শ্বাসরোধেই আফসানার মৃত্যু, লাপাত্তা রবিন

মিরপুর সাইক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী আফসানা ফেরদৌসীর মৃত্যু শ্বাসরোধের কারণে হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ। গলায় দাগ ছিল উল্লেখ করে ময়নাতদন্তকারী সহকারী অধ্যাপক আবুল খায়ের মো. সফিউজ্জামান বলেন,‘এটা আত্মহত্যা না হত্যা এখনই বলতে চাই না। সেটা মন্তব্য করা হয়ে যাবে। তবে শ্বাসরোধে নিহত হয়েছেন তিনি।’এদিকে, আফসানা ফেরদৌস নিহত হওয়ার পর থেকেই ছাত্রলীগের তেজগাঁও কলেজ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান রবিন লাপাত্তা। গত শনিবার থেকেই কলেজে আসছেন না দাবি করেছেন অন্য রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। আর কলেজে দাপুটে ও সক্রিয় নেতা রবিনকে এখন আর নিজেদের কেউ বলে স্বীকারও করছে না ছাত্রলীগ।খবর বাংলা ট্রিবিউনের।

পরিবারের পাশাপাশি আফসানার সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন থেকেও দাবি করা হয়েছে, তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের নেতা রবিন ও তার সহযোগীরা আফসানাকে হত্যা করেছে। তাদের দাবি অন্যান্য অনেক ঘটনার মতো এটিকেও ‘আত্মহত্যা’বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।

শনিবার নিহত অবস্থায় পাওয়ার পর থেকে তার পরিবারের কাছে টেলিফোনে ‘সমঝোতার প্রস্তাব’যায় তেজগাঁও কলেজের সাংগাঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান রুবেলের পক্ষ থেকে। এরপরই আফসানার পরিবারের শঙ্কা, ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের নেতা হওয়ায় বিভিন্ন রিপোর্ট ও তদন্তে হস্তক্ষেপ করতে পারেন রবিন। তবে বুধবার থেকে সবকটি গণমাধ্যমে সংবাদ ও ফোন নম্বরগুলো প্রকাশিত হওয়ায় আর কোনও ‘সমঝোতা’র জন্য ফোন আসেনি উল্লেখ করে আফসানার ভাই ফজলে রাব্বী বলেন, আমাদের বোন কখনও আত্মহত্যা করতে পারে না। আর তার সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছে, সেখানে সে আমার সঙ্গে ঈদের পরিকল্পনা পর্যন্ত করেছে। এখন আমাকে বললেই হলো, সে আত্মহত্যা করেছে।

ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল খায়ের মো. সফিউজ্জামান বলেন, ময়নাতদন্তে বিস্তারিত সবই দেখা হয়। প্রথমে তাকে শনাক্ত করা না যাওয়া এবং পরবর্তী সময়ে পরিচয় শনাক্ত হওয়ার কারণে আমরা ডিএনএ প্রোফাইলিং করছি। এছাড়া গলায় অর্ধচন্দ্রকার দাগ থাকার পুলিশি দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব আমি আর বলতে চাই না। তবে শ্বাসরোধে মৃত্যু এটা নিশ্চিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘তবে ধর্ষণের কোনও আলামত পাওয়া যায়নি। তিনি অন্তঃসত্ত্বাও ছিলেন না।’ আত্মহত্যা করলে শারীরিক কী কী পরিবর্তন আসে, তা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানেন এবং এক্ষেত্রে সেসব দেখেছেন কিনা জানতে চাইলে সফিউজ্জামান বলেন, ‘এটা বললেই মন্তব্য করা হয়ে যায়। আমি এখন কিছু জানাব না।’

ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্য রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা বলছেন, বরিশালের ছেলে রবিন তেজগাঁও কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ছাত্রলীগের সাংগাঠনিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রতিদিন ক্যাম্পাসে উপস্থিত থেকে নানা কর্মসূচি ও মহড়ায় থাকার কারণে তিনি পুরো কলেজে পরিচিত মুখ। তাকে চেনে না এমন শিক্ষার্থী কম আছে। তিনি সবসময় দলবল নিয়ে ঘুরতেন।

এরইমধ্যে রবিনের সহযোগীরা ছাত্র ইউনিয়নের কলেজ শাখার ওপর হামলা চালিয়েছে। কলেজ ইউনিয়ন সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, রবিনকে ছাত্রলীগের প্রতিটি কর্মসূচিতে সক্রিয় দেখেছি। সে নেতৃত্ব পর্যায়ে ছিল এবং প্রতিদিনই ক্যাম্পাসে তার সরব উপস্থিতি ছিল। এরইমধ্যে তাকে ছাত্রলীগের কেউ না বলাটাও রহস্যজনক। তিনি বলেন, বুধবার (১৭ আগস্ট) আমরা কলেজে ইউনিয়নের টেন্টে বসে ছিলাম। ওই সময় কয়েকজন হুট করে এসে আমাদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে। পরে মারধর করায় আমদের কয়েকজন গুরুতর আহত হয়।

ছাত্রলীগের তেজগাঁও কলেজ শাখার সভাপতি কামরুজ্জামান বলেন, ‘তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় কুড়ি হাজার। কেউ যদি ছাত্রলীগের পরিচয় দিয়ে থাকে, তাহলে আমার পক্ষে সেটা বের করা সম্ভব নয়। রবিন আমাদের সংগঠনের কেউ না।’

উল্লেখ্য, নেতাকর্মীরা এখন অস্বীকার করলেও রবিনের ফেসবুকজুড়ে তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগ সেক্রেটারি মিথুন ঢালীর সঙ্গে নানা কর্মসূচির ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ফেসবুক প্রোফাইলে কেবল কর্মী নয়, সাংগঠনিক সম্পাদক লেখা আছে জানানো হলে কামরুজ্জামান বলেন, তিনি ছাত্রলীগের কেউ নন। কেউ যদি এমন কর্মের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে আইনিভাবে তার যে বিচার হবে, সেটাতে আমাদের সহযোগিতা পাবেন। এদিকে কলেজ শাখার সেক্রেটারি মিথুন ঢালীর সঙ্গে রবিনের বেশি ঘনিষ্ঠতা থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি।

এদিকে, নিহত আফসার ভাই ফজলে রাব্বী বলেন, শেরেবাংলা মহিলা কলেজে পড়ার সময় ছাত্রলীগের নেতা হাবিবুরের সঙ্গে আফসানার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। এর মাঝে বেশকয়েকবার তাদের সম্পর্কে টানাপড়েনও চলে। কিছুদিন আগে বন্ধুরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেন। কয়েক দিন আগে আফসানা ও রবিনের মধ্যে আবারও সমস্যা হয়েছিল বলে জেনেছি।

তেজগাঁও কলেজে রবিনের সিনিয়র এক পরিচিত শিক্ষার্থী পুলক আশরাফ বলেন, আমি কিছুদিন তার সঙ্গে মেশার সুযোগ পেয়েছিলাম। পরে আমি মার্কেটিং বিভাগ ছেড়ে আইনে ভর্তি হওয়ার পর আর তেমন যোগাযোগ হয়নি। তিনি ছাত্রলীগ করতেন জানি কিন্তু কোনও ব্যক্তিগত বিষয়ে আমার জানা নেই।

এদিকে, কাফরুল থানার ওসি সিকদার মোহাম্মদ শামীম হোসেন বলেন, আমরা মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে এলেই অনেককিছু বোঝা যাবে। আলোচনায় বারবারই তেজগাঁও কলেজের সাংগঠনিক সম্পাদক রবিনের নাম আসছে, সেটা তারা বিবেচনায় নিচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সন্দেহজনক সবকিছুই আমরা খতিয়ে দেখছি। আমাদের বেশ কয়েকটি ইউনিট এই নিয়ে কাজ করছে। রবিনের বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছেন কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা সব বিষয় ডিজিটালি ও এনালগভাবে দেখছি।’

উল্লেখ্য, গত শনিবার (১৩ আগস্ট) বিকেলে দু’জন যুবক সিএনজিতে করে আফসানাকে নিয়ে হাসপাতালের আসে। তবে জরুরি বিভাগে রোগী ভর্তির জন্য স্ট্রেচার নিয়ে আসতে বলে তারা সিএনজির ভাড়া মেটাতে যাচ্ছে বলে সটকে পড়ে। কর্তব্যরত চিকিৎসক বলছেন, হাসপাতালে আনার আগেই রোগীর মৃত্যু হয়েছে। আফসানা সক্রিয়ভাবে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী থাকায় সংগঠনটি ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। কলেজে ছাত্রলীগের নানা কর্মসূচিতে সরব থাকা সাংগাঠনিক সম্পাদক রবিন ঘটনার দিন থেকে আর কলেজে আসেনি বলে কলেজের অন্য সংগঠনের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন।



মন্তব্য চালু নেই