সিরাজের ফাঁসি, আকরামের আমৃত্যু কারাদণ্ড

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাগেরহাটের সিরাজ মাস্টারের (কসাই সিরাজ) ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। একই মামলায় খান আকরাম হোসেনকে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তাদের বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগের মধ্যে ছয়টি প্রমাণিত হয়েছে।

মঙ্গলবার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যর বেঞ্চ এ আদেশ দেন। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। বেঞ্চ রায় ঘোষণার জন্য আজ মঙ্গলবার দিন ধার্য করেছিলেন।

রায় ঘোষণার সময় আদালতে চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু, সৈয়দ হায়দার আলী, জেয়াদ আল মালুম, সায়েদুল হক সুমন উপস্থিত ছিলেন।

সিরাজ মাস্টারের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান ও খান আকরামের পক্ষে ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

মঙ্গলবার সকাল ১১টা ৫ মিনিটে রায় পড়া শুরু হয়। মোট ১৩৩ পৃষ্ঠা রায়ের প্রথমাংশ পাঠ করেন ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক। দ্বিতীয়াংশ পাঠ করেন অপর সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন। রায়ের মূল অংশ পাঠ করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে রায় ঘোষণা করা হয়।

এর আগে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সিরাজ মাস্টার ও খান আকরাম হোসেনকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পুলিশি প্রহরায় ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয়।

গত ৫ আগস্ট সিরাজ মাস্টার (কসাই সিরাজ) ও খান আকরাম হোসেনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার জন্য আজকের দিন ধার্য করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল।

এ মামলার তিনজন আসামির মধ্যে আব্দুল লতিফ তালুকদার গত ২৮ জুলাই অসুস্থতাজনিত কারণে মারা যান। মারা যাওয়ায় তার  মামলার কার্যক্রমও সমাপ্ত ঘোষণা করা হয় ওই দিন।

গত ২৩ জুন উভয়পক্ষের চূড়ান্ত যুক্তি উপস্থাপন শেষে মামলাটি রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সৈয়দ হায়দার আলী ও ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন চূড়ান্ত যুক্তি উপস্থাপন করেন।

সিরাজ মাস্টারের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান ও খান আকরাম হোসেন ও লতিফ তালুকদারের পক্ষে ব্যারিস্টার মীর সারোয়ার হোসেন চূড়ান্ত যুক্তি উপস্থাপন করেন।

গত ২১ জুন অভিযোগের ওপর যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন আসামিপক্ষ। গত ১৫ জুন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেন ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। গত ২৯ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। গত বছরের ৫ নভেম্বর তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।

যত অভিযোগ : মানবতাবিরোধী অপরাধে সিরাজ মাস্টার, আব্দুল লতিফ ও খান আকরামের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মোট সাতটি অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। অভিযোগগুলো হল :

অভিযোগ ১ : গণহত্যা, হত্যা, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ : ১৯৭১ সালের ১৩ মে তৎকালীন বাগেরহাট মহকুমার রাজাকার বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে রজব আলী ফকির এবং ৫০/৬০ জন রাজাকার বাগেরহাট জেলার রঞ্জিতপুর গ্রামে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর লুট এবং অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের ৪০-৫০ জন নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়।

অভিযোগ ২ : গণহত্যা, হত্যা, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ : বাগেরহাটের রামপাল থানার ডাকরার কালীমন্দিরে ভারতের শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে জড়ো হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই-তিন হাজার লোক। ১৯৭১ সালের ২১ মে বেলা ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত তৎকালীন বাগেরহাট মহকুমার রাজাকার বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে রজব আলী ফকি্র এবং ৫০/৬০ জন রাজাকার তাদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ৬০০-৭০০ জনকে হত্যা করে। এ ছাড়া ডাকরা গ্রামে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর লুট এবং অগ্নিসংযোগ করে।

অভিযোগ ৩ : হত্যা, অপহরণ, আটক এবং নির্যাতন : ১৯৭১ সালের ১৮ জুন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সদর থানার বেসরগাতী, কান্দাপাড়া এলাকায় তৎকালীন বাগেরহাট মহকুমার রাজাকার বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে ২০/২৫ জন পাক সেনা এবং ৩০/৩৫ জন রাজাকার হামলা চালিয়ে ২০ জন নিরীহ নিরস্ত্র লোককে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও পরে ১৯ জনকে হত্যা করে।

অভিযোগ ৪ : অপহরণ এবং হত্যা : ১৯৭১ সালের ১৪ অক্টোবর সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তৎকালীন বাগেরহাট মহকুমার রাজাকার বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে ১০০/১৫০ জন রাজাকার সদর থানার চুলকাঠি বাজার, চুলকাঠি, ঘনশেম্পুর এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় হামলা চালিয়ে ৪২টি বাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় সাতজন নিরস্ত্র মানুষকে আটক এবং নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।

অভিযোগ ৫ : অপহরণ এবং হত্যা : ১৯৭১ সালের ৫ নভেম্বর দুপুর ৩টায় সিরাজ মাস্টার, খান আকরাম এবং লতিফ তালুকদার এবং ৫০/৬০ জন রাজাকার কচুয়া থানার শাখারিকাঠি বাজারে হামলা চালিয়ে ৪০ জন হিন্দুসহ ৪২ জনকে আটক, নির্যাতন ও পরে গুলি করে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এ সময় অনেক বাড়ির মালামাল লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

অভিযোগ ৬ : অপহরণ এবং হত্যা : ১৯৭১ সালের ২২ অক্টোবর সকাল ১০টা থেকে বিকেল আনুমানিক ৫টা পর্যন্ত সিরাজ মাস্টার, খান আকরাম এবং লতিফ তালুকদার টেংরাখালি গ্রাম থেকে সতিশ চন্দ্র মণ্ডল, কচুয়া গ্রাম থেকে বাবু খান, হাজরাখালী গ্রাম থেকে নজরুল ইসলাম শেখ, বাড়ুইখালি গ্রাম থেকে মনিন্দ্র নাথ সাহা, চর টেংরাখালি গ্রাম থেকে হাসেম আলি শেখকে আটক ও পরে হত্যা করে।

অভিযোগ ৭ : অপহরণ এবং হত্যা : ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টায় জেলার মোড়েলগঞ্জ থানার তেলিগাতীতে খান আকরাম এবং লতিফ তালুকদার তাদের সঙ্গীয় রাজাকারদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান শিকদারকে আটক, নির্যাতন ও পরে গুলি করে হত্যা করে।



মন্তব্য চালু নেই