সেতুর অভাবে লক্ষাধিক মানুষের চরম দুর্ভোগ

মৌলভীবাজার-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের কাজিরবাজার সংলগ্ন মনু নদীতে সেতুর অভাবে মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর ও সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ চরণ ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে ওই তিন উপজেলার ৩৪টি গ্রামের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা যাতায়াতের অভাবে লেখাপড়া ও উচ্চ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

নদী পারাপারের ভয়ে অনেকেই অল্প বয়সে লেখাপড়া ছেড়ে অন্য কাজে জড়িয়ে পড়ে। যার ফলে উচ্চ শিক্ষার দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে বৃহত্তর ওই অঞ্চলটি। বাড়ছে বেকারত্ব।

ওই জায়গায় সেতু নির্মাণের জন্য এলাকাবাসী স্বাধীনতার পর থেকে একাধিকবার আবেদন নিবেদন করেও অদ্যাবধি এর কোনো সুফল পায়নি অবহেলিত এই তিন উপজেলার ৩৪টি গ্রামের অধিবাসী।

৪০০ হাত দীর্ঘ মনু নদীর ওই জায়গা দিয়ে পারাপারের জন্য এলাকাবাসী বাৎসরিক পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে এখানকার বাসিন্দা বকুল এর সাথে চুক্তি করেছেন। এলাকার সবাই চাঁদা তুলে ওই টাকা পরিশোধ করেন। বর্ষা মৌসুমে ২টি নৌকা এবং শুকনো মৌসুমে পাশাপাশি ২টি সাঁকো দিয়ে পারাপার হন ওই তিন উপজেলার ৩৪ গ্রামের লক্ষাধিক নারী-পুরুষ। বর্ষা মৌসুমে সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত নদীতে নৌকা পাওয়া যায়। রাত ১০টার পরে ওই নদীতে মাঝি থাকেন না। এ অবস্থায় চরম দূর্ভোগে পড়তে হয় বাজার করতে আসা, শহর থেকে ফিরে আসা ও অন্যান্য জায়গা থেকে বাড়ি ফেরা মানুষের। বাড়ি আসতে হলে কামালপুর ইউনিয়নের নয়াব্রিজ হয়ে প্রায় ৫/৬ কিলোমিটার ঘুরে আসতে হয় অথবা ওপারে কারো বাড়িতে রাত্রি যাপন করতে হয়।

নদীর পূর্ব পারে অবস্থিত মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর ও সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার মীরপুর, পালপুর, আমওয়া, সুমারাই, চাঁনপুর, পাগড়িয়া, সোনানুয়া, আব্দুল্লাহপুর, ইসলামপুর সোনাপুর, ওয়াবদাবাজার, কাশিমপুর, মধুপুর, অন্তেহরি, কাদিপুর, জগৎপুর, জুম্মাপুর, গালিমপুর. পইলনপুর, ফাযিলপুর ও ইছাপুর গ্রামের অবস্থান। ওই ২১ গ্রামে প্রায় অর্ধলক্ষ লোকের বসবাস। নদীর দক্ষিণ পাশে অর্থাৎ মৌলভীবাজার-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, হাট-বাজার, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দিরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থাকায় মনু নদী পার হয়ে কাজির বাজার দিয়ে ওই সব প্রতিষ্ঠানে যেতে চরম দুর্ভোগের শিকার হন তারা। ওই গ্রামের শিক্ষার্থীরা নদী পার হয়ে আপ্তাউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, খলিসপুর আলিম মাদ্রাসা, মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ, মহিলা কলেজ নিয়মিত যাতায়াত করতে হয়। ওই গ্রামগুলোর মধ্যে বড় কোনো বাজার না থাকার কারণে এলাকার লোকজন প্রতিনিয়ত হাট-বাজার করার জন্য সরকার বাজার, শেরপুর বাজার, কাজিরবাজার ও মৌলভীবাজার শহরে ওই নদী অতিক্রম করে আসতে। ঝুঁকির মধ্যে সাঁকো দিয়ে মালামাল পারাপার করতে হয় তাদের।

নদীর পশ্চিম পারে আঞ্চলিক আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে বেকামুড়া, পাঠানটুলা, কাজিরবাজার, গোলাপগঞ্জ, কর্মচিতা, খালিশপুর, বাশুদেবশ্রী, নাদামপুর, যমুনীয়া, উম্মরপুর, বাউরভাগ, গোড়াখাল ও শ্রীদরপুর এলাকার লোকজন মনু নদী অতিক্রম করে উত্তর পাশের সেওয়াইঝুড়ি ও কাউয়াদীঘি হাওরের কৃষি জমিতে চাষাবাদ, শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাওয়া ও আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগসহ নানা কাজে প্রতিনিয়ত যেতে হয়। বিশেষ করে বোরো ও আমন মৌসুমে কৃষি জমির ফসল ঘরে তুলতে তাদেরকে সীমাহীন কষ্টের শিকার হতে হয়। পূর্ব পারে বৃহত্তম কাউয়াঘীগি হাওরের অবস্থান।

সরেজমিন এলাকায় গেলে আপ্তাব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুমানা আক্তার, জাকির হোসেন, সবুজ মিয়া, শিরিন বেগম, রিমা বেগম, আল-আমিন ও মাঈশাসহ প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থীদের সাথে দেখা হলে তারা বলে, ওই নদীতে সাঁকো পারাপারের সময় আমরা অনেক ভয় পাই। মাঝে মধ্যে নদীতে আমাদের বই, খাতা, কলম এমনকি জুতাও পড়ে যায়। বর্ষা মৌসুমে নৌকায় পারাপার হতে গিয়ে নদীতে নৌকা ডুবে যায়। ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতে হয়। যার কারণে সময় মতো ক্লাসে ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।

এলাকার প্রবীণ মুরব্বি হাফিজুর রহমান, বদরুল এইচ জোসেফ, আব্দুল লতিফ, আব্দুল আহাদ, লায়েক তরফদার, ছমিরুন নেছা, আখলিমা বেগম ও পালপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এবাদুল হক বুলু সহ এলাকাবাসী বলেন, ওই নদী পারপার হতে গিয়ে নৌকা ডুবে অনেক লোক মারা গেছেন এবং অনেক আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। বিশেষ করে ওই অঞ্চলের অসুস্থ ও গর্ভবর্তী মহিলার চরম কষ্টের শিকার হন। তাৎক্ষণিকভাবে তাদেরকে কোনো হাসপাতাল নেয়া সম্ভব হয়নি, যার কারণে অনেকেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন।

তারা আরও বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময় সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি একাধিকবার উপস্থাপন করা হলেও আজ পর্যন্ত কোনো আশ্বাস পাওয়া যায়নি। তাদের দাবি, এলাকার মানুষের দূর্ভোগের কথা চিন্তা করে যত দ্রুত সম্ভব এখানে একটি সেতু নির্মাণ করে দিলে এলাকার মানুষ নির্বিগ্নে যাতায়াত করতে পারবে।



মন্তব্য চালু নেই