সাপুড়েও নেই আর সাপ খেলাও নেই
‘বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে,আসি আসি বলে জোছনা ফাঁকি দিয়েছে। আবার, আমরা সাপ খেলা দেখাই/সাপের মাথার মনি দিয়ে স্বপনের ঘর সাজাই। খা খা খা বক্ষিলারে খা, ঠকবাজেরে খা, সর্দারের পুঁতটারে খা।’ এরকম হাজারটা গান-ধুঁয়ো আছে সাপ-সাপুরে আর বেদেদের জীবনাল্লেখ্য নিয়ে। সিনেমা-থিয়েটারও কম নেই। আর থাকবেই বা না কেন। এ সবই যে আমাদের বাংলার লোক ঐতিহ্যের ডালপালা ভাঙা শেকড়-বাঁকড়। তবে এখন কি আর তেমনটি আছে এসব। পেশা হারাতে বসেছে বেদে সম্প্রদায়। পেশাদার সাপুরে বা ওঝাদেরও আর দেখা মেলে না আগের মতো। কোথায় গেলো তারা ?
নদীমাতৃক এই বাংলায় নদী শুকিয়ে থাকে ৬-৯ মাস। বিল-ঝিল, হাওর-বাওর পানি শূন্য। তাহলে সাপটাই বা থাকে কোথায়, বেদেরাই বা বেদের বহরের নৌকা বাঁধে কোথায়। আর বনজঙ্গলগুলোতে কয়েক দশক ধরে ইটভাটা গিলছে। সাপ বাজবে কোথায়। বেদেরা এখন নৌকা জীবন ছেড়ে, ডাঙ্গা জীবনে উঠে এসেছে।
তাইতো আমরা দেখি শহর-উপ-শহরের পেটের কিনারে তারা পলিথিনের ছাউনি দিয়ে তাম্বু গেড়েছে। বেদেনীরা কাঁধে পুটলি নিয়ে ছুটছে। তুকতাক কবিরাজী, শিংগা লাগানোর কাজ করছে। তবে সাপ খেলা আর তারা দেখায় না। সাপ নেই। বেদেরা যাচ্ছে শহরে। কেউ রিকশা চালাচ্ছে। কেউ পোষাক কারখানায়। নানা পেশায় ঢুকে, পৈতৃকপেশা ভুলে বেঁচে থাকার প্রানান্ত চেষ্টা করছে।
অথচ আগে বেদে বহরে সাপের বাক্স বা ঝাপি ছিল অবধারিত অনুসঙ্গ। মোটা-সোটা বেদেনীরা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে সাপ খেলা দেখিয়ে টাকা তুলতো। গ্রামে হলে ফসল তুলতো। এখন আর সে সবের দেখাই মেলে না। আধুনিক মানুষরা আর সাপের খেলা পছন্দ করে না। আগে কিম্বা এখনো স্বল্প পরিসরে হাটে বাজারে ওষুধ ও শারীরিক বৈকল্যের তাবিজ-কবজ বিক্রি করতো সাপুরেরা।
মজমা জমিয়ে অনেক সাপের বাক্স সাজিয়ে খেলা দেখানোর ছলে যৌনরোগের হরেক রকম তাবিজ বিক্রি করতো। এখন আর তাদের দেখাই যায় না। সেদিন রেলস্টেশন বাজার বেদে সর্দার তোজাম্মেল হক জানালেন, আমরা এখন ২০০ ঘর বেদে এখনো আছি ওই এলাকায়। ৫০-৬০ জনে ভাগ হয়ে বিভিন্ন এলাকায় তাম্বু গেরে থাকি। বেদেনীরা যায় শহরে সাপের খেলা দেখাতে। ফেরে সন্ধ্যায়। তাবুতে একজন সর্দার থাকে সেই সব দেখাশুনা করে। পুরুষ এখন নানা রকম কাজ করে। আমি খেলা দেখিয়ে তাবিজ বিক্রি করি।
এখন শিক্ষিত মানুষ জেনে গেছে, বিলাসী গল্পের লেখকের কথা। সাপের বিষ যে বাঙালির বিষ নহে তা আমিও বুঝিলাম। বিজ্ঞান মানুষকে সচেতন করেছে। তাই এখন ওঝার ঝাড়-ফুঁকে বিশ্বাস নেই মানুষের। তারা জানে সাপে কামড়ালে এন্ট্রি-ভেনাম ইনজেকশান নিতে হয়। সরকারী হাসপাতালে সে ইনজেকশান না মিললেও বাজারে বেশি দামে পাওয়া যায়।
টিভি চ্যানেল, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, আইফোন, আইফোন এই প্রজন্মকে বিনোদনমুখী করে রেখেছে। বাইরের ঐতিহ্য থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। ইন্টারনেট-ফেসবুক এর আকর্ষণে মানুষ আর সাপের খেলা দেখে মজা পায় না। রাণীনগর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের অন্তর বলেন, ছোটবেলায় বাজারে গিয়ে দেরী করে ফেলতাম। বাজারে ঢুকতেই সাপুরের তাবিজ বেচা মজমায় দাঁড়িয়ে যেতাম। সাপের খেলা দেখাতাম। ভুলে যেতাম বাজার করার কথা। এখনো বাজারে যাই। সেই মজমা দেখি না।
তিনি বলেন, আসলেই সবকিছু বদলে যাচ্ছে ক্রমশঃ। এসব সম্প্রদায়ের মানুষেরা হয়তো এভাবেই হারিয়ে যাবে আমাদের নৃ-গোষ্ঠিক ঐতিহ্য থেকে। যেমনটি প্রাচ্যাতের উন্নত সমাজে হারিয়ে গেছে। বেদে কুরদান কুমার জানান, নিজেকে রক্ষা করার তাগিত ছাড়া সাপ মানুষকে কামড় দেয় না। অকারণে সাপ দেখলে আমরা নির্বিচারে মেরে ফেলি। এটা ঠিক নয়। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সাপের ভূমিকাও কম নয়।
সাপ রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী শ্যামল কুমার বলেন, সাপ তো আমরা মারি না। সে তো আমারে দেবতাকুল। তবে সাপের খেলায় ব্যাপক বিনোদন ছিল। ছোটবেলায় মজা করে দেখেছি। সাপ আমার ভালোই লাগে। একটু ঠান্ডা প্রাণী। মাঝে-মধ্যে বেদেনীরা আসে এখনো। সাপ দিয়ে ভয় দেখিয়ে, টাকা নেয় দোকান থেকে। তবে আগের মতো আর নেই।
জ্ঞানী ব্যক্তি বলেন, সাপ হলো তিন প্রকার। বিষধর, তীব্র বিষধর এবং নির্বিষ সাপ। সাপে কামড়ালে তিনি ওঝা-সাপুরের কাছে না গিয়ে হাসপাতালে যাবার পরামর্শ দেন।
মন্তব্য চালু নেই