শুকনো খাবার দিয়ে চলছে খালেদা জিয়ার কার্যালয়

খাবার প্রবেশে ‘পুলিশের বাধায়’ গত রাত (বুধবার) থেকে শুকনো খাবার খেয়ে আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ের লোকজন। ওই রাতে স্বজনদের পাঠানো নিজের খাবার কার্যালয়ের লোকজনের মধ্যে ভাগ করে দেন তিনি। এরপর বৃহস্পতিবার সকালে নিজের জন্য রাখা খুরমা-খেঁজুরও সবাইকে ভাগ করে দেন খালেদা জিয়া।

চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অবস্থানকারী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বুধবার রাতে তারা শুকনো খাবার খেয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকালে নাস্তার গাড়ি ও দুপুরে খাবারের গাড়ি এলে সাদা পোশাকের পুলিশ তা কার্যালয়ের ভেতর ঢুকতে দেয়নি। ফলে বৃহস্পতিবার সকাল ও দুপুরেও কার্যালয়ে অবস্থানকারী লোকজন শুকনো খাবার গ্রহণ করেন।

বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল  বলেন, ‘এ বিষয়টি নিয়ে কী বলব। বলারই বা কী আছে? কতটা অমানবিক হলে সরকার মানুষের খাবার বন্ধ করে দিতে পারে?’

মারুফ কামাল বলেন, ‘এটা কী আইনসঙ্গত? নাগরিক হিসেবে আমি যদি কোনো অন্যায় করে থাকি, তাহলে আদালত তার বিচার করবে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলেও তো তাকে খাবার দিতে হয়। এখানে যারা আছি তারা তো এ দেশের নাগরিক। এটা তো কোনো কনসেনট্রেশন ক্যাম্প নয়। বন্দীশালা নয়। আর সাব-জেল ঘোষণা করলেও তো খাবার দিতে হবে। কিন্তু তাও করছে না।’

চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব আরও বলেন, ‘এ ধরনের কর্মকাণ্ড একটি খারাপ নজির। এটা ভাল নয়। বাংলাদেশ একটি রিপাবলিকান রাষ্ট্র। এক সরকার যাবে, আরেক সরকার আসবে। এটা সরকারকে মনে রাখতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘শুকনো খাবার, ফলমূল, জুস ইত্যাদি খেয়ে এ পর্যন্ত আছি। এই কার্যালয়ে যারা আছেন তারাও একইভাবে শুকনো খাবার খেয়ে আছেন।’

জানা গেছে, বুধবার রাতে প্রতিদিনের মতো কার্যালয়ে অবস্থানকারী বিএনপির কয়েকজন নেতা, চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব ও কার্যালয় স্টাফদের জন্য খাবার বহনকারী একটি ছোট পিকআপ ভ্যান কার্যালয় মুখে আসে। কিন্তু পুলিশ তা ভেতরে প্রবেশে বাধা দেয়। এক পর্যায়ে খাবারসহ পিকআপটি গুলশান থানায় নিয়ে যায়। খাবার প্রবেশে বাধা পেয়ে সেখানে অবস্থানকারীরা ব্যক্তিগতভাবে বাইরের লোক মারফত কিছু খাবার আনানোর চেষ্টা করলে পুলিশ তাও ভেতরে নিতে দেয়নি।

বৃহস্পতিবার সকালে রুটি-পরোটা ও ভাজিসহ নাস্তার প্যাকেট নিয়ে ঠেলাগাড়ি এলে সাদা পোশাকের পুলিশ কার্যালয়ের সামনে থেকে ফিরিয়ে দেয়। একইভাবে দুপুর আড়াইটার দিকে খাবার নিয়ে এলে তাও ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

গত ৩ জানুয়ারি থেকে খালেদা জিয়া গুলশানে তার কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। তার সঙ্গে দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল কাইয়ুম, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, মাহবুব আলম ডিউ, নিরাপত্তা সমন্বয়কারী আবদুল মজিদসহ ৫০-৬০ জন নেতাকর্মী ও অফিস কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার খাবার ধানমণ্ডিতে তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়দা রহমানের মা সৈয়দা ইকবালমান্দ বানুর বাসা কিংবা খালেদা জিয়ার সেজো বোন সেলিনা রহমান ও দুই ভাইয়ের বাসা থেকে আসে। বৃহস্পতিবার ধানমণ্ডির বাসা থেকে সকালের নাস্তা আনা হয়।

কার্যালয় সূত্রে আরও জানা যায়, সেখানে অবস্থানকারী সকল লোকজনের খাবার না পাওয়ার পর চেয়ারপারসনের জন্য তার স্বজনদের বাসা থেকে যে খাবার দেওয়া হয়েছিল, তা সিনিয়র কয়েকজন ভাগ করে খান। এ ছাড়া অন্য সকলে বিস্কুট, মুড়ি খেয়ে রাত পার করেন।

বৃহস্পতিবার সকালেও কেউ নাস্তা ও দুপুরের খাবার খেতে পারেননি বলে জানান চেয়ারপারসনের প্রেস উইং সদস্য শামসুদ্দিন দিদার। তিনি বলেন, ‘রাতে অনেকে মুড়ি ও বিস্কুট খেয়ে, কেউ বা না খেয়েই ছিলেন। সকালে নাস্তা পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি দুপুরের খাবারও।’

দিদার জানান, সকালে ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) নিজে সকলের খাবারের খোঁজ নিয়েছেন। তিনি এ সময় তার নিজের জন্য রাখা খুরমা-খেঁজুর ভাগ করে দিয়েছেন। সবাই তা খেয়েছি।’

প্রেস উইংয়ের আরেক সদস্য শায়রুল কবির খান  জানান, রাতে খাবার প্রবেশে বাধার পর আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু খাবার আনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাও ভেতরে আনতে দেওয়া হয়নি। পরে শুকনো মুড়ি, বিস্কুট খেয়ে রাত পার করেছি।’

শায়রুল বলেন, ‘রাতে ম্যাডামের জন্য তার স্বজনদের আনা খাবার এখানে অবস্থানকারী সিনিয়রদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন তিনি। সিনিয়ররা ম্যাডামের সেই খাবার খেয়েছেন।’

বৃহস্পতিবার বিকেলে এ প্রতিবেদক কথা বলেন শামসুদ্দিন দিদারের সঙ্গে। এ সময় দিদার কার্যালয়ের ভেতরে ছিলেন আর রিপোর্টের প্রতিবেদক ছিলেন কার্যালয়ের মূল গেটের বাইরে। কথা বলার এক পর্যায়ে শামসুদ্দিন দিদার মুঠোফোনে একজনকে বলেন, ‘খাবার প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। এখানে অনেকেই অভুক্ত অবস্থায় আছি। পারলে কিছু মুড়ি, চিড়া, ছোট পাটালি গুড়, বিস্কুট পাঠিয়ে দিন। আমাদের কাজে লাগবে।’

এদিকে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মিরপুর আহলে দরবার শরীফ মসজিদের আবদুল মজিদসহ চারজন কিছু তবারক নিয়ে কার্যালয়ে এলে পুলিশ তাদের ২৫ মিনিট দাঁড় করিয়ে রাখে। পরে ওয়্যারলেস সেটে ঊধ্বর্তন কর্মকর্তার অনুমতি নিয়ে পুলিশ দুইজনকে তবারকসহ বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে প্রবেশ করতে দেয়।

প্রতিদিনের মতো খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিকেলে কোরআন তেলাওয়াত ও মিলাদ মাহফিল হয়। তার অংশ হিসেবে আবদুল মজিদ তবারক নিয়ে আসেন।

আবদুল মজিদ বলেন, ‘এই কার্যালয়ে কোকো সাহেবের জন্য গত ২৪ জানুয়ারি থেকে কোরআন খানি ও মিলাদ হচ্ছে। ৪০ দিন এই কর্মসূচি চলবে। তারই অংশ হিসেবে আমরা বিকেলে এখানে আসি।’

এদিকে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদেরও প্রবেশ করতে দিচ্ছে না পুলিশ। গত কয়েকদিন ধরে কার্যালয়ে অন্যদের প্রবেশে বাধা থাকলেও হাতেগোনা কিছু সংবাদকর্মীদের স্পেশাল ব্রাঞ্চের রেজিস্টার খাতায় নাম, ঠিকানাসহ বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করার পর সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হতো। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সেখানে সংবাদ কর্মীদেরও প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। বেলা পৌনে ৩টার দিকে কয়েকজন সাংবাদিক কার্যালয়ে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়।

বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সাংবাদিক প্রবেশে কোনো বাধা আছে কিনা জানতে চাইলে ওই এলাকায় দায়িত্বরত পুলিশের সহকারী কমিশনার মোক্তারুজ্জামান সাংবাদিকদের জানান, ‘এটা উপরের নির্দেশ। এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না।’

এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান  বলেন, ‘ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের যে টিম দীর্ঘদিন থেকে দায়িত্ব পালন করত, তাদেরকেও বদল করা হয়েছে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে পুলিশের নতুন একটি টিম দায়িত্ব পালন করছে।’

এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে খাবার প্রবেশে বাধা দেওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের মুখপাত্র দলের যুগ্ম-মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, ‘সমগ্র জাতি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে, গতরাতে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে রাতের খাবার ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে সরকারি পেটোয়া পুলিশ বাহিনীর লোকেরা। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং কার্যালয়ে অবস্থানরত সকলেই এখনও অভুক্ত অবস্থায় আছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভাতে মারার আর পানিতে মারার নীতি অবলম্বন করে, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে, টেলিফোন, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট ক্যাবলসহ সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে শেখ হাসিনা নিষ্ঠুর কায়দায় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন।’

সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জলকামান, বালুর ট্রাক, মরিচের স্প্রেসহ সকল ঘৃণ্য কায়দায় নির্যাতন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে দেশনেত্রীকে আওয়ামী লীগ একচুলও সরাতে পারেনি। সকল প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে অবশেষে ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বর ও হীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আওয়ামী সরকার সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সম্মানকে ভূলুণ্ঠিত করছে।’ দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই