সত্যি সত্যিই ছক্কা মারলেন শিক্ষাসচিব
২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষে দেশের সব কলেজে একাদশ শ্রেণিতে অনলাইনে ভর্তির নির্দেশনা জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ভর্তি কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর ১১ লাখ শিক্ষার্থীর ৩৩ লাখ আবেদন সমন্বয়ের মাধ্যমে ভর্তির জন্য ১ম মেধা তালিকা প্রকাশে বিলম্ব হওয়ার পর থেকে ডিজিটাল ভর্তি পদ্ধতি এবং শিক্ষা সচিব মহোদয়ের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠে।
এই বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমে বিভিন্ন মজার মজার শিরোনামও দেখা যায়। যেমন-ছক্কা মারতে চেয়েছিলেন শিক্ষাসচিব জটিলতা শিক্ষা সচিবের মাতবরিতে মন্ত্রী-সচিব দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে ‘সচিব নজরুলের ডানা ছাঁটলেন শিক্ষামন্ত্রী একাদশে ভর্তি নিয়ে তুলকালাম ইত্যাদি ইত্যাদি।
শিরোনাম দেখে সংবাদগুলো পড়ে শিক্ষা সচিব এবং অনলাইন ভর্তি পদ্ধতি সম্পর্কিত যে সমালোচনাগুলো হয়েছে সেগুলো মোটামুটি এরকমের: শিক্ষামন্ত্রীর লিখিত নির্দেশনা অমান্য করে শিক্ষা সচিব কর্তৃক ভর্তি নীতিমালা জারি করা, যথেষ্ট প্রস্তুতি এবং লোকবলের অভাব, লাখ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবে না, শিক্ষা সচিবের চাপিয়ে দেয়া ডিজিটাল নীতিমালার কারণে বোর্ড কর্মকর্তাদের গলদঘর্ম হওয়া, ভুলে ভরা মেধা তালিকা প্রকাশ যেমন- ছাত্রী কলেজের মেধা তালিকায় ছাত্রদের নাম প্রকাশ হওয়া, বিজ্ঞান কলেজে বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ হওয়া তথা ভুল বিভাগ মনোনয়ন, শিক্ষার্থীদের অনেকেই পছন্দের কলেজ না পাওয়া এবং এসবের প্রেক্ষিতে মন্ত্রী-সচিবের দ্বন্দ্ব এবং সচিবের ক্ষমতার লাগাম টানা বা ডানা ছাটার কল্পকাহিনী।
সমালোচনাগুলো একটু খতিয়ে দেখা যাক। শিক্ষামন্ত্রীর লিখিত নির্দেশনা অমান্য করে শিক্ষা সচিব কর্তৃক ভর্তি নীতিমালা জারি করা প্রসঙ্গে গত ০৯ জুলাই -২০১৫ তারিখের কালের কণ্ঠ পত্রিকায় সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব আলী ইমাম মজুমদার মহোদয়ের বক্তব্য উল্লেখ করা-ই যথেষ্ট বলে মনে করি। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, রুলস অব বিজনেসে কার দায়িত্ব কী তা বলা হয়েছে। তবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ‘ডেলিগেশন অব পাওয়ার’-এ কর্মকর্তা পর্যায়ে নিষ্পত্তিযোগ্য কাজের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। কাজেই মন্ত্রী-সচিবের কাজ নিয়ে দ্বন্দ্ব হওয়ার কোনো কারণ নেই। গুরুত্বপূর্ণ পলিসি হলে মন্ত্রী পর্যায়ে নিষ্পত্তি হতে হবে। মন্ত্রী যদি সব কাজ নিজে দেখতে চান সেটা হবে অসম্ভব একটি বিষয়। সব ফাইল মন্ত্রীর কাছে পাঠানো অবাস্তব। এটা কখনোই সম্ভব নয়। প্রতিটি কর্মকর্তার কাজই নির্ধারিত। তাঁরা এর বাইরে যেতে পারেন না।
এ সম্পর্কে শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, একজন কর্মকর্তার কী কাজ তা রুলস অব বিজনেসে বলা আছে। আমার রুলস অব বিজনেসের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর মন্ত্রী হচ্ছেন চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ। তাঁরা যা বলবেন আমাদেরও সেভাবেই কাজ করতে হবে।’
যথেষ্ট প্রস্তুতি এবং লোকবলের অভাব সম্পর্কে যাই, পরীক্ষার ঝামেলায় যদি পড়া না হয় তাহলে কার কি করার আছে। লোকবলের অভাব নেই। আছে কাজ করার ইচ্ছার অভাব। কেননা পিএসসি , জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসির রেজিস্ট্রেশন, পরীক্ষার ফরম পূরণ, ফলাফল প্রকাশ সবই তো অনলাইনে হয়। সেখানে তো এই বিষয়ে পারদর্শী লোকবল আগে থেকেই নিয়োজিত আছে। আর প্রস্তুতি বলতে যদি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা বোঝানো হয় তবে কিছু বলার নেই।
লাখ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবে না – শিক্ষা ব্যবসায়ীদের অপপ্রচারমূলক এই কথাটি মোটেই সঠিক ছিল না তা এখন স্পষ্ট। কেননা পাসকৃত শিক্ষার্থীর চেয়ে কলেজের আসন সংখ্যা বেশি। শিক্ষামন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী পাশ করা সকল শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার পরেও দুই লাখের বেশি আসন ফাঁকা থাকবেই। আর পৃথিবীর কোন দেশেই শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত হয় না। আমাদের দেশে প্রতিবছরই কিছু ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে, কিছু ছাত্রের দারিদ্রতার কারণে কর্মে ঢুকে যাওয়ায় একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয় না।
শিক্ষা সচিবের চাপিয়ে দেয়া ডিজিটাল নীতিমালার কারণে বোর্ড কর্মকর্তাতের গলদঘর্ম হওয়া বিষয়ে বলা যায়, বোর্ড কর্মকর্তাদের গলদঘর্ম হওয়ার কি আছে। তারাতো সফটওয়্যার তৈরি করেনি। শুধুমাত্র তাদের কাছে রক্ষিত তথ্য বুয়েটকে সরবরাহ করেছে। আর বোর্ড কর্মকর্তা মহোদয়েরা তো সারাবছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়েই কাজ করেন। তাদের কাছেই তো সঠিক তথ্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
তাছাড়া আর একটি বিষয় হলো অনলাইন ভর্তি পদ্ধতি একটি কারিগরি বিষয়। বিদেশ থেকে বিপুল টাকা খরচ করে আমদানি না করেই দেশের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েটের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে ভর্তি সংক্রান্ত সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে। যারা ভর্তি প্রক্রিয়ার ১ম ধাপ থেকে ৪র্থ ধাপ পর্যন্ত ওয়েবসাইটটি পর্যবেক্ষণে রেখেছেন বা ভর্তি সংক্রান্ত কাজ করেছেন তারা সহজেই বুঝতে পারবেন, প্রতিনিয়ত সকল জটিলতা দূর করে ওয়েবসাইটটিকে সহজে ব্যবহার উপযোগী করতে বুয়েটের শিক্ষকদের কত বিশাল অথচ সূক্ষ কর্মযজ্ঞ সস্পাদন করতে হয়েছে। তাই গলদঘর্ম হলে হয়েছেন সফটওয়্যার তৈরিতে নিয়োজিত দেশপ্রেমিকরা। সর্বোপরি আমাদের মনে রাখতে হবে কোনো ভাল কাজের শুরুতে কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, কিছুটা কাজের চাপ বাড়তে পারে। নিজেদের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে একটু গলদঘর্ম হলে ক্ষতি কি?
ভুলে ভরা মেধা তালিকা প্রকাশ প্রসঙ্গে বলা যায়, বোর্ডগুলোর দেওয়া তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর বুয়েট স্মার্ট এ্যাডমিশন সফটওয়্যার তৈরি করেছে। যেমন ঢাকা বিজ্ঞান কলেজে বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অথচ ওই কলেজে বাণিজ্য বিভাগই নেই। অথচ কোন কলেজে কোন বিভাগ চালু আছে, মহিলা কলেজ না কো-এডুকেশন ইত্যাদি তথ্য বোর্ডগুলোই সরবরাহ করেছে। কলেজ না সে সফটওয়্যার ত্রুটির কথা বলে বুয়েটকেও প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হলেও এটি বুয়েট বা ডিজিটাল ভর্তিপদ্ধতির দোষ নয়। দোষ যারা তথ্য দিয়েছেন তাদের।
শিক্ষার্থীদের অনেকেই পছন্দের কলেজ না পাওয়া প্রসঙ্গে বলা যায়, হাতেগোনা কয়েকটি কলেজে আসন সংখ্যার ১৫ গুণ বেশি আবেদন জমা পড়েছে।কিন্তু এই কলেজগুলোতে অনুমোদিত আসন সংখ্যার বেশি ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করাতো সম্ভব নয়। আর ইচ্ছামতো আসন বাড়ানোর ক্ষমতাও সকল ভাল কলেজগুলোর নেই। এইজন্য ইচ্ছা করলেই কখনই ভাল কলেজগুলোতে সবাই ভর্তি হতে পারবে না। তবে অনলাইন ভর্তি পদ্ধতি চালু হওয়ায় এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে যথেষ্টসংখ্যক মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান দেশে নেই। সুতরাং ডিজিটাল ভর্তি পদ্ধতির সমালোচনা না করে ভবিষ্যতে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই কিভাবে মানসম্পন্ন করা যায় সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।
এসব নিয়ে মন্ত্রী-সচিব দ্বন্দ্বের বিষয়টিকে একটি অলিক কাহিনী বলা যায়। কেননা শিক্ষামন্ত্রী ইচ্ছা করলেই এই ভর্তি পদ্ধতিটি বাতিল করে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি বাতিল না করে বরং কিছু ভুলের কারণে নিজেই মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দু:খ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছেন। বলেছেন, ‘সবাই মিলেই কাজ করবো, সফল হলে সবাই হবো, ব্যর্থ হলেও সবাই হবো। নাহিদ বলেন, “বড় কাজ করতে গেলে ছোট ভুল হতেই পারে। তবে এটা হোক আমরা তা চাই না। এটা উন্নয়নের সমস্যা, উন্নয়নের বেদনা।’ অন্যদিকে শিক্ষাসচিব সব দায় নিজের কাধেঁ তুলে নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে বক্তব্য দিয়েছেন। এটা কি প্রমাণ করে না যে, মন্ত্রী-সচিবের মধ্যে দ্বন্দ্ব নয় বরং সুন্দর টিমওয়ার্ক হয়েছে, যা সফলতার অন্যতম শর্ত।
সমালোচনা যা-ই থাকুক না কেন নতুন ভর্তি পদ্ধতির সফলতা অনেক বেশি। এই পদ্ধতির প্রয়োগের কিছু উল্লেখযোগ্য ভাল দিক হলো- এর ফলে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। আরো কমে গেছে ছাত্র সংগঠনের কোটি কোটি টাকার ভর্তি বাণিজ্য, এনিয়ে লবিং-গ্রুপিং এবং সংঘর্ষের ঘটনা। প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে স্বজনপ্রীতি , আমলা ও নেতাদের দৌরাত্ম এবং শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা। পাওয়া গেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। যেমন – এবার ১৩৯ টি উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য আবেদন করেনি। দুর্নীতির মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেয়া হয়েছে পত্রপত্রিকায় এমন খবরও প্রকাশিত হয়েছে। জানা গেল, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা, আসন সংখ্যা, ভর্তিকৃত এবং ভর্তি না হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। আরো পাওয়া গেল, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ধারণা। আর অনলাইন ভর্তি পদ্ধতির মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা খাত আর একধাপ এগিয়ে গেল একথা নির্দিধায় বলা যায়।
সীমিত দূর্বলতার পাশাপাশি ভর্তি ফরম পূরণে শিক্ষার্থীদের অসতর্কতা, একজনের আবেদন অন্য আরেকজন বা প্রতিষ্ঠান করে ফেলায় এমন কিছু বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলেও শেষ বিচারে উপকৃত হয়েছে শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবকরা এবং শিক্ষাব্যবস্থা। তাই সমালোচনা থাকলেও জনস্বার্থে কাজটি করে সত্যি সত্যিই ছক্কা মেরে সমালোচকদের সমুচিত জবাব দিলেন শিক্ষাসচিব। তার বক্তব্য দিয়েই লেখাটা শেষ করতে চাই, ‘আমি মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের নেতৃত্বে স্পেসিফিকালি টি-টোয়েন্টি খেলছি। শুধু টি-টোয়েন্টি না, টি-টোয়েন্টির লাস্ট ওভার খেলছি। পরামর্শ করে টিম স্পিরিট নিয়ে ডেফিনেটলি কাজ করছি। ছক্কা মারার চেষ্টা করছি, ছক্কা মারতে গেলে অনেক সময়… আউট হয়, সেটা হতে পারে।
লেখক: এস এম খায়রুল বাসার, অধ্যক্ষ, পল্লীমঙ্গল কলেজ
মন্তব্য চালু নেই