শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দাবিই ফললো!
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারণা তুঙ্গে। এ যেন জাতীয় নির্বাচন- মনে হচ্ছে ব্যালট পেপারে নৌকা আর ধানের শীষ প্রতীক! কাগজে কলমে এটি স্থানীয় সরকার নির্ধারণের ভোট। কিন্তু দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের তৎপরতা আর ভোটারদের মনোভাব- সব মিলিয়ে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন যেন রূপে নিয়েছে জাতীয় নির্বাচনে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশ নেয়া আইনে নিষিদ্ধ থাকলেও, আইনকে পাশ কাটিয়ে নানা রূপে পরোক্ষভাবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত এবং বাম ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। রয়েছে সিপিবি, বিকল্পধারা, জাসদের মতো ছোট ও মাঝারি দলগুলো।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের কার্যক্রম শুরু করে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। দলীয় প্রধান স্বয়ং চূড়ান্ত করে দিয়েছেন মেয়র পদপ্রার্থী। একই এলাকায় দলের একাধিক মেয়র প্রার্থী থাকলে তাদের ডেকে সমঝোতা করা হয়েছে। এমনকি কাউন্সিলর পদে একক প্রার্থী নিশ্চিত করতে বাকিদের মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্য করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দলে ভালো পদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তাদের নিবৃত্ত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা স্বাধীন না হওয়ায় এসব ঘটনার পুনঃবৃত্তি হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন নানা সময় হম্বিতম্বি করলেও সরকারি দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারায় অন্যদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বাংলামেইলকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণের বিধান নেই। যে কারণে দলীয়ভাবে কাউকে মনোনয়ন, সমর্থন বা অন্য কোনো ধরনের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। কিন্তু কাউন্সিলরদের ক্ষেত্রে মনোনয়ন দেয়ার মতো প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে। জোর করে আগ্রহী প্রার্থীদের বসিয়ে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। প্রার্থীরাই এসব অভিযোগ করেছেন। এটি শুধু আচরণবিধির লঙ্ঘনই নয়, সরাসরি আইনের লঙ্ঘন।’
গত বছরের ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনের পর আসন্ন তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের উপলক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এতে বিজয়ের লক্ষ্যে প্রথম থেকেই সরব রাজনৈতিক দলগুলো। এর আগে সারাদেশে উপজেলা নির্বাচন হলেও, এর উত্তাপ ছিল স্থানীয়। কিন্তু রাজধানী ও বাণিজ্যিক রাজধানীর সিটি নির্বাচনের উত্তাপ ছড়াচ্ছে দেশজুড়ে।
দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করতে ইতোমধ্যে প্রচারণার মাঠে নেমে পড়েছেন স্বয়ং তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সরকারের লাভজনক পদে থাকায় মাঠে নামতে পারছেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী নিজেও সংসদে দাঁড়িয়ে স্থানীয় নির্বাচনকে রাজনৈতিক নির্বাচন করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এবং এর সপক্ষে ভারতসহ অন্যান্য দেশের উদাহরণও উপস্থাপন করেছিলেন। এর জন্য প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন ও সংযোজনের সুপারিশও করেন তিনি।
তবে তিনি নামতে না পারলেও তার হয়ে মাঠে আছেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। মাঠে নামার প্রস্তুতিতে মুখিয়ে আছেন প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজিব ওয়াজেদ জয়ও। কিন্তু তিনি মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা। এ জন্য কিছুটা দ্বিধা রয়েছে।
তারপরও অবৈতনিক হওয়ায় এ নির্বাচনের প্রচারে অংশ নিতে পারবেন বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। নির্বাচন কমিশন থেকে সবুজ সংকেত পেলেই দেশে ফিরবেন বলে জানা গেছে।
এদিকে মেয়র থেকে শুরু করে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে প্রার্থীদের দলীয় মনোনয়ন এতোটাই প্রকাশ্য ও স্পষ্ট যে সাধারণ ভোটাররা পর্যন্ত বুঝে গেছেন কে কোন দলের সমর্থনপ্রাপ্ত। এমনকি দলীয় সমর্থন পাওয়া প্রার্থীদের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির প্রার্থী বলে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে ভোট চাওয়া হচ্ছে ‘খুন, গুমসহ স্বৈরাচার সরকারের’ বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দাবি নিয়ে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ভোট চাওয়া হচ্ছে ‘সাম্প্রতিক জ্বালাও-পোড়াও এর নেতৃত্বদানকারী খুনি খালেদাকে’ রুখে দাঁড়ানোর স্লোগান নিয়ে। এসব স্লোগানের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে একে অপরের প্রতিপক্ষকে স্পষ্ট করে দিচ্ছে।
নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকার স্থানীয় সমস্যাগুলোর প্রাধান্য থাকলেও দলীয় নেতাদের প্রচারণায় থাকছে জাতীয় রাজনীতির নানা কথা।
অভিযোগ রয়েছে- দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘জাতীয় পার্টির’ অবস্থান যা ছিল এবারো তা-ই রয়েছে। দলীয়ভাবে প্রার্থী সমর্থন দিলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ক্ষতি হয় এমন কোনো কার্যক্রমে নেই ‘সরকারি বিরোধী দল’ হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টি। আবার চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর হয়ে প্রচারণার অভিযোগ আছে খোদ জাপা মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর বিরুদ্ধে।
জাতীয় নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে দেখা যায়, ছোট ছোট অনেক দল ও সংগঠন বড় দলকে সমর্থন দেয়। এবারো তা-ই হতে যাচ্ছে। গণমাধ্যমের ভূমিকাও জাতীয় নির্বাচনের থেকে এ নির্বাচনে কোনো অংশে কম না। পত্রিকার পাতায় গুরুত্ব সহকারে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের গণসংযোগের সংবাদ প্রচার, টেলিভিশনে সরাসরি সংবাদ প্রচার, টকশো, বিশেষ আলোচনা হচ্ছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।
২০১০ সালে প্রণীত সিটি করপোরেশন নির্বাচন আচরণ বিধিমালার ২(ঙ) ধারায় বলা আছে, “নির্বাচনী প্রচারণায় কোন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নিজ ছবি ও প্রতীক ব্যতীত কোন রাজনৈতিক দলের নাম বা প্রতীক বা কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নাম বা ছবি ছাপাইতে বা ব্যবহার করিতে পারিবে না।”
এ আইন অনুযায়ী, সিটি নির্বাচন নির্দলীয় নির্বাচন হলেও, রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়ন, প্রচারণাসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। শুধু মেয়র পদেই নয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী আসনেও প্রার্থিতা ঘোষণা করছে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যারা প্রার্থী হবেন তাদের দল থেকে বহিষ্কার এবং পদ-পদবি কেড়ে নেয়ার হুমকিও দেয়া হচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন কৌশল হাতে নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। নিজেরা প্রচারাভিযানে না নেমে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনগুলো দলীয় প্রার্থীকে সমর্থন দিচ্ছে। এ কাজে প্রধান দুটি রাজনৈতিক জোট সমমনা পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে নাগরিক কমিটি গঠন করেছে।
‘সহস্র নাগরিক কমিটি’ নামে ঢাকায় এবং ‘নাগরিক কমিটি’ নামে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের একটি ফোরাম তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা ‘আদর্শ ঢাকা আন্দোলন’ এবং ‘চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলন’-এর প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে। চলচ্চিত্র শিল্পীদেরও প্রচারণার মাঠে দেখা যাচ্ছে।
ভোটাররাও এই নির্বাচনকে অরাজনৈতিক বলে মনে করছেন না। তারাও প্রার্থীর অবস্থান ও নিজেদের পছন্দ বিবেচনা করছেন সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে সমর্থনকারী রাজনৈতিক দলটির পরিচয়ের ভিত্তিতে। ধারণা করা হচ্ছে, ২৮ এপ্রিল গোপন ব্যালট পেপারে ভোটটা হাতি, কাপ, ইলিশ, বাস নাকি অন্য কোনো প্রতীকে পড়বে সেটা নির্ধারণ করবে সেখানে অদৃশ্যভাবে সেঁটে থাকা নৌকা, ধানের শীষ, লাঙ্গল, লাল নিশান-কাস্তে বা এমন অন্যান্য প্রতীক।
মন্তব্য চালু নেই