স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায় কিশোর জঙ্গিরা

ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যার মধ্যদিয়ে দুই কিশোর জঙ্গি বুঝতে সক্ষম হয়েছে। ওই দুই কিশোর জঙ্গি বলেন, জঙ্গিবাদেও জড়িত থাকার অভিযোগ থেকে মুক্তি পেলে আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চাই। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া রাকিবুল হাসান রিগ্যান (২০) ও তাহরীম কাদেরী (১৪) জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পেয়েছেন কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের কর্মকর্তারা।
সিটিটিসি ইউনিটের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান বলেন, কম বয়সী জঙ্গিরা ভুল বুঝতে পারছে। তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছে। এটা খুবই ভালো দিক। কল্যাণপুর থেকে গ্রেপ্তার রিগ্যান তার জবানবন্দিতেও এ কথা বলেছেন।

এদিকে, তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সঠিক ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি পুনর্বাসনের কার্যক্রম নেওয়া হলে কোমলমতিদের বিপথ থেকে ফেরানো সম্ভব ।

গত ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযানে ৯ জঙ্গি নিহত হয়। সেখান থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক করা হয় রিগ্যানকে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠা রিগ্যানকে আদালতের নির্দেশে দুই দফায় ১৩ দিনের রিমান্ডে নেয় সিটিটিসি ইউনিট। গত ১৮ সেপ্টেম্বর সে ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

জবানবন্দিতে রিগ্যান জানিয়েছে, তার সাংগঠনিক নাম রাফিউল ইসলাম রাফি ওরফে রিগান ওরফে রিপন ওরফে হাসান। গ্রামের বাড়ি বগুড়া সদরের জামিলনগর তালতলায়। ২০১১ সালের শেষের দিকে জামিলনগরের বাসায় স্থানীয় শিবিরকর্মী রাজু, তানজিল, রেজ্জাকদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সে (রিগ্যান) জামিলনগর এলাকার করতোয়া মাল্টিমিডিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজে এসএসসি পর্যন্ত পড়েছে। ২০১৩ সালে এসএসসি পাস করে। ২০১৫ সালে বগুড়ার বনানী এলাকার শাহ সুলতান কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর বগুড়া রেটিনা মেডিক্যাল কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়। পরীক্ষার আগে ফেসবুকে সাব্বির নামের একজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সাব্বির তার সঙ্গে ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে চ্যাট (ফেসবুকে বার্তা আদান-প্রদান) করত। নানারকম জিহাদি লেকচারের লিংকও দিত।

এমতাবস্থায়, গত বছরের ২৩ জুলাই কাউকে না জানিয়ে বাসা থেকে বের হয় সে (রিগ্যান)। এরপর শিবগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে সাব্বিরের সঙ্গে দেখা করে। তার সঙ্গে মাসুদ ও শিহাব নামে আরো দুই বন্ধু ছিল। সাব্বির তাকে বলেছিল, আমরা সিরিয়ায় যাব। সেখানে আমেরিকা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মুসলিমদের রক্ষা করব। সাব্বির তাদের তিনজনকে বাসে করে ঢাকায় নিয়ে যায়। ঢাকায় তিনবার স্থান পরিবর্তন করে তারা। রবিন নামের এক বড় ভাই তাদের খাবার ও দেখাশোনা করত।

জবানবন্দিতে রিগ্যান আরো জানায়, গত ১২ জুলাই সে ও ঢাকায় তার সঙ্গে থাকা অন্য সঙ্গীদের সবাই পর্যায়ক্রমে কল্যাণপুরের জাহাজ বিল্ডিংয়ের পঞ্চম তলা ফ্ল্যাটে যায়। সেখানে তারা ১১ জন ছিল। বিভিন্ন বাসায় অবস্থানকালে রবিন তাদের ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে ক্লাস নিত। পাশাপাশি অস্ত্র চালনা, অস্ত্র কিভাবে ধরতে হয়, কিভাবে গুলি করতে হয়, কিভাবে ম্যাগাজিন খুলতে ও লাগাতে হয়, কিভাবে গুলি ম্যাগাজিনে ঢোকানো হয় সেটা শেখাত।

অস্ত্রের ক্লাসে রবিন একে-২২ রাইফেল দেখাত। রবিন বলত, আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নির্যাতিত মুসলিমদের রক্ষা করতে হবে। সিরিয়ায় যুদ্ধ শেষ করতে পারলে প্রয়োজন হলে ফিলিস্তিান বা অন্য জায়গায় যোগ দিতে হবে। এটাই তাদের বড় ভাইদের নির্দেশ।

সিটিটিসি সূত্র জানা যায়, জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তারা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটসহ ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়ে রিগ্যানের সঙ্গে কথা বলে। একপর্যায়ে সে তার ভুল বুঝতে পারে। তখন সে আদালতে জবানবন্দি দিতে রাজি হয়। সে জানায়, ধর্মের কিছু বিষয়ে মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে তরুণদের উগ্রপন্থায় ঠেলে দিচ্ছে জঙ্গিরা। ভুল বুঝতে পেরে রিগ্যান জঙ্গিবাদ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আগ্রহ প্রকাশ করে।
গত ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের সময় তিন শিশু-কিশোরকে আটক করে পুলিশ। তাদের মধ্যে একজন তাহরীম কাদেরী রাসেল। তার বাবা তানভীর কাদেরী ওরফে আব্দুল করিম ওই অভিযানের সময় আত্মহত্যা করেন। রাসেলের মা অভিযানের সময় দুই নারীর সঙ্গে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তারের পরে গত ১৮ সেপ্টেম্বর আদালত রাসেলকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠান।

জানা যায়, জিজ্ঞাসাবাদের সময় সিটিটিসি ইউনিটের কর্মকর্তারা ধৈর্যসহকারে তাকে বোঝান। একপর্যায় একজন আলেমের সঙ্গে তাকে দীর্ঘ সময় কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। এর পরই তার ভুল ভাঙ্গেতে শুরু করে। সে স্বীকার করে, তার যমজ ভাই জঙ্গিদের দলে ভিড়ে গেছে। রাসেল বুঝতে পারে বাংলাদেশে জঙ্গিপনা ঠিক নয়। তখন সে আদালতে জবানবন্দি দিতে রাজি হয়। সে পুলিশকে জানায়, অভিযোগ থেকে মুক্ত হলে সে লেখাপড়া করবে। বড় হয়ে চাকরি করে মাকে নিয়ে থাকবে।

সিটিটিসি ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, কম বয়সে বাচ্চাদের মগজ ধোলাই করে জঙ্গি বানানো হচ্ছে। যথাযথ ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানো হলে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারছে। তাদের সঠিক শিক্ষা দিয়ে পুনর্বসান করা সম্ভব। কারাগারে বা কিশোর সংশোধনাগারে এ ধরনের কাউন্সিলর ও ধর্মীয় শিক্ষক থাকলে ভালো হতো।খবর কালের কণ্ঠ’র।



মন্তব্য চালু নেই