সেন্টমার্টিনকে ঘিরে ইকো-ট্যুরিজমের অপার সম্ভাবনা
টেকনাফের সমুদ্র বেষ্টিত প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হলেও দ্বীপটির ইকোলজিক্যাল অবস্থার ভারসাম্য রক্ষা, পর্যটক সহ স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বীপটি ব্যবহারে জন্য পরিবেশ বান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রতিনিয়ত সতর্কতামূলক নজরদারী জোরদার করা গেলে সেন্টমার্টিনে ইকো-ট্যুরিজম গড়ে তোলা সম্ভব বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদ সহ সচেতন মহল।
কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে রক্ষা করে পরিবেশ বান্ধব ইকো-ট্যুরিজমের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। একে কাজে লাগাতে পারলে সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে সেন্টমার্টিন। এ জন্য পুরো বছর জুড়ে দ্বীপ রক্ষায় পরিবেশের ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থ্যা গ্রহণ এবং সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থার পাশাপাশি পরিবেশ বান্ধব মহা-পরিকল্পনা নিতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম জানান, সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও জীব-বৈচিত্রতা রক্ষায় সমন্বিত কোন উদ্যোগ নেই। পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হওয়ায় দ্বীপটি ব্যবহারে পর্যটন, ভূমি, জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এই নীতিমালার আলোকে অবকাঠামো নির্মাণ, স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন-জীবিকা, বসতবাড়ী নির্মাণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য স্থান নির্দিষ্টকরণ সহ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। এতে জীব-বৈচিত্র্যতা ও দ্বীপটি রক্ষার পাশাপাশি পর্যটন শিল্পের বিকাশ সম্ভব। তিনি ভারতের কোচি জেলায় অবস্থিত অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র লাক্ষাদ্বীপের কথা উল্লেখ করে জানান, এ দ্বীপে ভ্রমণে যেতে হলে আগে থেকে ফরম পূরণ করে আবেদন জানাতে হয়। তাতে উল্লেখ করতে হয় – কয়জন ভ্রমণে যাবে, কি কি মালামাল নিতে পারবে, কি ধরণের খাবার খেতে পারবে সহ আরো নানা নিয়মনীতি।
প্রবাল ও নুড়ি পাথরে গড়ে উঠা সমুদ্র বেষ্টিত সেন্টমার্টিনের স্বচ্ছ-নীল জল, সেই জলে মাছ সহ সামুদ্রিক প্রাণির অবাধ বিচরণ, জোয়ার-ভাটার সময় মূল-দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জেগে উঠা ৩টি দ্বীপ ও কেয়া গাছগুলোর সৃষ্ট দৃষ্টিনন্দন লোনাবন, নানা প্রজাতির পাখি বিশেষ করে শীতকালে অতিথি পাখির আগমন আর সমুদ্র বেষ্টিত দ্বীপে সূর্য্যােদয়-অস্তের নৈসর্গিক দৃশ্য ভ্রমণ পিপাসু যে কাউকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে সেন্টমার্টিন। তাছাড়া এ দ্বীপের স্থানিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, প্রকৃতি ও মানুষের জীবন-জীবিকাও অনেকটা ইকো-ট্যুরিজমের সম্ভাবনাকে করেছে প্রবল। এছাড়াও এ দ্বীপের মানুষের জীবন-জীবিকার অন্যতম অবলম্বন সাগরে মাছ ধরা ও শুটকি উৎপাদন করার দৃশ্যও উপভোগ করতে পারে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভ্রমণকারীরা। এপ্রিল মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত সচরাচর সাগর উত্তাল থাকে। ফলে প্রতিবছর নভেম্বর মাস থেকে শুরু করে মার্চ মাস পর্যন্ত এ দ্বীপে আনাগোনা থাকে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের। এ সময়টাতে কয়েক লক্ষ পর্যটক ভ্রমণে আসেন সেন্টমার্টিনে। বছরের অন্যান্য সময় পর্যটক খরায় থাকে নারিকেল জিনজিরা খ্যাত এ দ্বীপ।
এছাড়াও সেন্টমার্টিন ভ্রমণে আসা পর্যটকদের থাকার জন্য যেসব হোটেল-মোটেল ও রেষ্টুরেন্ট সহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা গড়ে উঠেছে তা চাহিদার তুলনায় নিতান্ত অপ্রতুল। অপরিকল্পিতভাবে এসব স্থাপনা গড়ে না তুলে মহা-পরিকল্পনার আওতায় বিনোদন সহ অন্যান্য ব্যবস্থা করা গেলে সারাবছরই পর্যটকে ভরে থাকবে সেন্টমার্টিন। এমনই অভিমত সেন্টমার্টিন ভ্রমণে আসা পর্যটক ও পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্টদের।
গত ১৫ জানুয়ারী অভিজাত এক হোটেলের উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কক্সবাজার সফরে এসেছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। অনুষ্টানে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী জানান, কক্সবাজারের ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ ও মহেশখালী দ্বীপকে ঘিরে পর্যটন শিল্প বিকাশে সরকারের মহা-পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিমধ্যে আগামী ২০১৬ সালকে সরকার পর্যটন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে পরিবেশ বান্ধব ইকো-ট্যুরিজম গড়ে তোলারও পরিকল্পনা রয়েছে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের।
সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভ্রমণে আসা আমেরিকা প্রবাসী শাহীন রেজা ও লিপি রেজা দম্পতির সাথে কথা হলে জানান, তারা প্রতিবছরই দেশে একবার বেড়াতে আসেন। এ সময় তারা দেশের কোথাও না কোথাও বেড়াতে যান। এবারই তাদের প্রথম সেন্টমার্টিন ভ্রমণে আসা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্য দেখে তারা যারপরনাই মুগ্ধ। নিজের দেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপের এমন নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করে তারা খুবই গর্বিত।
এখানকার সাগর বিধৌত প্রবাল পাথর, সেই পাথরে প্রতিনিয়ত ঢেউয়ের আছড়, স্বচ্ছ-নীল জল আর খালি চোখে সেই জলে মাছ সহ সামুদ্রিক প্রাণির অবাধ বিচরণ দেখা এবং নানা প্রজাতির শামুক-ঝিনুক ও সৈকতের বালুকা বেলায় কাঁকড়াদের প্রতিনিয়ত লুকোচুরি খেলা, সামুদ্রিক কাছিমের অবাধ বিচরণ আর সাগরের স্বচ্ছ জলে শৈবাল সহ নানা প্রজাতির জলজ উদ্ভিদের সমাহার বিশ্বের অন্যান্য দ্বীপের জীব-বৈচিত্র্যতার থেকে ভিন্ন। এগুলোকে ইকো-ট্যুরিজমের আওতায় এনে পর্যটন শিল্পের বিকাশ সম্ভব বলে জানান, শাহীন-লিপি দম্পতি। তাছাড়া দ্বীপের সারিসারি নারিকেল গাছের বিথী আর দৃষ্টিনন্দন কেয়া গাছের অসংখ্য ঝোপের সমাহার ইকো-ট্যুরিজম গড়ে তুলতে সহায়ক ভ’মিকা পালন করবে।
এ দম্পতি আরো জানান, এখানে ইকো-ট্যুরিজম গড়ে তুলতে হবে অবকাঠামো সহ সবকিছুতে প্রকৃতির ছোঁয়ায়। প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে সংগতি রেখে আবাসন সহ বিনোদনের সব ব্যবস্থাও হবে প্রকৃতি নির্ভর। এ দ্বীপে ভ্রমণে এসে যেন যে কেউ প্রকৃতির পরশে শিহরিত হয়ে উঠে। প্রকৃতি-পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি পরিকল্পনায় রেখে অবকাঠামো সহ সব স্থাপনার নির্মাণশৈলী ও উপাদান হবে প্রাকৃতিক। এ লক্ষ্যে স্থানীয় জনবসতি সহ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাও গড়ে তুলতে হবে ইকো-ট্যুরিজমের আওতায়। এর ফলে যান্ত্রিক জীবনে অতিষ্ঠ মানুষ প্রকৃতির পরশ নিতে ছুটে আসবে সেন্টমার্টিন।
নারায়নগঞ্জ থেকে বেড়াতে আসা কামরুল আহসান জানান, সেন্টমার্টিন সত্যিই উপভোগ্য স্থান। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন আসা-যাওয়ার পথে জাহাজে করে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সীমান্ত নির্ধারণ করে বয়ে চলা নাফ নদী আর মোহনা হয়ে সমুদ্র অবলোকন ভ্রমণ পিপাসুদের রোমাঞ্চিত করে। এ সময় বয়ে চলা জাহাজের পিছুপিছু দলবেধেঁ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক পাখির ছুটাছুটি যে কাউকে মোহিত করবে। সেন্টমার্টিনে যাতায়ত পথে পর্যটকবাহী জাহাজ এবং উঠানামার জেটিগুলোকে আরো বেশী নিরাপদ করা গেলে পর্যটকের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে।
তিনি আরো জানান, সেন্টমার্টিনে থাকার ও খাবার জন্য হোটেল-রেস্তোরাগুলো যে দাম নেয় তা পর্যটকদের সেবাদান ও মানের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। মানুষ প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে এ দ্বীপে বেড়াতে আসে। তাই থাকার ক্ষেত্রে প্রকৃতি ও পরিবেশ নির্ভর অবকাঠামো এবং খাবারের বেলায় স্থানীয়ভাবে আহরণ করা নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ সহ কক্সবাজার জেলার ঐতিহ্যবাহী অন্যান্য খাদ্য উপকরণকে প্রধান্য দিতে হবে। এতে করে পর্যটন শিল্পের বিকাশের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পাবে।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন জানান, আজ থেকে ২০/২৫ বছর আগেও সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকদের তেমনটা আনাগোনা ছিল না। এখন বছরে প্রায় ৩ লাখেরও বেশী পর্যটকের সমাগম ঘটে সেন্টমার্টিনে। এখন পর্যটকদের জন্য আবাসন সহ অনেক সুযোগ-সুবিধাও গড়ে উঠেছে। কিন্তু প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক পর্যটকের আনাগোনার কারণে দ্বীপের জীব-বৈচিত্রতার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া যে কোন স্থাপনা গড়ে তোল যায় না। এ কারণে পর্যটকদের সেবাদানের জন্য নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে না সুযোগ-সুবিধা। দ্বীপ রক্ষার পাশাপাশি আরো বেশী পর্যটক সমাগম ঘটাতে হলে এখানে পরিবেশ বান্ধব ইকো-ট্যুরিজমের প্রতি জোর দিতে হবে।
মন্তব্য চালু নেই