সেলফি জোয়ারে ভাসছে বিশ্ব, পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ
নিজস্বী বা সেলফি (সেল্ফি) হলো আত্ম প্রতিকৃতি আলোকচিত্র, যা সাধারণত হাতে-ধরা ডিজিটাল ক্যামেরা বা ক্যামেরা ফোন ব্যবহার করে নেয়া হয়। বর্তমানে অত্যন্ত পরিচিত একটা শব্দ। Selfie শব্দটি প্রথম এসেছে Selfish থেকে। Selfie অর্থ হল প্রতিকৃতি। ‘সেলফি’কে অক্সফোর্ড অভিধানে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে, একটি ছবি (আলোকচিত্র) যা নিজেরই তোলা নিজের প্রতিকৃতি, সাধারণত স্মার্টফোন বা ওয়েবক্যামে ধারণ করা এবং যে কোনো সামাজিক মাধ্যমে আপলোড (তুলে দেয়া) করা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চলছে সেলফির ঝড়। সেলফি কি? সেলফির প্রতিক্রিয়া কি তা নিয়েও চলছে তুমুল আলোচনা। শুধু সাধারণ ব্যবহারকারীই নয়, সেলিব্রেটি থেকে পোপ, সকলেই নিজেদের সেলফি আপলোড করছেন বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে। আবার সেলফি মানুষের জীবন বাঁচাতেও রাখছে দায়িত্বশীল ভূমিকা। হাসপাতালের বেডে মৃত্যু পথযাত্রী স্টিফেন সাটার নিজের সেলফি দিয়েছিলেন। আর তা দেখেই স্টিফেনের চিকিৎসার জন্য উঠেছে ৩ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
সম্প্রতি লন্ডন শহরকে সেলফির রাজধানী হিসেবে দাবি করছেন স্থানীয় নাগরিকরা। তাদের মতে, ফেইসবুক ও টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে লন্ডনের প্রাণকেন্দ্র বেকিংহাম প্যালেসকে ঘিরেই তোলা হয়েছে ১৪ শতাংশেরও বেশি ছবি।
লন্ডনভিত্তিক অনলাইন পোর্টাল সাজেষ্ট মি ডটকমের অনুসন্ধান বলছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আপলোড করা সেলফির ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রায় ৬৩ লাখ ব্যবহারকারী লন্ডনের আশেপাশের এলাকাগুলোতে সেলফি তুলেছেন। সেই হিসেবে সেলফির রাজধানী লন্ডন। তবে অনলাইনটি নিউইয়র্ক এবং এমসটেডাম শহর দুটিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রেখেছে। সেখানকার দর্শণীয় স্থান টাইমস স্কয়ার, স্ট্যাচু অব লিবার্টি, ভ্যানগগ যাদুঘর ইত্যাদি কেও তুলে এনেছেন তারা।
তবে, ইতিমধ্যে সেলফির রাজধানী দাবি করেছে ফিলিপাইনের মাকাতি ও পাসিং সিটি। শহর দুটিতে প্রতিদিন ফেইসবুক ব্যবহারকারীরা গড়ে দুইটি করে সেলফি দেন। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন ও মিয়ামি শহরও নিজেদের সেলফিতে সেরা ভাবেন।
বিখ্যাত ডিকশনারী মেরিয়াম ওয়েবস্টার সোমবার এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা ‘সেলফি’ শব্দটিকে তাদের ডিকশনারিতে যুক্ত করেছে। যার অর্থ দেওয়া হয়েছে, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাবলিশ করার জন্য ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে কোন ব্যক্তি নিজেই নিজের ছবি বা প্রতিকৃতি তোলাই সেলফি।
যাই হোক না কেনো, অন্যান্য দেশের মতো সেলফিতে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশিরাও। টাইম ম্যাগাজিনের একটি পরিসংখ্যান মতে, সেলফি তোলার পরিমাণের বিবেচনায় ঢাকা বিশ্বের ৪৫৯টি শহরের মধ্যে ৪৩৪ তম স্থান দখল করেছে। ঢাকার প্রতি ফেইসবুক ও টুইটার ব্যবহারকারী গড়ে ১.৫টি সেলফি আপলোড করেন।
তবে, এশিয়ার শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার তুলনায় পাকিস্তানের লাহোর ও করাচী, ভারতের কলকাতা ও চেন্নাইয়ের মতো শহরের ফেইসবুক ব্যবহারকারীরা সেলফি তোলার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন। সেলফি তোলার ক্ষেত্রে বিশ্বের শহরগুলোর মধ্যে লাহোরের অবস্থান ৪৩০, করাচীর অবস্থান ৪৩১, কলকাতার অবস্থান ৪২১।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দেখা গেছে, বাংলাদেশি তারকারা তাদের সেলফি প্রকাশে এগিয়ে রয়েছেন। জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী ব্রাজিল ও বার্সোলোনা দলের ফুটবলার দানি আলভেজের দিকে কলা ছুড়ে মারা ও বর্ণবাদী আচরণের প্রতিবাদ জানিয়ে সেলফি দিয়েছেন। অভিনয় শিল্পী মেহজাবিন, সরিকা, শখ, মোনালিসা, তিশা, নবজাতকসহ মিথিলা ছাড়াও অনেকেই সেলফি দিয়েছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের মধ্যে অলরাউন্ডার সাকিব তার স্ত্রী শিশিরের সঙ্গে সেলফি আপলোড করেছেন। মুশফিক, নাসির, সোহাগ, তামিমরাও পিছিয়ে নেই সেলফির দৌড়ে।
সেলফি বর্তমানে খুব প্রচলিত হলেও সেলফির ইতিহাস খুব অদ্ভুত। যতদুর জানা যায় ইতিহাস এর প্রথম সেলফি তোলা হয়েছিলো ১৮৩৯ সালে। রবার্ট কর্ণিলিয়াস নামের একজন ফোটোগ্রাফার প্রথম সেলফি প্রকাশ করেন। ১৯০০ সালে Kodak Brownie box camera বাজারে আসার পর সেলফি তোলা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বহনে সহজ এই ক্যামেরার সাহায্যে আয়নার মাধ্যমে সেলফি তোলার প্রচলন শুরু হয় তখন থকেই। তবে সেলফি শব্দটি প্রথম ব্যাবহৃত হয় ২০০২ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ান এক অনলাইন ফোরামে।
ফেসবুক এর আগের সময়টায় মাইস্পেস বেশ জনপ্রিয় ছিল। এবং সে কারনেই সেলফি সর্ব প্রথম জনপ্রিয়তা পায় সেখানেই। তারপর ফেসবুক জনপ্রিয় হওয়ার পর অনেক দিন পর্যন্ত সেলফি নিম্ন রুচির পরিচায়ক ছিল। [কারন তখন বেশিরভাগ সেলফি গুলো বাথরুমের আয়নার সামনে তোলা হত।] তবে শুরু থেকেই ইমেজ শেয়ারিং সাইট ফ্লিকার এ জনপ্রিয় ছিলো সেলফি। তবে তখনকার দিনের সব সেলফি গুলোই টিন এজ মেয়েরা আপলোড করত। প্রাথমিক অবস্থায় তরুণদের মধ্যে সেলফি অধিক জনপ্রিয়তা পেলেও বর্তমানে এটি সমাজের সকল স্তরে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ২০১২ সালের শেষের দিকে টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে ‘সেলফি’ শব্দটি বছরের আলোচিত সেরা দশ শব্দের অন্যতম শব্দ হিসাবে বিবেচিত হয়। ২০১৩ সালের জরিপ অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ান মহিলাদের দুই তৃতীয়াংশই (যাদের বয়স ১৮-৩৫) ফেসবুকে শেয়ারের উদ্দেশে সেলফি তুলেছেন। স্মার্টফোন এবং ক্যামেরা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান স্যামসাং এর জরিপ প্রতিবেদন বলছেঃ ১৮-২৪ বছর বয়েসি মানুষের তোলা ছবির ৩০% ই সেলফি। ২০১৩ সালে অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির অনলাইন ভার্সনে ‘সেলফি’ শব্দটি নতুন সংযোজিত হয়। স্মার্টফোনের কল্যানে গত এক বছরে বাংলাদেশ সহ সমগ্র বিশ্বে সেলফি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
এদিকে বর্তমান সময়ের ‘সেলফি কিং’ নামে খ্যাত বেনি উইনফিল্ড ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম সেলফি আপলোড করেন। তারপর থেকে প্রতিদিনই তিনি হাসিমুখ নিয়ে একই রকম সেলফি আপলোড করে আসছেন। নিজেকে আধুনিক যুগের মোনালিসা মনে করেন ৩৮ বছর বয়সী বেনি।
সেলফির মাধ্যমে প্রাপ্ত জনপ্রিয়তাকে ব্যবসায়িক কাজে লাগিয়েছেন তিনি। নিজের মুখের ছবির লোগো সম্বলিত ৩ হাজার টি-শার্ট তৈরি করে বিক্রি করেছেন বেনি। তিনি বলেন, নিজের অবয়ব বিক্রি করে আমি ব্যবসা করতে চাই। আর তাই নিরাপত্তা রক্ষীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন ব্যবসা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছেন তিনি।
মন্তব্য চালু নেই