সাত খুনের চার্জশিট : যেভাবে নেওয়া হয় হত্যার প্রস্তুতি

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের অভিযোগপত্রে (চার্জশিট) উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল সাতজনকে অপহরণ ও লাশ উদ্ধারের প্রায় একবছর পর ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল দেওয়া হয় চার্জশিট। এতে উঠে এসেছে সাতজনকে হত্যার আগে নেওয়া দীর্ঘ এক প্রস্তুতির বিষয়টি।

অভিযোগপত্রে (চার্জশিট) মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওই সময়ের জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মামুনুর রশিদ মণ্ডল উল্লেখ করেছেন, কাউন্সিলর নূর হোসেন অবৈধভাবে বিভিন্ন ব্যবসা করে প্রতিদিন প্রায় ৩০/৩৫ লাখ টাকা আয় করতো। তার এসব অবৈধ ব্যবসা থেকে সুবিধাভোগীরা অবাধে যাওয়া-আসা করতো তার কাছে। সাত খুনের ঘটনার ৫/৭ মাস আগে থেকেই র্যা ব-১১ এর উপ-অধিনায়ক মেজর (অব.) আরিফের সঙ্গে নূর হোসেনের সখ্যতা হয়। আরিফকে প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা দিত নূর হোসেন, বলে গ্রেফতারকৃত আসামি রহম আলী আদালতে দেওয়া জবানবন্দীতে উল্লেখ করেছে।

চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, নূর হোসেন একপর্যায়ে মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও সিও লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদকে কাউন্সিলর নজরুলকে টাকার বিনিময়ে অপহরণ, হত্যা ও গুমের প্রস্তাব দেয়। এরপর ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল সকালে আদালতে নজরুলের হাজিরা দেওয়ার তথ্যও জানিয়েছেন। যার প্রমাণ মেজর (অব.) আরিফ হোসেনের মোবাইল ফোনে পাওয়া গেছে।

২০১৪ সালের ৬ এপ্রিল থেকে ২৭ এপ্রিল রাত ১০টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত মামলার প্রধান আসামি কাউন্সিলর নূর হোসেনের মোবাইলে আসামি মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ২৭ বার কল করে কথা বলেছেন, একই সময়ে নূর হোসেন কল করে কথা বলেছেন ১২ বার।

এছাড়া, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুর ১টা ৫৬ মিনিট থেকে রাত ২টা ১১ মিনিট পর্যন্ত মেজর (অব.) আরিফ হোসেন র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদের অফিসের সরকারি টেলিফোন নম্বরে ৪ বার কল করে কথা বলেন এবং তারেক সাঈদ ৭ বার কল করে আরিফের সঙ্গে কথা বলেন। এছাড়া তারেক সাঈদ তার মোবাইল থেকে আরিফ হোসেনের মোবাইলে ২টি এসএমএস পাঠায়।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুর ১২টা ২২ মিনিট থেকে রাত ২টা পর্যন্ত লে. কমান্ডার (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) এমএম রানা তার সরকারি মোবাইল থেকে লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদের সরকারি মোবাইল নাম্বারে ৬ বার কল করে কথা বলেন। একই সময়ে তারেক সাঈদও রানার মোবাইলে ৬ বার কল করে কথা বলেন। এছাড়া তারেক সাঈদ তার মোবাইল থেকে রানার মোবাইলে ২টি এসএমএস পাঠায়। অন্যদিকে, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল রাত ১০টা ৫০ মিনিটে লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ তার সরকারি মোবাইল নম্বর থেকে ঢাকার র‌্যাব হেডকোয়ার্টার্সে কোনও প্রতিবেদন পাঠায়নি।

চার্জশিটে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল রাতে শহরের কালিরবাজারে অবস্থিত র‌্যাব-১১ এর স্পেশাল ক্রাইম প্রিভেনশনাল কোম্পানির ইনচার্জ লে. কমান্ডার (অব্যাহতি প্রাপ্ত) এমএম রানার নির্দেশে র‌্যাব সদস্য ট্রলার চালক এলএস সামাদ, আজম ও রাজ্জাক (আদালতে সাক্ষী প্রদানকারী) নারায়ণগঞ্জ লঞ্চঘাট থেকে কাঁচপুর বিআইডব্লিউটিএ’র ল্যান্ডিং ঘাটে ট্রলার নিয়ে যায়। রাত ১০টা ৩০ মিনিটে টহল পার্টির সহায়তায় র‌্যাব সদস্য এমদাদ, এনামুল, কবির, বেলাল, তাজুল, নাছিরদের মাধ্যমে প্লাস্টিকের বস্তায় ইট ভর্তি প্যাকেট মাইক্রোবাসে তুলে কাঁচপুর ল্যান্ডিং ঘাটে র্যা ব সদস্যদের সহায়তায় ট্রলার ওঠায়।

এজাহারনামার ১নং আসামি নূর হোসেনের পাঠানো আসামি শাহজাহান, রহম আলী, আলী মোহাম্মদ, মর্তুজা জামান চার্চিল, বাসার, জামাল, সেলিম, রিয়াজ, মিজানদের দিয়ে কাঁচপুর বিআইডব্লিউটিএ এর ল্যান্ডিংঘাটের আশেপাশে কোনও লোক যেতে না পারে এজন্য পাহারা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে এবং র‌্যাব সদস্যদের হত্যার পথ সুগম করলে র‌্যাব সদস্যদের ব্যবহৃত ২টি মাইক্রোতে থাকা ভিকটিম নজরুলসহ ৭ জনের মুখে পলিথিন দিয়ে গলায় রশি আটকে শ্বাসরোধে হত্যা করে আসামি মেজর (অব.) আরিফ, এসআই পুর্নেন্দু বালা, হীরা মিয়া, তৈয়ব, আল আমিন, মহিউদ্দিন, আলীম, শিহাব ও অন্যান্য র‌্যাব সদস্যরা ৭টি লাশ ট্রলারে তুলে নেয়।

এরপর তারা ট্রলার নিয়ে রাত আড়াইটার দিকে মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা নদীর মোহনায় পৌঁছে প্রতিটি লাশের সঙ্গে ২টি করে ইটের বস্তা বেঁধে মেজর (অব.) আরিফসহ অন্য র‌্যাব সদস্যরা চাকু দিয়ে নিহত ৭ জনের পেট ফুটো করে মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা নদীর মোহনায় লাশ ফেলে দেয়। ফিরে আসার সময় এসআই পুর্নেন্দু বালা নিহতদের ব্যবহৃত মোবাইল ও সিমকার্ড ভেঙে নদীতে ফেলে দেয়।



মন্তব্য চালু নেই