সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া গিয়ে ঝিনাইদহের শতাধিক যুবকের হদিস নেই, পরিবারে চলছে আহাজারি
অবৈধভাবে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া গিয়ে ঝিনাইদহের শাতাধীক যুবকের কোন হদিস নেই। তারা কোথায় আছেন, জীবীত আছে, নাকি মৃত তা জানে না তাদের পরিবার। ফলে শোকে পাথর হয়ে কান্নার ভাষা হারিয়ে ফেলছেন অনেকে। নিখোঁজ পরিবারগুলোতে চলছে শোকের মাতম। জেলার ৬ উপজেলায় কমপক্ষে শতাধিক যুবক মানবপাচারকারী ও তাদের নিয়োজিত দালালদের খপ্পড়ে পড়ে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়েছিল। তারপর কেটে গেছে মাস এমনকি বছর। খোজ মেলেনি এ সব ব্যক্তিদের। ঝিনাইদহের চিহ্নত মানবপাচারকারীরা এখন র্যাব ও পুলিশের ভয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকলেও তাদের দমনে নেই প্রশাসনের কোন তৎপরতা।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, জেলায় দীর্ঘদিন ধরে মানবপাচারকারীরা সক্রিয়। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই রয়েছে তাদের নিয়োজিত দালাল। দালালদের মাধ্যমে টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায় কথিত এসব আদাম ব্যবসায়ীরা। টাকা আদায়ে ঝিনাইদহের বিভিন্ন আদালতে এমন ভুরিভুরি মামলা আছে। টাকার জন্য ইউপি চেয়ারম্যান, রাজনৈতিক নেতা এমনকি প্রশাসনের লোকজনও বিচার সালিশ করে। তারপরও টাকা আনাদায়ী থাকে। ভিটেমাটি বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে দুই লাখ টাকা নিয়ে সন্তষ্ট থাকতে হয় এমন নজীর রয়েছে অনেক। তবে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর থেকে মানবপাচারকারীদের ভয়ংকর তথ্য ফাঁস হয়ে পড়ে। সরেজমিন বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে জানা গেছে, ঝিনাইদহের ৬টি উপজেলার অন্তত শতাধিক যুবক নিখোঁজ রয়েছেন। ভাগ্যকে গড়ার জন্য দালালদের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা নিয়ে পানি পথে মালোয়েশিয়া যাত্রা করেছিল এ সব নিখোঁজ থাকা যুবকরা। দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও বিদেশগামী এসব যুবকদের পরিবারের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। তারা বর্তমানে কোথায় কি অবস্থায় আছে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন তাদের স্বজনরা। দেশের টিভি ট্যানেল ও পত্রিকার মাধ্যমে পানি পথে মালোয়েশিয়া গমনকারীদের করুণ দৃশ্য দেখে এ সব পরিবারে চলছে এখন শোকের মাতম।
তথ্যানুসন্ধান করে জানা গেছে, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গাড়ামাড়া গ্রামের ৮ যুবক মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়েছেন। এরা হলেন লাল চান, নাজমুল হোসেন, মাসুদ রানা, আলমগীর হোসেন, ওলিয়ার রহমান, ফরিদ হোসেন, রিপন আলী ও আবু বকর। একই গ্রামের মানবপাচারকারি হাসান, আতিয়ার রহমান ও পাশ্ববর্তি গ্রাম রাজ নগরের মোফাজ্জেল হোসেন ও বেড়াশুলা গ্রামের নুরুল হোসেন দুই লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে তাদের মালয়েশিয়া পাচার করেন সমুদ্র পথে।
সদর উপজেলার হিরাডাঙ্গা-সুড়োপাড়া গ্রামের দিনমজুর হাসান আলী, কলেজ ছাত্র রকিব, চরমুরারীদহ গ্রামের কালাম মল্লিক ও রফিউদ্দিন একই গ্রামের মানবপাচারকারী হারুন শাহের মাধ্যমে টাকা দিয়ে মালয়েশিয়া যান। সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের জগত আলী, হামিদ হোসেন, সোনারদাড়ি গ্রামের শরিফুল ইসলাম ও ডেফলবাড়িয়া গ্রামের শামসুল ও বিল্লাল পানি পথে বিদেশ যাওয়ার পথে নিখোজ রয়েছেন। দুই বছর ধরে নিখোঁজ রয়েছেন মহেশপুর উপজেলার সেজিয়া গ্রামের কওছার আলীর ছেলে মোস্তফা কারিকর। কালীড়ঞ্জ উপজেলার মল্লিকপুর গ্রামের লিয়াকতের ছেলে ফিরোজ (২৬), একই গ্রামের আরজ আলীর ছেলে আশিকুল,ওসমানের ছেলে মগরব, রফিউদ্দিনের ছেলে ইমদাদুল (৩২) ও মৃত আব্দুল জলিলের ছেলে আক্কাস আলী (৪৫) তিন মাস ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। এদের সাথে গিয়ে আক্কাস আলী মালয়েশিয়া পৌঁছে বাড়িতে যোগাযোগ করেছে। বাকিদের খোঁজ মেলেনি আজও। মালয়েশিয়াগামী যুবকদের স্বজনরা জানায়, কালীগঞ্জ উপজেলার মল্লিকপুর গ্রামের মানবপাচারকারী দেলোয়ার (৫৫) ও তার স্ত্রী তিন মাস আগে পাঁচ লাখ টাকা চুক্তিতে পাঁচ জনকে মালয়েশিয়া পাঠানোর উদ্দেশ্যে চট্রগ্রামে পাঠায়।
সেখানে দেলোয়ারে আত্মীয় মাগুরার আব্দুল আজিজ ও তার স্ত্রী পারুল বেগম কালীগঞ্জের পাঁচ যুবককে জাহাজে উঠিয়ে দেয়। এরপর দালাল দেলোয়ার চুক্তির টাকা দিতে চাপ দেয়। দেলোয়ারের দেয়া ব্যাংক একাউন্টে ও বিকাশ নম্বরে ৫লাখ টাকা করে ওই পাঁচ যুবকের স্বজনরা তারা পরিশোধ করে। ভাগ্যক্রমে ৫ যুবকদের মধ্যে শুধু আক্কাস আলী মালয়েশিয়া পৌছে বাড়িতে যোগাযোগ ফোন দেন। বাকী ৪ জনের এখনও কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। হরিনাকুন্ডু উপজেলার মকিমপুর গ্রামের মনিরুল ইসলাম, শৈলকূপা উপজেলার আবাইপুর ইউনিয়নের পাঁচপাখিয়া গ্রামের আলম মোল্লা, মোঃ মনিরুল ইসলাম, বাদশা মল্লিক, নিত্যানন্দনপুর ইউনিয়নের রুপদহ গ্রামের রবিউল ইসলাম, ঈমাম আলী, ব্যাসপুর গ্রামের মুকুল হোসেন, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নাকিকেলবাড়ীয়া গ্রামের মামুন ছাড়াও শৈলকূপার রঘুনন্দনপুর ও রুপদাহ গ্রামের আরো ১০/১২ জনের হদিস মিলছে না।
মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে নৌকা থেকে লাফ দিয়ে ফিরে এসেছেন হরিণাকুন্ডুর মকিমপুর গ্রামের সেলিম। তিনি অভিযোগ করেন, সদর উপজেলার হিরাডাঙ্গা গ্রামের হারুশাহ তাকে বিদেশ নিয়ে যায়। হারুশহ এর সহযোগি হলেন, মানব পাচারকারী পিন্টু, কালাম ও রফিক। সুড়োপাড়া গ্রামের আব্দুর রহমান ও আনসার আলী অভিযোগ করেন হারুশাহ হাসান এবং রাবিককে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের কাছ থেকে টাকা গ্রহন করেছে পবহাটী গ্রামের মৃত মকবুল হোসেনের ছেলে আফাঙ্গীর হোসেন।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের বুদো মালিথার ছেলে আশাদুল ৬ জনের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে বিদেশ পাঠাতে পারেনি। সদর উপজেলার কাশিমনগর গ্রামের আনোয়ার হোসেন মন্ডলের ছেলে খলিলুর রহমান ও একই গ্রামের ইজ্জত আলীর ছেলে আজিজুর রহমান ২০০১ সালে বহু মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আত্মসাত করেছে বলে বংকিরার কয়েক ব্যক্তি অভিযোগ করেন।
এদিকে স্বজনদের সন্ধান না পেয়ে এলাকাবাসী বুধবার বিকালে সদর উপজেলার হিরেডাঙ্গা গ্রামের তোফাজ্জেল শাহ’র ছেলে হারুন শাহকে আটক করে র্যাব খবর দেয়। খবর পেয়ে র্যাব ঘটনাস্থলে পৌছানোর আগেই হারুনের সহযোগী খায়রুল, ইমদাদুল ও মাজেদুল ধারালো অস্ত্র নিয়ে এলাকাবাসির উপর হামলা চালিয়ে হারুনকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পুলিশের আশংকা ঝিনাইদহ সদর, হরিনাকুন্ডু, কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর ও মহেশপুর উপজেলায় অন্তত শতাধিক যুবত অবৈধভাবে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড গমনের পর থেকেই নিখোজ রয়েছে। জেলায় মানবপাচারকারী শক্তিশালী চক্র রয়েছে এমন সুনিদ্দিষ্ট অভিযোগের পারও এই চক্রের সদস্যদের আটক করা সম্ভব হচ্ছে না।
বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহ পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন জানান, তিনি লোকমুখে শুনেছেন জেলার শাতাধীক যুবক মালয়েশিয়া গিয়ে নিখোঁজ রয়েছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মামলা হয়েছে দুইটি। পুলিশ ইতিমধ্যে পাচারকারী আতিয়ার রহমানসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশ সুপার বলেন ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো এ বিষয়ে আইনগত সহায়তা চাইলে প্রদান করা হবে। ঝিনাইদহের সহকারী পুলিশ সুপার গোপিনাথ কানজিলাল বলেন, সদর উপজেলার হারুশাহ সহ অন্যান্য মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।
মন্তব্য চালু নেই