দীপন হত্যা

সন্দেহ আর অনুমানে তদন্ত

তদন্তে শুধুই অনুমান শুধুই সন্দেহ। হশুধু সন্দেহ ও অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই চলছে জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যাকাণ্ডের তদন্ত। সংগৃহীত সিসিটিভি ফুটেজে র‌্যাব তিন যুবককে সন্দেহের কথা বললেও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বলছে, ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তারা কিছুই পায়নি। এখনো অনেকটা অন্ধকারেই হাতরাচ্ছে ডিবি পুলিশ। ডিবির কয়েকজন কর্মকর্তা আগের দেওয়া বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি টেনে বলেছেন, শাহবাগে প্রকাশক দীপন হত্যা এবং লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে হত্যাচেষ্টার ঘটনাটি উগ্রপন্থি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরাই ঘটিয়েছে।

অন্যদিকে, আতঙ্ক কাটছে না লেখক-মুক্তচিন্তার মানুষদের। গত সোমবার গভীর রাতে লেখক-সাংবাদিক আহ্সান কবীর নিরাপত্তার শঙ্কায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। এর আগে সময় প্রকাশনের প্রকাশক ফরিদ আহমেদ ধানমন্ডি থানায় জিডি করেছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ব্লগার অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, ও নীলাদ্রি নিলয়সহ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দীপন হত্যাকাণ্ডের যথেষ্ট মিল রয়েছে। একই মতাদর্শের দুর্বৃত্তরাই দীপনকে হত্যা করেছে। শুধু তাই নয়, তাদেরই অপর একটি দল প্রায় একই সময়ে লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের প্রকাশক টুটুলসহ তিনজনকে হত্যার চেষ্টা চালায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই হয়তো দুর্বৃত্তরা অনুসরণ করেছিল দীপনকে। রেকি করেছিল শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেট এবং লালমাটিয়ার শুদ্ধস্বরের অফিসের অবস্থান। তবে টুটুলসহ তিনজন যে বেঁচে যাবেন এমনটি হয়তো তারা কল্পনাও করেনি। তিনি আরও বলেন, খুনিরা যেই হোক না কেন পালিয়ে পার পাবে না। সূত্র আরও জানায়, ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা এখন মূলত তাদের স্লিপার সেলের মাধ্যমে টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের খুন করছে। স্লিপার সেলের নেপথ্যে থেকে কারা ইন্ধন দিচ্ছে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। তবে দুর্বৃত্তদের তৎপরতা এখনো থেমে নেই। গোপনেই তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে নিশ্চিত গোয়েন্দারা।

এদিকে, দীপন হত্যা মামলার তদন্তে সিসিটিভি ফুটেজ থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম। রাজধানীর ইস্কাটনে একটি সেমিনার শেষে গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি বলেন, সব দিক বিচারে লালমাটিয়া ও শাহবাগের দুই হামলায় একই ধরনের জঙ্গি গ্রুপ অংশ নিয়েছে বলে ধারণা করছেন তারা।
মনিরুল ইসলাম বলেন, দুটি হত্যাকাণ্ড প্রায় একই সময়ে ঘটেছে। আঘাতের ধরন এবং অন্যান্য আলামত বিশ্লেষণে আমাদের কাছে মনে হয়েছে একটি গ্রুপ এই কাজটি করে থাকতে পারে। সিসিটিভি ফুটেজ সংগৃহীত হয়েছে কিন্তু তাতে এখন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মুনতাসিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, শাহবাগ থানার দীপন হত্যা মামলার পর মোহাম্মদপুর থানায় শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদর রশীদ চৌধুরী টুটুলের করা মামলাটির তদন্তভার ডিবিতে স্থানান্তরিত হয়েছে। যদিও ডিবি আগে থেকেই মামলাটির ছায়া তদন্ত শুরু করেছিল।

প্রসঙ্গত, গত শনিবার রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় নিজ প্রকাশনীর অফিসে খুন হন দীপন। এর ঠিক কিছু আগে লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের প্রকাশক টুটুলসহ তিন মুক্তমনা ব্যক্তিকে কুপিয়ে এবং গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা।

সব ব্লগার ও প্রকাশক হত্যার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চায় জাতিসংঘ :
প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন ও সাম্প্রতিক সময়ে সব ব্লগার হত্যার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। একই সঙ্গে এ ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার আহ্বানও পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে মহাসচিব বান-কি মুনের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক এসব কথা বলেন।
ডুজারিক বলেন, বাংলাদেশে প্রকাশককে হত্যা করতে দেখেছি, আমাদের অবশ্যই তার তীব্র নিন্দা জানানো উচিত। সাংবাদিক হত্যা-সংক্রান্ত তথ্য উল্লেখ করে জাতিসংঘের মহাসচিবের বরাত দিয়ে মুখপাত্র বলেন, গত ১০ বছরে ৭০০-এর বেশি সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৭ শতাংশ সাংবাদিক হত্যা মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া ১০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মধ্যে একটির কম ঘটনার পূর্ণ তদন্ত হয়েছে। সাংবাদিকরা যাতে স্বাধীনভাবে প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেন এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিশ্ববাসীকে আরও কাজ করতে হবে বলে উল্লেখ করেন জাতিসংঘ মহাসচিব।

নিরাপত্তার শঙ্কায় জাগৃতি লেখকের জিডি :
রাজধানীর বনানী থানায় নিরাপত্তার শঙ্কায় জাগৃতি প্রকাশনীর লেখক আহসান কবির সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। সোমবার রাতে তিনি এ জিডি করেন (নম্বর-১১৮)। আহসান কবির একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান। বনানী থানার এসআই জিয়াউল আলম জিডির বিষয় নিশ্চিত করেন।
এ বিষয়ে আহসান কবির সাংবাদিকদের বলেন, ৩১ অক্টোবর তিনজনকে আহত ও একজনকে মেরে ফেলার পর আনসার আল ইসলাম আল-কায়েদা উপমহাদেশ শাখা টুইটারে একটা বিশ্লেষণ দেয়। বিশ্লেষণের শিরোনাম ‘আহমেদুর রশীদ টুটুল ও ফয়সল আরেফিন দীপনের অপরাধসমূহ’। সেখানে দীপনের অপরাধ দুটি।
তাদের ভাষ্যমতে, একটা অপরাধ হলো অভিজিৎ রায়ের ‘বিশ্বাসের ভাইরাস ও অবিশ্বাসের দর্শন’ ছাপানো। সেখানে ইসলামকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। ফয়সল আরেফিন দীপনের দ্বিতীয় অপরাধ হিসেবে লেখা হয়, আলেম-ওলামাদের কটাক্ষ করে আহসান কবিরের রম্য লেখা ছাপানো। ওই বিশ্লেষণ প্রকাশের পর তিনি নিরাপত্তা শঙ্কায় এ জিডি করেন। জিডিতে উল্লেখ করেছি, আমার কোনো বইয়ে কোনো ধর্মের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো শব্দ বা বর্ণও লিখিনি।

জানা গেছে, নিহত ফয়সল আরেফিন দীপনের জাগৃতি প্রকাশনী থেকে তার ১৬টি বই বেরিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘গণতান্ত্রিক গণ্ডার’, ‘আপা ম্যাডাম ও থুথু বাবার দেশে’, ‘নিখোঁজ, নিহত নয়’, ‘তালিকাভুক্ত’ ইত্যাদি।

দীপন হত্যা :
তদন্ত প্রতিবেদন ৭ ডিসেম্বর দাখিলের নির্দেশ : প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ৭ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেছেন আদালত। এজাহার গ্রহণ করে ঢাকা মহানগর হাকিম মো. ইউনুস খান এ আদেশ দেন।
এর আগে শনিবার বিকালে রাজধানীর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় দীপনের স্ত্রী বুধবার শাহবাগ থানায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় কোনো আসামির নাম কিংবা সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি।

এ ছাড়া শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে হত্যা চেষ্টার মামলা তদন্ত করে আগামী ২ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম লুৎফর রহমান শিশির মামলার এজাহার গ্রহণ করে এ আদেশ দেন। রাজধানীর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে শনিবার টুটুল ও দুই লেখককে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। পরে এ ঘটনায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা চেষ্টার মামলা করেছেন টুটুল। মামলায় আসামিদের নাম কিংবা সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি। দীপন ও টুটুল দুজনই নিহত লেখক অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক। বর্তমানে মামলা দুটির তদন্ত করার দায়িত্ব পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তবে এখনো কোনো আসামিকে শনাক্ত কিংবা গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।



মন্তব্য চালু নেই