“স্যার ভগবানকে দেখিনি, আপনাকে দেখলাম”

ডা. সামন্ত লাল সেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আসা দগ্ধ রোগী ও তাদের আত্মীয়-স্বজন কিংবা খবর সংগ্রহে আসা সাংবাদিক বা দর্শনার্থীদের কাছে এক পরিচিত নাম। অনেকের কাছেই তিনি পরিচিত ‘ভগবান দাদা’ হিসেবে।

ডা. সামন্ত লাল সেন এখন ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এবং জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অবৈতনিক উপদেষ্টা।

এই চিকিৎসকের গল্পটা শুরু হয়েছিল আরও অনেক আগে। ১৯৮০ সালে ঢামেক হাসপাতালে বদলি হয়ে আসেন ডা.সেন। দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা না হতে দেখে ১৯৮৬ সালে প্লাস্টিক সার্জন অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর অনুপ্রেরণায় বার্ন ইউনিট করার প্রস্তাবনা দেন মন্ত্রণালয়ে। সেই উদ্যোগ সফল হয় ২০০১ সালে। ঢামেক হাসপাতালে ৫০ শয্যা নিয়ে প্রতিষ্ঠা হয় আলাদা বার্ন ইউনিট। যা বর্তমানে উন্নীত হয়েছে ৩০০ শয্যায়। এখন তৈরি হচ্ছে ৫০০ শয্যার একটি ইনস্টিটিউট। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের নানা চ্যালেঞ্জ আর বর্তমান সাফল্য নিয়ে বার্ন ইউনিটের চারতলায় বসে কথা হলো সামন্ত লাল সেনের সঙ্গে।

‘বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত ছিল দগ্ধ রোগীরা। আগে দেশে তাদের চিকিৎসার সুব্যবস্থা ছিল না। হাসপাতালগুলোতে কোনও ওয়ার্ডও ছিল না। যুদ্ধের শুরু তখন থেকে, যা এখনও শেষ হয়নি।’ দেশে দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা সেবার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এভাবেই নিজের অনুভূতি জানালেন ডা. সেন।

cc6374213f737227b574e3657342a0f9-

শুরুর কথা

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন ড. আর জে কাস্ট (রোনাল্ড জোসেফ কাস্ট) আসেন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য। এরপর ভারতের লুধিয়ানা থেকে আসেন আরেকজন প্লাস্টিক সার্জন। এটাই বাংলাদেশে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির সূচনালগ্ন। পরে আমি ঢামেক হাসপাতালে বদলি হয়ে দেখলাম দগ্ধ রোগীদের জায়গা হচ্ছে হাসপাতালের বারান্দায়, মেঝেতে, বাথরুমের পেছনে মশারি টাঙিয়ে। তখন সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ছিল দগ্ধ রোগীরা। এসব রোগীকে মেঝেতে রাখা খুবই বিপজ্জনক। কারণ তাতে দগ্ধ স্থানে সংক্রমণের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। ২০০১ সালে ঢামেকে আলাদা এই ইউনিট হয়। এখানে একটা বস্তি ছিল,সেই বস্তি সরাতে গেলে আমার বিরুদ্ধে মিছিল, হুমকি দেওয়া হলো। তৎকালীন সরকারের সহায়তায় বস্তি সরিয়ে এই ভবন তৈরি হয় এবং ২০০১ সালে কার্যক্রম শুরু করলাম ৫০ শয্যা নিয়ে। এখন এটি ৩০০ শয্যার। তৈরি হচ্ছে ৫০০ শয্যার বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট। ভগবানকে বলি, আমাকে দুইটা বৎসর বাঁচিয়ে রাখো, আমি যেন হাসপাতালটা বানিয়ে মরতে পারি।

বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন বনাম ভগবান দাদা

জীবনটা শুরু করেছিলাম প্লাস্টিক সার্জন হিসেবে। স্বপ্ন ছিল মানুষের চেহারা সুন্দর করবো, অনেক টাকার মালিক হবো, কয়েকটা গাড়ি থাকবে। পৃথিবীতে প্লাস্টিক সার্জনরা খুব ধনী হয়। কিন্তু এই স্বপ্নটা আমার ভেঙে গেল যখন এই হাসপাতালে এলাম। পুড়ে যাওয়া রোগীদের সংস্পর্শে এসে দেখলাম তাদের কষ্ট। আমার মা একদিন বলেছিলেন,‘তুমি গরিব মানুষের জন্য কিছু করো। তাহলেই আমার আত্মা শান্তি পাবে।’ আমার বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণা আমার অনেক কিছু। নিমতলীর ঘটনার সময় দগ্ধরা কোথায় যেতো, যদি এই হাসপাতাল না থাকতো? আমি তরুণ চিকিৎসকদের বলি, চিকিৎসকরা উপরওয়ালার আর্শীবাদ নিয়ে জন্ম নেয়। তারা টাকাও রোজগার করতে পারে, মানুষের ভালোবাসাও পায়।

আমি একসময় গ্রামে যেতাম দরিদ্র পরিবারের ঠোঁটকাটা রোগীদের অপারেশন করতে। কালীগঞ্জে একটা মেয়ের অপারেশন করলাম,সেই কালীগঞ্জেই যাই পাঁচ বছর পরে। ওই মেয়ে খবর পেয়ে তার স্বামীকে নিয়ে এসে আমার পায়ে ধরে সালাম করে বলে, ‘স্যার ভগবানকে দেখিনি, আপনাকে দেখলাম।’ আমাকে যদি কেউ ১০ কোটি টাকাও দেয় এই মেয়ের কথার সঙ্গে সেটা কিছুই না। এই সম্মান, দোয়া ক’জনের ভাগ্যে জোটে?

গত বছর হরতাল-অবরোধের সময় যে নৃশংস ঘটনা ঘটলো, সেসময় যারা ভিক্টিম ছিল তারা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। তারা দিন আনে দিন খায়। তখন একটা সিএনজি অটোরিকশার ড্রাইভারের চিকিৎসা করেছিলাম। একদিন গাড়ি সঙ্গে না থাকায় সিএনজি নিয়ে বাসায় গেলাম। বাসায় গিয়ে নেমে টাকা দেওয়ার সময় সিএনজিওয়ালা টাকা নেয় না। বলে, আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছিলেন,আমি আপনার থেকে পয়সা নেব না।

বাড়াতে হবে প্রচার

বার্ন ইউনিটগুলো নিয়ে প্রচার বাড়াতে হবে। কারণ, বার্ন ইউনিট বলতেই মানুষ ঢাকা মেডিক্যালটা বোঝে। ঢাকাতেই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে, মিটফোর্ড হাসপাতালে, কুর্মিটোলা হাসপাতালে এবং মুগদা হাসপাতালে বার্ন ইউনিট রয়েছে। অথচ এগুলোর প্রচার নেই। এমনকি ঢাকার বাইরেও রয়েছে সেটাও মানুষ জানে না। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল হাসপাতালে, রংপুর মেডিক্যালে, সিলেট মেডিক্যালে এবং কুমিল্লাতেও ভালো বার্ন ইউনিট রয়েছে। এখান এটাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। আর তার জন্য শুধু আমাদের নয়, মিডিয়ারও প্রচুর ভূমিকা রয়েছে।

গরিবের চিকিৎসাই তার স্বপ্ন

আমি এমন একটি হাসপাতাল দেখতে চাই বাংলাদেশে যেখানে সাধারণ ও গরিব মানুষের চিকিৎসা হবে। এখন ইনস্টিটিউট করছি। এরপর সচেতনামূলক প্রকল্প বাড়াতে হবে, কারণ পুড়ে যাওয়া একটি প্রিভেনটিভ ইস্যু।

গণমাধ্যমের প্রতি

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে পরে রাজনৈতিক সহিংসতায় বার্ন ইউনিটে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তখন গণমাধ্যমের বিভিন্ন ক্যামেরাপারসনরা রোগীদের ছবি তুলেছেন কোনও অনুমতি না নিয়ে। যখন তখন ঢুকে পড়েছেন এই ইউনিটের বিভিন্ন ওর্য়াডে। যেটা পৃথিবীর কোনও হাসপাতালে দেখা যায় না। নতুন ইনস্টিটিউটে এবার এজন্য একটি মিডিয়া সেন্টার করার পরিকল্পনা রয়েছে। কারণ, একজন রোগী তার চিকিৎসকের কাছে যতটা সাবলীল একজন ফটোগ্রাফারের কাছে ততটা নয়।

কষ্টের কথা

শুরুতে বার্ন ইউনিট প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্নজনের কাছে গিয়েছি, তখন অনেকেই ফাইল ছুঁড়ে ফেলেছে। বলেছেন বার্ন ইউনিটের কোনও দরকার নেই। অনেক অপমান গঞ্জনা সহ্য করেছি। কেউবা আবার আরও কয়েকধাপ এগিয়ে বলেছেন, ইউনিট প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হলে সেই টাকা দিয়ে ভারতে জমি কিনবেন,বাড়ি বানাবেন।

অথচ যারা তখন ফাইল ছুঁড়ে দিয়েছিল তারাই এখন খুব প্রশংসা করেন ইউনিট দেখে। বিশেষ করে যখন নিমতলী ট্র্যাজেডি হলো তখন সবাই অনুভব করেছেন, এই বার্ন ইউনিট না থাকলে কী অবস্থা হতো আমাদের। আর ভারতে বাড়ি! বাংলাদেশ আমার দেশ, এই দেশ ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।



মন্তব্য চালু নেই