শেরে বাংলাতেই সচিবালয় স্থানান্তর করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত

পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রেক্ষাপটে রাজধানীর শেরে বাংলানগরের উন্মুক্ত স্থানে সচিবালয় স্থানান্তর করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

শিগগির ‘শেরে বাংলা নগরে জাতীয় সচিবালয় নির্মাণ’ প্রকল্প চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করতে সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি পাঠিয়েছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

এই প্রকল্প নিয়ে আগের মাসে অনুষ্ঠিত পরিকল্পনা কমিশনের প্রাক মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় যেসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে সেগুলো ‘আমলে’ নিয়েই প্রকল্পটি একনেকে তুলতে বলেছে মন্ত্রণালয়।

‘প্রধানমন্ত্রী প্রকল্পটির দ্রুত বাস্তবায়ন শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন’ বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

বর্তমানে বাণিজ্য মেলার খোলা মাঠ ও সংলগ্ন চন্দ্রিমা উদ্যানের কিছু জায়গাসহ ৩২ একর জমির উপর নতুন জাতীয় সচিবালয় নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের একজন কর্মকর্তা জানান, প্রকল্প প্রস্তাবনায় ৩২ একর জায়গা চারটি ব্লকে ভাগ করে জাতীয় সচিবালয় কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। দুটি বড় ব্লকে ৩২টি বড় মন্ত্রণালয় এবং দুটি ব্লকে ১৬টি ছোট মন্ত্রণালয়কে স্থানান্তর করা হবে।

প্রকল্পের আওতায় অডিটোরিয়াম, সম্মেলন কেন্দ্র, ব্যাংক, ডাকঘর, মসজিদ, কার পার্কিং জোন রয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ২১৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের মধ্যে গণপূর্ত অধিদপ্তর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।

পরিকল্পনা কমিশনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, গত ৬ জুন পরিকল্পনা কমিশনের প্রাক মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় প্রকল্পটি প্রাথমিক অনুমোদনের জন্য তোলা হয়।

কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করায় বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানায় পরিকল্পনা কমিশন। এছাড়া প্রকল্প নেওয়ার আগে কোনো প্রাক-মূল্যায়নও করা হয়নি। সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বিদ্যমান জনবল কাঠামো অনুযায়ী অফিসের জন্য কী পরিমাণ জায়গার প্রয়োজন হবে সে সম্পর্কে কোনো তথ্য প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) উল্লেখ নেই।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু অসুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে সেটি অনুমোদন দেওয়া থেকে বিরত থাকে পিইসি।

পিইসি সভার কার্য বিবরণীতে দেখা যায়, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে আসে ওই সভায়।

শেরে বাংলানগরে সচিবালয় নির্মাণ করতে হলে জাতীয় সংসদ ভবনের উচ্চতার বেশি হতে পারবে না। জাতীয় সংসদের উচ্চতা ১৫০ ফুট। জাতীয় সংসদের স্থপতি লুই আই কানের নকশা বাঁচিয়ে ওই এলাকার উন্নয়ন করতে হলে অবশ্যই প্রস্তাবিত সচিবালয়ের ভবনগুলো নয় তলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। কিন্তু নতুন সচিবালয় নয় তলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।

আর ভবনগুলো নয় তলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে সব মন্ত্রণালয়কে জায়গা দেওয়া সম্ভব হবে কি না তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা কমিশন।

এই সচিবালয় বাংলাদেশের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু, যা শেরে বাংলানগরে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে।

এই সচিবালয় বাংলাদেশের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু, যা শেরে বাংলানগরে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে।
অন্যদিকে নতুন সচিবালয়ের উচ্চতা নয় তলার বেশি হলে পার্শ্ববর্তী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে সভায় মত দেওয়া হয়। বিশেষ করে গণভবনের চারপাশে আইটি সিকিউরিটি বাড়ানোসহ বেশ কিছু পরামর্শ ওই সভায় দেওয়া হয়। এসব সমস্যার সমাধানের উপায়সহ বিস্তারিত প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) উল্লেখ করার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কমিশন।

কমিশন মনে করে, জাতীয় সংসদ ভবনের সৌন্দর্যের সঙ্গে প্রস্তাবিত সচিবালয়ের আউটলুক সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া ঢাকা শহরে উম্মুক্ত স্থানের খুব অভাব, যদিও বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে যাওয়ার জন্য খালি জায়গা দরকার।

নতুন সচিবালয় নির্মাণের আগে এ বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। শহরের সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষা ও বিভিন্ন পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে অন্য কোনো সুবিধাজনক স্থানে নতুন সচিবালয় নির্মাণের পক্ষে মত দেয় কমিশন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চান তারা।

“তবে পরিকল্পনা কমিশন যেসব আশঙ্কা ও অসঙ্গতির কথা উল্লেখ করেছে তার সমাধান করেই প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ শুরু করা হবে।”

জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য আরাস্তু খান বলেন, ‘পিইসি সভায় প্রকল্পটি বিশ্লেষণ করে যেসব অসংগতি ও অযৌক্তিক বিষয় পাওয়া গেছে তা তুলে ধরে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।

“সম্প্রতি মন্ত্রণালয় এসব সমস্যা সমাধানের পর প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে জানিয়ে প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদন ত্বরান্বিত করার নির্দেশনা দিয়েছে। এখন শিগগির প্রকল্পটি একনেক সভায় উপস্থাপন করা হবে।”

শেরে বাংলানগরে সচিবালয় স্থানান্তর প্রকল্পের কাজ শুরু হলে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে সরিয়ে নেওয়া হতে পারে এমন গুঞ্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে আরাস্তু খান বলেন, “ডিপিপিতে এসব বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। প্রকল্পের জন্য যে ৩২ একর জমির কথা বলা হয়েছে তা চন্দ্রিমা উদ্যানের বাইরেই রয়েছে।”

১৯৭৪ সালে ১০টি ব্লকে চারটি নয়তলা ভবনসহ অফিস ব্যাংক, অডিটোরিয়াম, মসজিদ, কার পার্কিং সম্বলিত জাতীয় সচিবালয় নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড উইজডম অ্যান্ড এসোসিয়েশনের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছিল।

পরবর্তীতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবারও তৎকালীন পরিকল্পনা মন্ত্রী এ বিষয়ে একটি সভা করলেও বিষয়টি আর এগোয়নি। শেষ পর্যন্ত ৩৯ বছর পরে আবার জাতীয় সচিবালয় নির্মাণ প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদন দিতে যাচ্ছে সরকার।



মন্তব্য চালু নেই