সৌভাগ্যবান ‘দুলাভাই’র ঘরে-বাইরে চ্যালেঞ্জ
নিবন্ধের শিরোনামে ‘দুলাভাই’ শব্দটি পড়ে পাঠকরা হয়তো কিছুটা হতচকিত হতে পারেন। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ‘উনি’ আবার কীভাবে আমার দুলাভাই হন। উনার সাথে কি আমার কোনো বোনের বিয়ে হয়েছে? হ্যাঁ, এমনটিই হয়েছে।তাই বিষয়টি প্রথমেই একটু খোলাসা করে নেয়া যাক। সেই ১৯৮৬ সালের কথা। সবেমাত্র প্রাইমারী শিক্ষা শেষ করে সেকেন্ডারী স্কুলে ভর্তি হয়েছি। আমার বয়স মাত্র ১০-১১, রাজনীতি-দলাদলি তেমন কিছু বুঝি না। এরই মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে । লাঙ্গল আর এরশাদের নামে স্লোগানে পাড়ামহল্লা সরগরম। আমাদের ইউনিয়নে অন্তত ৫-৬টি লাঙ্গলের নির্বাচনী ক্যাম্প তৈরি হয়েছিল।
যতদূর মনে পড়ে সেসময় ত্রিশাল থেকে জাতীয়পার্টির মনোনয়ন পেয়েছিলেন আনিসুর রহমান মানিক। তাঁর বাড়ী আমাদের বাড়ি থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে কানিহারি ইউনিয়নে। আমাদের প্রতিবেশী এক মেম্বার সম্পর্কে আমার মামা, তার পিড়াপিড়িতে আমরা মিছিল নিয়ে মাঝেমধ্যেই কানিহারি এমপি প্রার্থীর বাড়িতে যেতাম। আমাদেরকে আপ্যায়ন করা হতো চা-বিস্কুট অথবা ‘খিড়’ (পায়েশ) দিয়ে। সেই চা আবার এখনকার মতো নয়, একটু ভিন্ন প্রকৃতির, বিশাল বড় ড্রামের ভেতরে এক প্যাকেট চা, কয়েক শের গুড় আর তেজপাতা ছেড়ে দিয়ে গরম করা হতো। আর সেটাই আমরা খুব মজা করে পান করতাম। অবশ্য একটু বড় হলে বুঝতে পারি ওই মামা মিছিলে নেয়ার জন্য কেন এতো পিড়াপিড়ি করতেন এবং আমরা কার পক্ষে মিছিল করেছিলাম। ছোটকালের সেই ভুলটি আজও আমাকে মনে পীড়া দেয়, হয়তো আজীবনই দেবে!
মনে আছে নির্বাচনী ক্যাম্পেইন শেষে বাড়ি ফিরতে বেশী রাত হলে বাবা-মা বকাবকি করতেন, এরপরও কোনো কিছু না বুঝে এলাকার সহপাঠীদের সাথে লাঙ্গলের নির্বাচনী মিছিলে যেতাম। আর যখন নির্বাচনী প্রচারণায় যেতাম সবাই এরশাদকে দুলাভাই বলে সম্বোধন করতেন। এমন কী মিছিলেও ‘দুলাভাই ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই, বলে স্লোগান দেয়া হতো। এর অন্যতম কারণ হলো- রওশন এরশাদের বাড়ি ময়মনসিংহ সদরের সুতিয়াখালি এলাকায়। আমাদের বাড়ি থেকে ১০-১২ মাইল দূরে। তাই সবাই এরশাদকে দুলাভাই হিসেবেই সম্বোধন করতেন। আমার জানা মতে, তিনি নিজেও এটাকে বেশ এনজয় করতেন।ফলে ময়মনসিংহ-ত্রিশালের সর্বত্রই ‘গণদুলাভাই’ হিসেবেই তাঁর একটা ব্যাপক পরিচিতি ছিল।
এছাড়াও পরবর্তীতে এরশাদ যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুবকর স্যারের মেয়ে আমাদের অগ্রজ বড় আপা বিদিশাকে বিয়ে করেন সে হিসেবেও তিনি আমাদের দুলাভাই। গবেষণাকালীন তিনি রাজশাহী গেলে সার্কিট হাউজে তাঁর সাথে দেখা হতো, সেখানেও তাকে দুলাভাই বলেই সম্বোধন করেছি।এছাড়াও দুলাভাইয়ের বহুল আলোচিত সাবেক প্রেমিকা সাবেক এমপি জিন্নাতও আমাদের ময়মসিংহেরই মেয়ে। ফলে সেই সুবাদে আজকের কলামেও দুলাভাই বলে সম্বোধন করাটা আমার জন্য অযৌক্তিক হয়েছে বলে মনে করছি না। থাক এসব কথা। এবার ফিরে আসি আজকের মূল আলোচ্য বিষয়ের দিকে।
এরশাদকে ‘সৌভাগ্যবান দুলাভাই’ এজন্য বলেছি যে, তিনি এমনই একজন ব্যক্তি যে তার তুলনায় পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর কাউকে খুজে পাওয়া দুষ্কর। কেননা, আমাদের রওশন আপাকে পাশে রেখেই এ জীবনে অনেক নারীর প্রেমে পড়েছেন, হয়েছেন নতুন নতুন আপার জীবন সঙ্গী, কিন্তু বিশাল উদার হৃদয়ের অধিকারী বড় আপা (রওশন) কখনো তাকে ছেড়ে যাননি, পড়ন্ত বেলাও পাশে আছেন। যদিও বর্তমানে রাজনীতির মারপ্যাচে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে তাদের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব তথা ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়া দুনিয়ার কোন সেনাশাসকই ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার পর রাজনীতিতে টিকে থাকতে পেরেছে এমন নজির বিরল। এক্ষেত্রে দুলাভাই এরশাদই সৌভাগ্যবান। মূলধারার রাজনীতিতে তিনি এখনও দাপুটে। জনসমাবেশ, বক্তৃতা, বিবৃতি নিজ দল ও জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব প্রধান, নিঃসংকোচে সর্বত্র বিচরণ, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, সবই করেছেন। মিডিয়াতেও উপেক্ষিত থাকেননি কখনো, এখনও নয়। এমন কী তিনি বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতও হয়েছেন। তার দল হয়েছে প্রধান বিরোধীদল।সহধর্মিনী রওশন এরশাদ হয়েছেন বিরোধী দলীয় নেত্রী।শুধু তাই নয়, বিরোধী দল হওয়া সত্ত্বেও সরকারের মন্ত্রীসভারও সদস্য হয়েছেন তার দলের কয়েকজন নেতা। কী সৌভাগ্য! সরকারের সাথে বিরোধী দলের কী মধুর সম্পর্ক! কী অভিনব সংসদীয় গণতন্ত্র!
অবশ্য বঙ্গবীর কাদের সিদ্দকীর ভাষায়, ‘এরশাদ শুধু রাজনীতিতেই টিকে নেই, যিনি জেলে বসেই দ্বিতীয়বারের মতো ৫টি আসনে জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু যা কপালে জোটেনি পাকিস্তানের আইয়ূব খান, ইয়াহিয়া খান, ইস্কান্দার মির্জা, জিয়াউল হক, পারভেজ মোশাররফ কিংবা আমাদের জিয়াউর রহমানেরও। অবশ্য জিয়াউর রহমান নির্বাচনে অংশ নেননি। নিলে জিততে পারতেন কি না, জানি না।’ যদিও বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী অতি সম্প্রতি এরশাদের লিঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ‘এরশাদ পুরুষ না মহিলা তা আমার বোধগম্য নয়’ সেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয় এ নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।
প্রসঙ্গত, ১৯৮২ সাল থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন এরশাদ। এরপর ক্ষমতা হস্তান্তরের পর শুরু হয় কারাবাস। ৯১’র নির্বাচনে জেলে বসেই নিজ জেলা রংপুরের সব কয়টি আসন পান। অন্য সেনা শাসকরা যা কল্পনাও করতে পারেন না। এমনকি ৯৬’র নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ৯৭’র ৯ জানুয়ারি জেল থেকে ছাড়া পান এরশাদ। তবে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হওয়ায় ২০০১ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়ার অধিকার হারান। জনঅসন্তোষে সব সেনাশাসকের পরিণতি হয়েছে কল্পনার চেয়েও ভয়াবহ। ব্যতিক্রম শুধু এরশাদ। একনায়কতন্ত্রের রাজদরবার- ছাড়ার পরও মূলধারার রাজনীতিতে এখনও সক্রিয়। এখনও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। বিশ্বের অন্য স্বৈরশাসকেরা কি তা কখনো ভাবতে পারেন?
আমরা জানি, পাকিস্তানের আইয়ূব খানেরও পতন হয়েছিল নির্মমভাবে। পরে আর রাজনীতিতে ঠিকে থাকতে পারেনি। ইয়াহিয়ারও পতন হয়েছিল একইভাবে। বেকায়দায় পড়তে হয়েছে মরক্কোর সম্রাট হাসান দ্বিতীয়, ফিলিপাইনের ফার্দিনান্দ মার্কোস, নাইজেরিয়ার জেনারেল সানির মতো আরও অনেককে। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা তো দূরের কথা প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয়েছে যুগোসস্নাভিয়ার মহাশক্তিধর মার্শাল টিটো কিংবা লিবিয়ার কর্নেল গাদ্দাফিকে। সর্বশেষ মিসরের সামরিক শাসক হোসনি মোবারকের করুণ পরিণতির কথা তো আমাদের সবারই জানা। সেদিক থেকে এরশাদই একমাত্র ব্যতিক্রম ও সৌভাগ্যবান, যিনি রাজনীতিতে শুধু টিকেই থাকেননি। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ক্ষেত্রে নাটের গুরু হিসেবেও ভুমিকা রেখে চলেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তার সেই রাজনৈতিক জৌলুসে কিছুটা ভাটা পড়েছে।
পড়েছেন দলের ভিতরে ও বাইরে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। বলা যায়- দলের নিয়ন্ত্রণও অনেকটাই চলে গেছে আমাদের রওশন আপার কাছে। দলের প্রভাবশালী নেতাদের মন্ত্রিত্ব ত্যাগ ইস্যু এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় চিপ হুইপ তাজুল ইসলামকে দলের শৃঙ্খখলা ভঙ্গের কারণে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ থেকে বহিস্কার করার ঘটনায় এরশাদকে এ চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়।
গেল বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন থেকে এ পর্যন্ত একের পর এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন দুলাভাই এরশাদ। নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার থেকে মন্ত্রীদের পদত্যাগের নির্দেশ দিলেও দলের কেউ সেদিন তার কথা শোনেননি। এর মধ্যেই হঠাৎ করে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু রওশনসহ শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের পাল্টা চ্যালেঞ্জের মুখে তাকে পিছু হটতে হয়। সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন না, এমন ঘোষণা থেকেও সরে আসতে হয় তাকে। বরং সবাইকে চমকে দিয়ে মন্ত্রীর মর্যাদায় নিজেই প্রধানমন্ত্রীর দূত হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
ওই সময় তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, যারা তার নির্দেশ না মেনে নির্বাচন করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, আর যারা তার কথা শুনেছেন তাদের মূল্যায়ন করা হবে। কিন্তু পরবর্তীকালে তার এ কথারও প্রতিফলন ঘটেনি। এরশাদ একাধিকবার সংসদ সদস্যদের ধমক দিয়ে তার অনুগত করার চেষ্টা করেছেন তাতেও ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। এভাবে দলের মহিলা এমপি, বিরোধী দলের চিফ হুইপ ও হুইপ নির্বাচনেও তার পছন্দের লোক নিয়োগ দিতে পারেননি। সর্বশেষ দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে বিরোধী দলের উপনেতা করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতা রওশন ও অধিকাংশ সংসদ সদস্যের বিরোধিতার মুখে তাতেও হোঁচট খেতে হয়েছে এরশাদকে।
ফলে বর্তমানে ঘরে-বাইরে সমালোচনার মুখে মন্ত্রিত্ব ছাড়ার বিষয়েও পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের মধ্যে রয়েছে মত পার্থক্য। দলীয় ফোরামে ও সভা-সমাবেশে মন্ত্রিত্ব ছাড়ার আগাম ঘোষণা দিলেও এরশাদের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না কোনো নেতা।বরং এ নিয়ে পার্টির তিনমন্ত্রী চেয়ারম্যানের ওপর চরম ক্ষুব্ধ। দলের চেয়ারম্যান এরশাদ ও বিরোধী দলীয় নেতা রওশন যাতে এমন সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন সেজন্য এ মুহূর্তে দুজনের মধ্যে দূরত্বও তৈরি করে রাখা হয়েছে। শীর্ষপর্যায়ের নেতা এবং এমপিদেরও গ্রুপিংয়ের মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। মন্ত্রীরা বলছেন, দলের প্রেসিডিয়াম কমিটির বৈঠকে ও সংসদীয় কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক মন্ত্রীদেরকে পদত্যাগের প্রস্তাব দিতে পারেন। এছাড়া এককভাবে কেউ মন্ত্রীদেরকে পদত্যাগ করার প্রস্তাব দিতে পারেন না। এছাড়া আপন ভাই গোলাম কাদেরের সাথেও চলছে এরশাদের মতবিরোধ। এমতাবস্থায় নিজে এবং নিজের গড়া দলও পড়েছে অস্তিত্বের চ্যালেঞ্জের মুখে।আগামী দিনে আরো অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে তার সামনে এমনটিই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখন দেখার বিষয় রাজনীতিতে জোকার বলে পরিচিত দুলাভাই এরশাদ এই পরিস্থিতি কতটা কৌশীলীভাবে মোকাবেলা করে আরেকটি নতুন চমক দেখাতে পারেন!
বয়স পঁচাশি পেরিয়ে ৮৬তে পা পড়েছে, এরপরও তিনি একজন জোকার রাজনীতিবিদ হিসেবে মাঠে বেশ ভালই খেলছেন। সকাল-বিকাল কথার শঠতার ফুলঝুড়িতে সর্বদায় আলোচিত থেকেছেন মিডিয়ায়। আর এসব কারণেই দুলাভাই এরশাদ আজ চরম ইমেজ সঙ্কটে। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে সর্বত্রই। ফলে আগামী দিনে তার ব্যক্তি ইমেজের পাশাপাশি দলীয় ইমেজও পুনরুদ্ধার করাই তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমানের এই ইমেজ সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে না পারলে ভবিষ্যতে যে তাকে এবং তার পার্টিকে কঠোর মাশুল দিতে হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তাকে সুবিধাভোগী ও সৌভাগ্যবান বলেছি এ কারণে যে, পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশে তার জন্ম হলে অসংখ্য অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে হত এবং চরম দন্ড তথা নিদেন পক্ষে আজীবন জেলের ঘানি টানতে হতে পারত। নব্বইয়ের গণঅভ্যূত্থানে পতিত হবার পরে বছর পাঁচেক জেল খাটা ছাড়া পরবর্তীকালে এরশাদ সবসময়ই কোন না কোন ফর্মে ছিলেন রাষ্টীয় ক্ষমতার অংশীদার, আর এখন তো প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত।
আর ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হওয়ার ঘটনায় ১৯৮৩ সাল থেকে দায়ী করে আসলেও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এরশাদকে বিচারের মুখোমুখি করাতে পারেননি। উল্টো তার ছেলে তারেক রহমান ‘এরশাদ চাচার’ সাথে ২০০৬ সালে দেখা ও বৈঠক করে একটি রাজনৈতিক আঁতাতের চেষ্টা করেছিলেন। জিয়া হত্যার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলাটিও এখন হিমাগারে।
১৯৮২ সালে এরশাদ ক্যুদেতা হিসেবে একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সদলবলে ক্ষমতাসীন হবার পরে রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র বদলে দেয়ার জন্য প্রায় সবকিছুই করেছেন। অসত্য আর শঠতার ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে দেশব্যাপী একটি টাউট প্রকৃতির রাজনৈতিক গোষ্ঠী গড়ে তুলেছেন। তার শাসনামলেই অনেক টাউট রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় রাতারাতি হয়েছে রাজনীতি-অর্থনীতির নিয়ামক। এর ফল সুদুরপ্রসারী- নীতিহীন রাজনীতির নামে একটি বিশেষ শ্রেণীকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার এরশাদীয় এই বিশেষ মডেলটি পরবর্তীকালে সকল শাসকরাই কাজে লাগিয়েছেন। ফলে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র বারবার পড়ছে হুমকির মুখে।
বিরোধিতা ও ভিন্নমত দমনে এরশাদ কতটা নিষ্ঠুর ও নির্মম ছিলেন সে বিষয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। তবে আমরা শুধু মনে করিয়ে দিতে পারি ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির কথা। রক্তস্নাত এই দিনটিকে কিছু সাধারণ মানুষ ও প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া আর সবাই ভুলে গেছেন। এরশাদের বিরুদ্ধে ঐদিন হাজার হাজার ছাত্র-জনতা সমবেত হয় আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায়। ছাত্রদের মিছিল শিক্ষাভবনের সামনে গেলে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় দিপালী সাহাসহ ৮ জন। আ’লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ দুই নারী নেত্রী গ্রেফতার হন। এভাবেই নয় বছরে আন্দোলন দমনের নামে এরশাদের নির্দেশে হত্যা করা হয় নাম না জানা অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে। ডাঃ মিলন, নুর হোসেন, ময়েজ উদ্দীনের হত্যাকারী হিসেবে অভিযুক্ত এরশাদকে ১৯৯০ সালে গণঅভ্যূত্থানে ক্ষমতাচ্যূত হয়েও বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি।
এর মূল কারণ হচ্ছে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি পরবর্তীকালে যে কোনো প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় টিকে থাকতে গিয়ে বার বার এরশাদেরই দ্বারস্থ হয়েছে। নিজেদের দলের ভেতরে তো নয়ই, শাসক হিসেবে সংসদে, রাষ্ট্র পরিচালনায়-কোথাও ন্যায্যতা ও নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়নি। ব্যাক্তি, পরিবার আর আত্মীয়তাকে প্রধান্য দেয়া হয়েছে সর্বস্তরে। সে হিসেবে আমার দুলাভাই এরশাদ সফল – তার অনৈতিক রাজনীতির দূষণ প্রধান রাজনৈতিক দল ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে আক্রান্ত করেছে পরম স্বার্থকতায়। ১৯৮৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী দল আওয়ামী লীগকে সাথে পেয়েছেন সামরিক শাসন থেকে তথাকথিত গণতন্ত্র যাত্রায়। আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সাংবিধানিক নিয়ম রক্ষার নির্বাচনে আ’লীগকে সঙ্গ দিয়েছেন পরম কৃতজ্ঞতায় নানান ভানুমতির খেল দেখিয়ে! ফলে বলা যায়- রাজনীতিতে নীতিহীনতাই তার আদর্শ।
প্রসঙ্গত, একটা সময়ে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া ছিলেন তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে তাদের ও দলকে করেছেন চরম নিপীড়ন। তারপরেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার লোভে এরশাদকে জোটে ধরে রাখতে বা জোটে পেতে দু’নেত্রীর প্রাণান্তকর চেষ্টা দেশের গোটা রাজনীতিকে একেবারেই দেউলিয়া করে দিয়েছে। নীতিহীনতা দিয়ে এরশাদ দু’নেত্রীকে জয় করে নিয়েছেন, ক্ষমতার নোংরা খেলায় নিজের অপরিহার্যতা প্রমাণ করে।
স্বৈরশাসক হিসেবে বাংলাদেশে প্রথম গণঅভ্যূত্থানে পতিত হবার পরেও প্রাক্তন শত্রুপক্ষকে মিত্র হিসেবে পেয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গ ছাড়েন, বিএনপি মুখিয়ে আছে তাকে সঙ্গী করার জন্য। তার রাজনীতির মূল অনুসঙ্গ হচ্ছে, নীতিহীনতা ও ভ্রষ্টাচার। তিনি কখনোই নীতি মানেননি, ন্যায্যতা চাননি-দলের মধ্যে, দেশের মধ্যে, কোথাও না। রাজনীতিতে দু’কূল রক্ষা করে কি করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যায়, সেই চর্চা বরাবরই করে যাচ্ছেন। রাজনীতিতে এই এরশাদ এখনও অনুকরণীয় এবং অনুসরণীয় আমাদের বড় দুই দলের কাছে। প্রধান দুই দলের দুই নেত্রীর পাশে সেই স্বৈরাচার এরশাদকে পাশে দেখে এদেশের গাছপালাও লজ্বায় মাথা নোয়ায়, কিন্তু আমাদের দুই নেত্রী! আর সে কারণেই একদা স্বৈরাচার, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, হত্যা, দুর্নীতি ও অনৈতিকতার দায়ে অভিযুক্ত এরশাদ বিচারের মুখোমুখি হবার বদলে রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদার, গণতন্ত্র আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গী।হায়রে গণতন্ত্র! হায়রে ক্ষমতা! তোমার জন্য সবকিছুই বিসর্জন দিতে পারি মোরা!
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক । ই-মেইল: [email protected]
মন্তব্য চালু নেই