সিরিয়ার সেই চোরাচালানি
বিশ্বজুড়ে আজ একটাই ইস্যু। সেটা হলো ইসলামিক স্টেট। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সহিংস ঘটনা ঘটছে যার পেছনে দেখা যাচ্ছে ইসলামিক স্টেট নামের একটি সশস্ত্র সংগঠনকে। ২০১১ সাল থেকে তারা সিরিয়া এবং ইরাকের একটি বিশাল অংশে আধিপত্য চালিয়ে আসছে। যত দিন যাচ্ছে ততই শক্তিশালী হয়ে উঠছে সংগঠনটি। প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি সংগঠনটি এতোই হুমকি হয়ে থাকে তাহলে এদের অস্ত্র-গোলাবারুদের রসদ বন্ধ করে দিলেই তো হয়। গুলিহীন অস্ত্র দিয়ে তো আর ইসলামিক স্টেট যুদ্ধ করতে পারবে না মার্কিন বাহিনী কিংবা সিরীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে। এই সহজ সমাধান যে অন্য কোনো পক্ষের মাথায় আসেনি ব্যাপারটা মোটেও তা নয়।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের বিশ্লেষকরা ইসলামিক স্টেটের অর্থের উৎস নিয়ে বিস্তার আলাপ আলোচনা করেছেন ইতোমধ্যেই। আলোচনার সূত্র ধরে দেখা যায়, তেল এবং অপহরণ হলো এই সংগঠনটির অর্থের মূল উৎস। সিরিয়া ও ইরাকের বেশকিছু তেলক্ষেত্র ইসলামিক স্টেটের দখলে চলে যাওয়ায় ব্যারেল প্রতি কম মূল্যে তারা বিভিন্ন দেশে তেল বিক্রি করছে। সম্প্রতি জাতিসংঘ সিরিয়া থেকে তেল কেনার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যাতে ইসলামিক স্টেট ফান্ড তৈরি করতে না পারে। কিন্তু সংগঠনটির অর্থের আরও একটি উৎস রয়ে গেছে যা এখনও বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। আওয়ার নিউজ বিডি’র পাঠকদের জন্য সেই উৎস এবং উৎস প্রধান সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হচ্ছে।
সিরিয়া এবং ইরাকে তিনি ‘মোহাম্মদ’ নামে পরিচিত। ২১ বছর বয়সী এই সিরীয় নাগরিক বয়সে একেবারেই তরুন হলেও গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে রয়েছে তার বিশাল নেটওয়ার্ক। মধ্যপ্রাচ্যের যেখানেই যুদ্ধ পরিস্থিতি সেখানেই দেখতে পাওয়া যায় মোহাম্মদকে। অবশ্য, তিনি ওই যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র কিংবা মাদক কিছুই বিক্রি করেন না। উল্টো তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বিভিন্ন জিনিস কেনেন। তবে এই বিভিন্ন জিনিসের মধ্যে অন্যতম হলো পুরাতন জিনিসপত্র। ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানে সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে ওই দর্শনীয় স্থানগুলোও প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। মোহাম্মদ নিজে এবং তার নেটওয়ার্ক খাটিয়ে ওই স্থানগুলো থেকে পুরাতন সামগ্রী কখনও চুরি করেন কিংবা বিজয়ীদের কাছ থেকে চড়া দামে কিনে নেন। এরপর সেই সামগ্রী ইউরোপেরই কোনো ধণাঢ্য ব্যাক্তির কাছে অধিক দামে বিক্রি করে দেন, আর সেই বিক্রিত অর্থ গোটাটাই চলে যায় ইসলামিক স্টেটের ফান্ডে।
মোহাম্মদ অবশ্য এখন বেকা ভ্যালিতে বাস করেন। সিরিয়া এবং লেবানন সীমান্তবর্তী এই ভ্যালি থেকেই তিনি এখন ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করেন। সিরিয়ায় মোহাম্মদের রয়েছে বিশস্ত তিন বন্ধু। এই তিন বন্ধু তিন বিষয়ে পারদর্শী। একজন পুরাতন ছোটো সামগ্রী সংগ্রহে, অন্যজন সামগ্রীর সন্ধানে এবং সর্বশেষজন ওই সামগ্রী বিক্রিতে পারদর্শী। মোহাম্মদের ভাষায়, ‘আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করি ভালো মূল্যে পণ্যটি বিক্রির জন্য। সেটা কানের দুলও হতে পারে আবার ছোটো কোনো মুর্তিও হতে পারে।’ তার বিক্রিত ছোটো পণ্যের দাম কখনও পাঁচ লাখ ডলারও হয় আবার কখনও এক মিলিয়ন ডলারও হয়। যেহেতু সিরিয়া, ইরাক এবং লিবিয়াতে ইসলামিক স্টেট শক্তিশালী ঘাটি গেড়েছে তাই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত সকল পুরাতন পুরাকীর্তি তাদের দখলেই চলে যায়। আর সেই দখলকৃত পুরাকীর্তিই মোহাম্মদ চড়া দামে কিনে নেয়।
মোহাম্মদের এক শিষ্য ‘আহমেদ’। যাকে সিরিয়া-তুরস্ক এবং ইরাকে মিডলম্যান নামে ডাকা হয়। মোহাম্মদের এই শিষ্য ইউরোপের খদ্দেরদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুরাকীর্তি বিক্রির বন্দোবস্ত করে। সিরিয়া থেকে কোনো সামগ্রী পাচার করতে হলে আহমেদকে লাগবেই। কারণ তার মতো যোগাযোগ অন্য কোনো চোরাচালানীর নেই।
মোহাম্মদের ভাষ্য মতে, ‘সবচেয়ে বেশি মুনাফা আসে পাথরনির্মিত মুর্তি এবং স্বর্ণমুদ্রা থেকে। কিছুদিন আগেই মাত্র একটি স্বর্ণমুদ্রা আমি বিক্রি করেছি এক দশমিক এক মিলিয়ন ডলারে। মুদ্রাটি ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৮৫০০ অব্দের সময়কার। আমার কাজ তুরস্কের ব্যবসায়িদের কাছে জিনিসটি পৌছে দেয়া, আর তাদের কাজ হলো পশ্চিম ইউরোপের ক্রেতাদের কাছে পৌছে দেয়া। ক্রেতাদের প্রথমে ছবি দেখাতে হয় অনলাইনে। ছবি দেখে তারা সন্তুষ্ট হলেই তবে অর্থের প্রসঙ্গ আসে। আমাদের বিক্রি করা পুরাকীর্তিই পরবর্তী সময়ে ইউরোপের নামিদামী জাদুঘর বা গ্যালারিতে শোভা পায়। তখন অবশ্য কেউ এগুলোর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। কারণ এই ব্যবসার সঙ্গে অনেকেই যুক্ত, যাদের কখনও দেখা যায় না। আমার এখন আর ফিরে যাবার কোনো রাস্তা নেই মৃত্যু ছাড়া।’
বৈরুতে গেলে পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত অনেক দোকান দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে সিরিয়া-ইরাক-লিবিয়া থেকে লুট হওয়া অনেক পুরাকীর্তিক নির্দশন দেখতে পাওয়া যায়। তবে সবাই চাইলেও সত্যিকারের জিনিসটির সন্ধান মিলবে না, যদি না থাকে কোনো গোপন যোগাযোগ। গোপন যোগাযোগের মাধ্যমে ওই দোকানগুলোতে গেলে হেলেনিক এবং বাইজানটাইন সময়কার অনেক জিনিসপত্রই পাওয়া যাবে।
মন্তব্য চালু নেই