল কমিটিকে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তদের একটি তালিকাও জমা দিতে বলা হয়েছিল।
এছাড়া জীবন রক্ষায় সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি ওই ঘটনায় রাজউক, বিজিএমইএ ও শিল্প কলকারখানা পরিদর্শকের নেয়া পদক্ষেপের কথা জানাতে বলা হয়। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতায় কত ভবন আছে তার তালিকা পর্যায়ক্রমে আদালতে দাখিল করতে রাজউককে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। প্রথম পর্যায়ে গার্মেন্ট ফ্যাক্টটির তালিকা দিতে বলা হয়েছিল। দেশের সব গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ভবন ব্যবহারযোগ্য কি না, অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা আছে কি না, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ আছে কি না তার তালিকাসহ সে বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বিজিএমইএকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
রানা প্লাজায় অবস্থিত ব্র্যাক ব্যাংকের ম্যানেজারকে ভবন ধসের আগের দিন কী পদক্ষেপ নিয়েছিল তা লিখিতভাবে আদালতে দাখিল করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। দুই সপ্তাহের মধ্যে এ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। ভবন ধসের আগের দিন রানা প্লাজা পরির্দশনকারী প্রকৌশলী ফজলুল হককে নাম ঠিকানা আদালতে দাখিলের জন্য ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। আর এ কাজে তাকে সহায়তা করার কথা ছিল সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
রানা প্লাজা ধসের পর আদালতের উপরোক্ত নির্দেশনা ও আদেশের বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব হয়েছে এ বিষেয়ে আহতদের পক্ষের আইনজীবী জ্যোতিময় বড়ুয়া জানান, ‘রানা প্লাজা ধসের আজ (বৃহস্পতিবার) এক বছর পূর্তি হতে চলেছে। এই ঘটনায় তিনটি পৃথক মামলা হয়েছে। এছাড়াও আদালত স্বঃপ্রণোদিত হয়ে সংশ্লিষ্ট সকল প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রাথমিকভাবেই যে কমিটি গঠনের কথা ছিল তা এখনো করা হয়নি। আর কমিটি গঠন না হওয়ায় ঘটনার মূল প্রতিবেদন এখনো আদালতে প্রেরণ সম্ভব হয়নি। মামলাটি বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দারের কোর্টে রয়েছে। আদালতের অন্যান্য মামলার চাপে শুনানির দিন তারিখ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাজ করছে।’
অ্যাডভোকেট জ্যোতিময় বড়ুয়া আরো বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তদেরকে এখনো পর্যন্ত প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ দেয়া সম্ভব হয়নি। অথচ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম যা দেয়া হয়েছে তাকেই ক্ষতিপূরণ ধরে রিপোর্ট করছে। এটা মোটেই কোনো ক্ষতিপূরণ নয়। এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে যেসব অনুদান পৌঁছানো হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে অনুদান হিসেবেই এসেছে। আর বিভিন্ন দাতব্য সংস্থাই এই অনুদান দিয়েছে।’
আদালতের মামলা প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই ক্ষতিপূরণ ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে পৌঁছানো সম্ভব নয় বলেও জানিয়েছেন তিনি।
উল্লেখ্য, সাভারের রানা প্লাজা ভবন গত বছরের ২৪ এপ্রিল ধসে পড়ে। স্মরণকালের ভয়াবহ ওই ভবন ধসে এক হাজার ১২৯ জন নিহত এবং আহত হয় প্রায় আড়াই হাজার লোক। এ ঘটনায় ভবন মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি মামলা হয়। যার মধ্যে তিনটিই ভবন ধসের ঘটনায় হত্যা মামলা। অপর দু’টি মামলার একটি অস্ত্র ও অন্যটি বিশেষ ক্ষমতা আইনে। মামলাগুলোতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আদালত থেকে রুল জারি করা হয়।



মন্তব্য চালু নেই