স্বাভাবিক জীবনে কি ফেরা হবে তাঁদের?
রাজধানীর আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের সময় আত্মসমর্পণকারী দুই নারী জঙ্গি জেবুন্নাহার শিলা ও তৃষা মণি এখন অনুতপ্ত। তাঁরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। মঙ্গলবার প্রথম আলোর প্রথম পাতায় এ খবর ছাপা হয়েছে। এই তথ্য খুবই আশাপ্রদ। নিজেদের কর্মকাণ্ডে অনুতপ্ত হয়ে যদি কেউ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়, তাকে অবশ্যই স্বাগত জানানো উচিত।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁরা কি আদৌ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন? এই প্রশ্ন তোলার কারণ হচ্ছে আমাদের সামাজিক অবস্থা। এই সমাজে একবার কারও গায়ে যখন কোনো তকমা এঁটে যায়, তা মুছে ফেলা খুবই কঠিন। সবাই তার সেই পরিচয়টাই মনে রাখে। যেমন কোনো নারী যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন তাঁর ধর্ষণের শিকার পরিচয়টাই বড় হয়ে ওঠে। সমাজ ধর্ষণের শিকার ওই নারীকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয় না। নিজ পরিবারেও তিনি নিগ্রহের শিকার হন। তাঁর সঙ্গে করা আচরণগুলো স্বাভাবিক থাকে না। প্রতি পদে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তুমি ধর্ষণের শিকার। তোমার শরীর অপবিত্র হয়ে গেছে। স্কুল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। যেমন বহিষ্কার করা হয়েছিল সিলেটের বাহুবল উপজেলার সপ্তম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীকে। গত ডিসেম্বরে এ ঘটনা ঘটে। অতএব, চাইলেও স্বাভাবিক জীবনে আর ফেরা হয়ে ওঠে না ধর্ষণের শিকার কোনো নারীর।
আমাদের সমাজে কোনো তালাকপ্রাপ্ত নারীকে মেনে নেওয়া হয় না। তালাকের জন্য নারীটিকেই দায়ী করা হয়। কোনো দোষ না থাকলে কি আর স্বামী তালাক দেন? ভ্রষ্টা উপাধি জোটে তাঁর। আর কোনো মেয়ে যদি স্বামীকে তালাক দেন, তাতে তো আরও নয়। তিনি তো বিরাট ভ্রষ্টা।
আমাদের সমাজে জেলফেরত কোনো নারীকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া হয় না। অনেকেরই ঠাঁই মেলে না পরিবারে। ঠাঁই মিললেও আগের সেই স্বাভাবিক জীবন আর তিনি ফিরে পান না। কেমন চোখে যেন তাঁকে দেখা হয়। সবাই তাঁকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে। আর উত্ত্যক্তের শিকার মেয়েটিকেও দেখা হয় ‘বাজে মেয়ে’ হিসেবে। ‘বাজে মেয়ে’ বলেই তো তাঁকে ছেলেরা উত্ত্যক্ত করে। যেমনটি ‘বাজে’ ছিলেন নারায়ণগঞ্জের চারুকলার ছাত্রী সিমি। পাড়ার বখাটে যুবকেরা তাঁকে খারাপ মেয়ে উপাধি দিয়েছিল। তাঁর বিচার করতে চেয়েছিল। তাই তো সিমি আত্মহননের পথ বেছে নেন।
এ-ই যখন সমাজের চেহারা, তখন ওই দুই নারী জঙ্গি আদৌ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কি না, সে সংশয় থেকেই যায়। খুব সহজ হবে না তাঁদের ফেরাটা। জঙ্গি তকমা তো তাঁদের পাওয়া হয়ে গেছে। এই জীবনে এ তকমা কি মোছা সম্ভব হবে? কারণ, সমাজ তো তাঁদের প্রতি পদে মনে করিয়ে দেবে, তোমরা একদিন জঙ্গি ছিলে।
নারীদের তুলনায় পুরুষদের পক্ষে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা অনেক সহজ। নিজ এলাকায় পুনর্বাসিত হতে না পারলেও অন্য এলাকায় গিয়ে তাঁরা কাজ খুঁজে নিয়ে স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে পারেন। কিন্তু নারীদের জন্য এটা একটি কঠিন কাজ। সমাজ বা পরিবার মেনে না নিলে তাঁরা কঠিন বিপদে পড়েন। কোথাও যাওয়ার জায়গা না পেয়ে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টাতে হবে। রাষ্ট্রকেও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। এ ধরনের নারীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা সরকার করতে পারে। তাঁরা যাতে আত্মনির্ভরশীল হন, সে জন্য তাঁদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। নিগ্রহ বা নির্যাতনের শিকার নারী যাতে ‘স্বাভাবিক’ জীবনে ফিরতে পারেন, সেই সুযোগ যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি যে নারীরা পরিবেশ বা পরিস্থিতির কারণে নানা অপরাধ বা শিলা ও তৃষা মণির মতো জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছেন, তাঁরাও যেন আইনি প্রক্রিয়া, বিচার বা শাস্তি শেষে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। নারী বা পুরুষ সবার জন্যই ‘স্বাভাবিক’ জীবনে ফেরার সুযোগ সৃষ্টির দায়িত্ব আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের।
-রোকেয়া রহমান : সাংবাদিক।
মন্তব্য চালু নেই