শুরুতেই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন কমিশন

আসন্ন তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে শুরুতেই নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। তড়িঘড়ি করে তফসিল ঘোষণা, সম্ভাব্য প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনে নির্বিকার, অধিক সুবিধা প্রদান, অরাজনৈতিক নির্বাচনে রাজনৈতিক রঙ লাগানোর তৎপরতায় নীরব সমর্থন দিয়ে যাওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে ‘স্বাধীন’ এ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।

এর আগেও গতবছর অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ও ভোট কারচুপির ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ রয়েছে। ছয় পর্বের ওই নির্বাচনের শেষ চার পর্বে ব্যাপক জালিয়াতি হলেও শক্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কমিশন। একই অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান সরকারের মেয়াদে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচনেও।

আগামী ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণ করে তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। গত ১৮ মার্চ এই তফসিল ঘোষণার বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই আঁটঘাট বেঁধে মাঠে নেমে পড়েন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। সেক্ষেত্রে কোনরূপ আচরনবিধির তোয়াক্কা করছেন না তারা।

বিদ্যমান সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালার ৪ ধারা অনুযায়ী, ‘কোনো প্রার্থী বা তাহার পক্ষ হইতে অন্য কোনো ব্যক্তি ভোট গ্রহণের জন্য নির্ধারিত তারিখের ২১ দিন পূর্বে কোনো প্রকার নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করিতে পারিবেন না।’ এছাড়া প্রচারণার জন্য রঙিন ব্যানার পোস্টার বিলবোর্ড লাগানো এবং ব্যানার-পোস্টারে কেন্দ্রীয় নেতাদের ছবি ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

কিন্তু বাস্তব চিত্র উল্টো। নির্বাচনের আলোচনা শুরু হওয়ার পর থেকেই কয়েকজন প্রার্থীর পক্ষ থেকে তিন সিটি করপোরেশনেই অসংখ্য বিলবোর্ড স্থাপন ও দেয়ালে রঙিন পোস্টার সাঁটিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছে। সেখানে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির (বিএনএফ) সভাপতি আবুল কালাম আজাদের ছবি।

তফসিল ঘোষণার আগে পর্যন্ত এসব নিয়ে নির্বাচন কমিশন ছিল সম্পূর্ণ নির্বিকার। শেষমেষ গত ১৮ মার্চ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রচারণামূলক বিলবোর্ড ও পোস্টার অপসারণের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু তাও কার্যকর হয়নি।

নির্বাচন কমিশনের হাতে আচরণবিধি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ছয় মাসের জেল, ৫০ হাজার টাকা জরিমান অথবা প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা থাকলেও তা প্রয়োগ করা হয়নি কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে।

এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগ্রেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন  বলেন, ‘এ বিষয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন কী সিদ্ধান্ত নিবে এটা আমি বলতে পারি না। তবে আমি হলে মনোনয়নপত্র জমা নিতাম না। আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সঙ্গে সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করতাম।’

নির্বাচনী আইন অনুযায়ীই স্থানীয় সরকার নির্বাচন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক। কিন্তু তিন সিটি করপোরেশনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দল প্রকাশ্যেই দলীয় মেয়র প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি থেকে দলীয় প্রধান স্বয়ং প্রার্থী ঘোষণা করেছেন। অথচ এ বিষয়েও নির্বাচন কমিশন নীরব। এমনকি এই প্রক্রিয়াকে আইনের ফাঁকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার আব্দুল মোবারক  বলেন, ‘দেশের কোনো আইনে উল্লেখ করা নেই যে দলীয় প্রধান প্রার্থীর নাম ঘোষণা করতে পারবেন না।’

তবে তার এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘যেহেতু এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন তাই এখানে দলের পক্ষ থেকে প্রার্থী ঘোষণা করা প্রচলিত বিধি-বিধানের উপেক্ষা। এটা রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনী ফলাফল প্রভাবিত করারও চেষ্টা। এভাবে প্রচলিত বিধি-বিধান উপেক্ষা না করে দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে চাইলে আইন করেই তা করা উচিৎ।’

এছাড়া শুরু থেকেই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মে-জুন মাসের দিকে বা রমজানের পর ভোটগ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ২৮ এপ্রিল তফসিল ঘোষণা করা হলো। এর পেছনে বিশেষ ইঙ্গিত রয়েছে বলেও অনেকে মনে করছেন। এছাড়া একই দিনে তিনটি অতিগুরুত্বপূর্ণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণে নিরাপত্তা নিয়েও অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করছেন।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহীদুল ইসলাম গত ১৬ মার্চ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন শেষ করার সুপারিশ জানান। তার এই সুপারিশের পর রাতারাতি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ২৮ এপ্রিল নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়। যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।

এ বিষয়ে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বর্তমানে সারাদেশে পেট্রোলবোমা হামলা ও বিচার বহির্ভূত হত্যাসহ নানা ধরনের সহিংসতা অব্যাহত আছে। এছাড়াও অনেক সম্ভাব্য প্রার্থী মামলার কারণে কারারুদ্ধ বা পলাতক রয়েছেন। অনেকেই মনে করেন যে, আরো কিছুদিন অপেক্ষা করলে চলমান অস্থিরতা ও সহিংসতা অনেকটা প্রশমিত হতো এবং অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ বিরাজ করতো।’

তিনি আরো বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন আরো কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করবে বলেই অনেকে আশা করেছিলেন। কিন্তু বিরাজমান অশান্ত পরিবেশে তড়িঘড়ি করে তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি না করে পারে না।’

এদিকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের আচরবিধি লঙ্ঘন এবং কমিশনের নির্দেশনার সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরও পোস্টার বিলবোর্ড না সরানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আব্দুল মোবারক বলেন, ‘আমাদের দেয়া ৪৮ ঘণ্টা পর যদি কোনো সম্ভব্য প্রার্থী পোস্টার সরিয়ে না নেয় তাহলে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। পোস্টারে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধানদের ছবি ব্যবহার করে থাকে তাহলে আচরণবিধিমালা অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তবে কবে নাগাদ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি আব্দুল মোবারক।



মন্তব্য চালু নেই