স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও পরিবর্তন হয়নি পর্যটন শিল্প
সারা বছর কম-বেশি মানুষেরা দেশ-বিদেশ ভ্রমন করে। তেমনি ঈদের ছুটিতে ঘুরতে গিয়ে গত ২২ জুলাই জাফলংয়ের পিয়াইন নদীর বল্লা ঘাটের জিরো পয়েন্টে সাঁতার কাটতে নেমে ২ কলেজ ছাত্র নিখোঁজ হয়। মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে তাদের বন্ধুরা জানিয়েছেন, তারা সাঁতার জানতেন না। স্রোতের টানে তারা তলিয়ে যাবে, প্রাণ হারাবে, আর কেউ দায়িত্ব পালন করবে না এটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। এমন ঘটনা বছরে বহুবার ঘটছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, গত এক যুগে প্রায় অর্ধশত পর্যটক সাঁতার কাটতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, কেউ নিখোজ হিসেবেই পুলিশের খাতায় ডায়রীভুক্ত হয়েছেন। তবে এসব ঘটনা পর্যটন শিল্পকে অনেকাংশে পিছিয়ে দেয়।
নেপাল ছোট একটি দেশ হলেও সেখানে পর্যটকের সংখ্যা বেড়েই চলছে। অথচ পর্যটন দেশ ও এলাকা হিসেবে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। কিন্তু আমাদের দেশে যে সব দর্শনীয় স্থান রয়েছে, সে সব স্থানের পরিচিতি যদি যথাযথ ভাবে প্রচার করা হয় না। বিশেষ করে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সৈকত, ফয়েজ লেক, পৃথিবীর দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা, ঝুলন্ত সেতু, কাপ্তাই লেক, শুভলং ঝর্ণা, নেভি ক্যাম্প, পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, জাতীয় উদ্যান, চাকমা রাজবাড়ি, খুলনার সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, নওগাঁর সোমপুর বিহার বা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, বাঘা মসজিদ, মহাস্থানগড়, রংপুরের রামসাগর, সিলেটের জাফলং ও চা বাগান, কুমিল্লার ময়নামতি, বান্দরবানের নাফাখুম ও অমিয়খুম জলপ্রপাত এবং মাধবকুন্ড জলপ্রপাতসহ বিভিন্ন প্রতœতাত্বিক নিদর্শন, ঐতিহাসিক মসজিদ, পাহাড়, অরণ্য, ঝর্ণা, লেক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
গোটা বিশ্বে ২০০০ সাল পর্যন্ত পর্যটন শিল্পে স্বাভাবিক গতিধারা বজায় ছিল। পরবর্তীকালে ইরাক যুদ্ধ, ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামগ্রীকভাবে অর্থনৈতিক মন্দাভাব পরিলক্ষিত হওয়ায় পর্যটন শিল্প ছিল হুমকীর মুখে। এসব সমস্যার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে যথাশীঘ্র উন্নয়নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কেননা, দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় বলা যায়। দেশি-বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে উল্লেখযোগ্য কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয় না। অথচ পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে সৃজনশীল পরিকল্পনাগ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন সময়ের দাবী। গোটা বিশ্বে পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে থাকা ব্যাংকক, কুয়ালালামপুর, সিউল, সিঙ্গাপুর, হংকং, লন্ডন, প্যারিস, দুবাই, ই¯তাম্বুল ও নিউইয়র্ক এই ১০ টি রাজধানী শহর থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা নেয়া উচিত।
পৃথিবীর সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি ১১ জনের মধ্যে গড়ে ১ জন বর্তমানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পর্যটন পেশার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা জানা গেলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সে হিসেব মিলছে না। চলতি বছরের ০৩ মে দৈনিক যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা ১৭ ধরণের প্রতিবন্ধকতায় আটকে আছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাবে এসব প্রতিবন্ধকতা দূর হচ্ছে না। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পর্যটন খাতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান ২০১৩ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৬ হাজার ৩০ কোটি টাকা, যা জিডিপির হিসাবে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৪ সালে এ খাতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ।” অপরদিকে বিশ্ব ভ্রমণ ও পর্যটন কাউন্সিলের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ‘২০১৩ সালে জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের অবদান সিঙ্গাপুরে ৭৫ শতাংশ, তাইওয়ান, হংকং, ফিলিফিন্সে ৫০ শতাংশের বেশি আর মালদ্বীপের অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই আসে পর্যটন খাত থেকে, আর সেখানে প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান মাত্র ২ দশমিক ১০ শতাংশ। ’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতিবছর বাংলাদেশ ভ্রমণে আসেন গড়ে মাত্র ৯ লাখ পর্যটক আর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ভ্রমণে যান ১৫ লাখ। একজন বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে ৬ দিন অবস্থান করেন। ওই ছয় দিনে ওই পর্যটক কমপক্ষে ৯১ হাজার ২১০ টাকা খরচ করেন। আরো ১০ লাখ পর্যটক আনতে পারলে এ খাত থেকে সম্ভাব্য আয় বাড়বে ৯ হাজার ১২১ কোটি টাকা।
ডব্লিউটিটিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৪ সালে পর্যটন শিল্পে সরাসরি কর্মরত ছিল ৯ লাখ ৩ হাজার ৫০০ জন; যা মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের অবদানের হিসাবে বিশ্বের ১৮৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬৮ তম। বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালকে পর্যটন বছর ঘোষণা করলেও এ খাতে তেমন কার্যকরী পদক্ষেপ শুরু হয়নি। গত বছর এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে পর্যটক আগমনে প্রবৃদ্ধি আসে ৬ শতাংশ। পর্যটক আসে ২৪৮ মিলিয়ন যা আগের বছরের চেয়ে ১৪ মিলিয়ন বেশি। পর্যটকরা এশিয়ামুখী হলেও বাংলাদেশের দ্বার উন্মুক্ত হচ্ছে না। পর্যটকরা পর্যটন এলাকায় তাদের ভ্রমণকে নিরাপদ মনে করছেন না। তাই পর্যটকদের মধ্যে আস্থা অর্জন করতে পারাই এখন বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ।
বিশ্বের বৃহত্তম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের দৈর্ঘ ১২০ কিলোমিটার হলেও ৪৩ বছর ধরে ব্যবহার হচ্ছে মাত্র কয়েক কিলোমিটার। পর্যটকদেরকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তোলে-সর্বত্র নিরাপত্তার অভাব। ভ্রমনে গিয়ে ছিনতাই ও ডাকাতের কবলে পড়েন নি এমন লোকের সংখ্যা হয়তো নগন্য। অধিকাংশ পর্যটন এলাকায় ভিক্ষুকদের বাড়াবাড়ি, হকারদের জুলুম, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, মাদকদ্রব্যে সয়লাব, মাদকাক্তদের আড্ডাসহ সকল অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর যারা ঢাকায় থাকে তাদের অনেকেই আহসান মঞ্জিলকেও দেখতে যায় না। কারণ আহসান মঞ্জিল এমন একটি স্থানে রয়েছে যেখানে পর্যটকরা যেে পারছে না। এটি ঢাকা শহরের অধিক নোংড়া স্থানগুলোর একটি। সদরঘাট থেকে বাদামতলী পর্যন্ত গোটা এলাকা ফল ব্যবসায়ীদের দখলে নেয়। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের একজন এমপির অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কারণে আহসান মঞ্জিলে প্রবেশের সকল রাস্তা বন্ধ থাকে বিধায় দর্শনার্থীরা আগ্রহ হারীয়ে ফেলছে। এছাড়া রাস্তার উপরে মল-মূত্র ত্যাগ করাসহ নষ্ট ফল ও নানা ধরণের কাঁচামালের কারণে নোংড়া হয়ে থাকে, র্দূগন্ধে ওই এলাকতে যাওয়া যায় না। ওইসব রাস্তায় পাবলিক যান চলছেনা, এমনকি প্রায়শই এমন অবস্থা হয়ে যে হাটার ব্যববস্থা থাকে না। নবাব বাড়ির সৌন্দর্য প্রতি নিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে সরকার বিপুল পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে। নগর পিতাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব জেনে-শুনেও চুপচাপ থাকছে। বুড়িগঙ্গা নদীকে সংস্কার করে দুই তীরের অবৈধ স্থাপনা স্থায়ীভাবে সরিয়ে ফেললে আহসান মঞ্জিলের সৌন্দর্য আবারো বাড়বে।
মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ পর্যটন শিল্পের দিক থেকে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর নেতারা এই শিল্পের প্রসারে কাজ করলেও আমাদেও দেশের রাজনৈতিক নেতাদের এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। দেশীয় স্বার্থের চেয়ে তাদের ব্যক্তি স্বার্থটাই বেশি, যে কারণে একটি পর্যটন বোর্ড গঠন করতেই কেটেছে দীর্ঘদিন। তাই কুয়াকাটা ও কক্সবাজারের মাস্টার প্লান বাস্তবায়ন হবে কি না তা নিয়ে আশংকা দেখা দিয়েছে। স্বাধীনতার পরে দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও এ শিল্পের পরিবর্তন হয়নি। সঠিক নেতৃত্ব ও পরিকল্পনার অভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে দেশ। অধিকাংশ নেতারা নির্বাচনে অংশ নেয় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ও মোটা অংকের টাকা অর্জন করতে। দেশের কল্যাণে কথা বলা ও কাজ করার মানুষ খুবই কম। আমাদের দেশে যতদিন দলীয়করণ ও আত্মীয়করণ থাকবে ততদিনে হয়তো কোন কাজের মান ভাল হবে না। একটি কাজ করতে গেলে যা বরাদ্দ হয় তার দুই তৃতীয়াংশই আত্মসাৎ করা হয়, ফলে কোন কাজের মান ভাল হয় না। পর্যটন শিল্পকে কার্যত গুরুত্ব দেয়া হয় না বলে পর্যটকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেরছে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে হলে সড়ক, রেল, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, বিদ্যুৎ, পূর্ত, সংস্কৃতি, অর্থমন্ত্রণালয় সহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পর্যটন খাতকে ঘিরে যে সমস্যাবলী ইতোমধ্যে আলোচিত হয়েছে সে সব সমস্যার সমাধান করত: পর্যটন খাতকে আধুনিকায়ন করা গেলে জিডিপিতে গার্মেন্টস শিল্পকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। অর্থনৈতিকভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে সরকার যে সব খাতকে প্রধান্য দিয়ে থাকে তার মধ্যে পর্যটন খাত না থাকাও নেতিবাচক একটি দিক।
সর্বোপরি বলা যায়, এ খাতে বাজেট কম থাকে, পর্যটন কেন্দ্রকে রক্ষণাবেক্ষণে নাম মাত্র উদ্যোগ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, পর্যটন এলাকাসমূহের পরিচয় জনগণকে ব্যাপকভাবে না জানানো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, অনুন্নত যাতায়াত ও আবাসন ব্যবস্থা, দূর্ঘটনা রোধ কল্পে আন্তরীক হওয়া, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোড়দার, সেবামূলক মনোভাব, হাইজ্যাক ও ছিনতাই বন্ধকরণ, গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হলে আশা করা যায় দেশ তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছতে পারবে। তাছাড়া, দুর্বল অবকাঠামো, অকার্যকর বিপণন কৌশল, আহার ও বিনোদন কর্মকান্ডে আন্তর্জাতিকমানের সুবিধা বাংলাদেশে নেই। বিশেষকরে, পর্যটকদের পরিবহনের জন্য উন্নতমানের ট্যুরিস্ট বাস, কোচ, ট্রেন সার্ভিস সুবিধা নেই। এছাড়া অধিকাংশ পর্যটন এলাকায় ভ্রমনের জন্য অ্যাপ্রোচ রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট ও বিদ্যুতের অভাব রয়েছে। দর্শনীয় স্থান সমূহের প্রচার ও প্রসারে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, স্থানীয়ভাবে পর্যটকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার, ফেরিওয়ালাদের জোর জবরদস্তি, বিভিন্ন খাদ্য ও পণ্য দ্রব্যের চড়া মূল্য, থাকার জন্য ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে পর্যটকরা তেমন আগ্রহী নন। এ সকল সমস্যার সমাধার যত তাড়াতাড়ি করা যাবে আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে ততবেশি সমৃদ্ধ হবে।
লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মন্তব্য চালু নেই