সংসারে অভাবের তাড়নায় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সুবর্ণার কাঁধে লাঙল জোয়াল

সুবর্ণা আক্তারের বয়স ১৩। সে ফরিদপুর সদর উপজেলার ৩৬ নম্বর চরটেপাখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। তার বাবা দরিদ্র কৃষক। সম্পত্তি বলতে দুই বিঘা জমি। ওই জমি চাষ না করলে সংসার চলে না। চাষ করার জন্য বলদ নেই। আবার শ্রমিক নিয়োগ বা ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করানোর আর্থিক সামর্থ্যও নেই। সুবর্ণা প্রতিদিন চার কিলোমিটার হেঁটে বিদ্যালয়ে যায়। আবার চার কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরে চলে যায় মাঠে। সেখানে বাবা-মায়ের কাজে সহযোগিতা করে। প্রয়োজনে জোয়ালও কাঁধে নেয়।

তার বাবার নাম আবুল কাশেম (৫৫)। তিনি সদর উপজেলার পদ্মা নদী সংলগ্ন নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের সুলতান খাঁর ডাঙ্গি গ্রামের মৃত শেখ হেলালউদ্দিনের ছেলে। কাশেম হাঁপানি রোগে আক্রান্ত। অকাল বার্ধক্যে তাঁর শরীর সব সময় কাঁপে। তিনি পরিশ্রম করতে পারেন না। কাজের জন্য তাই তাঁকে স্ত্রী শাহেদা বেগম (৩৭) ও মেয়ের ওপর ভরসা করতে হয়। তারাই বীজতলা তৈরি, বীজ বোনা, ক্ষেতে পানি দেওয়া, আগাছা পরিষ্কারের কাজ করে।

গত ৪, ৫, ও ৬ ফেব্রুয়ারি সরেজমিনে দেখা গেছে, কাশেমের মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে একটি ঘর। এর বাইরে দুই বিঘে জমিতে ফসল ফলিয়ে সংসার চলে। তাঁর ফজলুল ও রেজাউল নামের দুই ছেলে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। তাঁদের আলাদা সংসার। মা, বাবা ও ছোট বোনের জন্য দুই ভাই কোনো সহায়তা করতে পারেন না। অসুস্থ আবুল কাশেম অতি কষ্টে সংসারের জোয়াল টানতে পারলেও ষাঁড় না থাকায় ক্ষেতে বীজতলা তৈরিতে বাধ্য হয়ে স্ত্রী ও মেয়েকে সঙ্গে নেন।

আবুল কাশেম কাঁপা কাঁপা গলায় আক্ষেপ করে বলেন, ‘হালের বলদ নাই। যদি থাকত তাহলে আর নিজের স্ত্রী ও মেয়েকে দিয়ে জোয়াল টানাতে হতো না। কি করেই বা থাকবে? ৩০-৪০ হাজার টাকার কমে তো একটি বলদ (ষাঁড়) কিনতে পাওয়া যায় না। একসঙ্গে এতগুলো টাকা কোথায় পাব?’

কাশেম জানান, পদ্মা নদী ভাঙনের শিকার দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় ভাগে মাত্র দুই বিঘে জমি পেয়েছেন তিনি। ওই জমিতে চাষাবাদ করেই সংসার চালাতে হয়। কয়েক দিন আগে জমি থেকে পাঁচ মণ সরিষা তুলে বাড়ির উঠোনে রেখেছেন। এখনো মাড়াই করা হয়নি। পাঁচ মণ সরিষা উৎপাদনে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এই সরিষা বিক্রি হবে ১০ হাজার টাকায়। তিনি বলেন, ‘বেরো চাষের সময় চলে যায় দেখে জমিতে আমার সঙ্গে স্ত্রী শাহেদা ও মেয়ে সুবর্ণাও কাজ করছে। ওরা দুই দড়ি-বাঁশের তৈরি জোয়াল টেনেছে। আর আমি পেছনে বসে মই ধরে রেখে জমি সমান করেছি। এভাবে টানা ১৫ দিনের চেষ্টায় বীজতলার কাজ শেষ করেছি। এখন টানা তিন মাস ক্ষেতে প্রতিদিন সকাল ও বিকেল দুই বেলা পানি দিতে হবে। ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিনের ভাড়া ছাড়াও প্রতিদিন দুই লিটার ডিজেলের দরকার হয়। দুই লিটার ডিজেল কিনতে ১৪০ টাকা লাগে। যেদিন ডিজেল কিনতে পারি না সেদিন আমি ও আমার স্ত্রী মিলে কলস ভরে ক্ষেতে পানি দেই। স্কুল বন্ধ থাকলে মেয়ে সুবর্ণা আমাদের সাহায্য করে। ‘

কাশেম জানান, এভাবে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত পানি দিতে পারলে দুই বিঘা জমিতে ৫০ মণ ধান হতে পারে। ফসল ওঠার পর বাজারের দাম অনুযায়ী ধান বিক্রি হবে। তিনি আশা করছেন, এ বছর প্রতি মণ ধান সাত শ টাকা করে বিক্রি করতে পারবেন।

কাশেম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘সেই ছোটবেলা থেকে জমিতে কাজ করছি। কিন্তু নিজের জন্য কোনো সঞ্চয় করতে পারিনি। এখন মেয়েটার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে দিশেহারা হয়ে যাই। ‘

কাশেমের স্ত্রী শাহেদা বেগম বলেন, ‘গরিবের কী চাওয়ার থাকবে? দিনভর কষ্ট করি দুই মুঠো ভাতের জন্য। সে জন্য মাঠেও কাজ করি। এতে আর এমন কি কষ্ট হয়?’

সুবর্ণা বলে, ‘পড়ালেখা শেষ করে অনেক বড় হওয়ার ইচ্ছে আছে। তাই বিদ্যালয়ে যেতে চার কিলোমিটার পথের দূরত্ব আমার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। মাঠে মা ও বাবার সঙ্গে কাজ করতে মোটেও কষ্ট হয় না। ‘ তাঁর মতে, ‘চেষ্টা না করলে তো ভালো কোনো কিছু পাওয়া যায় না। ‘

আবুল কাশেমের ছোট ছেলে রেজাউল বলেন, ‘যতটুকু সহায়তা করার দরকার সেটা করতে পারি না। সন্তান হিসেবে মা-বাবার প্রতি যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে তা পালন করতে না পেরে একটু তো কষ্ট হয়। কিন্তু কী করব? সামর্থ্য নেই যে। ‘

নর্থচ্যানেল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোস্তাকুজ্জামান বলেন, ‘শারীরিকভাবে অসুস্থ কৃষক আবুল কাশেমের পরিবারের প্রতি স্থানীয়রা সবাই সহানুভূতিশীল। ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও তাঁকে সহায়তা করা হয়। কিন্তু সেটা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্যই। কাশেমকে সহায়তা করতে আমি সমাজের বিত্তবান ও বিবেকবান মানুষের প্রতি অনুরোধ জানাই। ‘



মন্তব্য চালু নেই