শিক্ষা ও শিক্ষামন্ত্রীর দৈন্যতা আমাদের খুবই বেদনা দেয়

এতদিন আমার মনে একটা বদ্যমূল ধারণা ছিল, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ যেভাবেই হোক আমাদের দীর্ঘদিনের অবহেলিত শিক্ষা সেক্টরকে একটা ন্যূনতম কাঠামোর উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হবেন। দুর্নীতি-অনিয়মের রাহুগ্রাস থেকে বের করে স্বচ্ছ ধারায় ফিরাতে পারবেন।

তবে যখন থেকে এ ধারণা পোষণ করা শুরু করেছিলাম তখন অবশ্য এর পেছনে অনেকগুলো ইতিবাচক কারণ ছিল। স্মরণে আছে, সেই ২০০৯ সালের প্রথম দিকের কথা। সবেমাত্র মহাজোট সরকারের মন্ত্রীসভা গঠন হয়েছে। যে কয়জন মন্ত্রী দেশবাসীর মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করতে পেরেছিলেন তাদের মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ অন্যতম।আর সেভাবে কাজও তিনি অনেক দূর এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত, ইতোপূর্বে একাধিক কলামে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর বিভিন্ন ইতিবাচক কার্যক্রমের প্রশংসা করে লিখেছিলাম। তাঁর সফলতাগুলোর মধ্যে মোটা দাগে উল্লেখ করতে গেলে, শিক্ষাক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় যে সফলতা সেটি হলো শিক্ষানীতি। স্বাধীনতার পর বর্তমান সরকারই শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনকে আলোর মুখ দেখিয়েছে। সেটিকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। আরেকটি বড় সাফল্য হচ্ছে বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদেরও পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে । পাশাপাশি জানুয়ারির প্রথম দিনে সারা দেশে শিশুদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়ার যে রীতিটি প্রচলন করা হয়েছে, সেটি সত্যিকার অর্থেই প্রশংসনীয়। এছাড়া বর্তমানে স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ৯৯ শতাংশেরও বেশি। নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। এভাবে শিক্ষামন্ত্রীর বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সফলতা রয়েছে। তাতে শিক্ষা নিয়ে মন্ত্রী ও সরকারের প্রতি জনগণের একটা ইতিবাচক ইমেজ তৈরি হয়েছিল।

এদিক থেকে সরকারের গেল সাড়ে ছয় বছরের ব্যর্থতা-সাফল্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা বিতর্ক থাকলেও অন্তত একটি বিষয় পরিষ্কার ছিল যে- শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে সবধরনের দুর্নীতি-অনিয়মের ঊর্ধ্বে। সেই সাথে তিনি শিক্ষারগুণগত মানোন্নয়নে ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অধিকার আদায়ে খুবই আন্তরিক। সেই সাথে কথা-কাজের সাথে তার একটা বেশ মিলও খুঁজে পাওয়া যেত। সরকারেও তার বেশ প্রভাব ছিল বলেই সবার ধারণা ছিল।

কিন্তু কেন জানি, গেল কিছুদিন থেকে আমাদের এই ধারণাটার ভোল পাল্টে যেতে শুরু করেছে, ক্রমেই সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হতে চলেছে। এখন মনে প্রশ্ন জাগছে, সত্যিই কি শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষাকে দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে সামান্যতমও মুক্ত করতে পেরেছেন? না শিক্ষাকে দুর্নীতির রাঘলবোয়ালদের দিকে আরো বেশি ঠেলে দিয়েছেন। তিনি কি সত্যিই সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, না সবচেয়ে দুর্বল মন্ত্রী? তিনি কি গেল সাড়ে ৬ বছরে আমাদের শিক্ষার কোনো উন্নয়ন করতে পেরেছেন, না শিক্ষা সেক্টরে আরো বেশি হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি করেছেন। এসব বিষয় আজ আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় আকারে দেখা দিয়েছে।
এর কারণ :
১. আমরা জানি, পরীক্ষায় নকল বন্ধ হয় বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলেই। এরপর আমরা কি দেখলাম, ক্ষমতার পট পরিবর্তনে শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ সাহেব দায়িত্ব নেয়ার পর আমাদের শিক্ষায় পচন রোগ দেখা দেয়- পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে। বিগত কয়েক বছর থেকে এমন কোনো পরীক্ষা নেই যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেনি। প্রাথমিক সমাপনী থেকে শুরু করে সব ধরনের পাবলিক পরীক্ষা, এমন কি চাকুরি তথা বিসিএস পরীক্ষাও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাধি ছড়িয়েছে।এইতো একদিন আগেও আইবএ’র নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে অভিনব কায়দায়।এ ঘটনায় র্যাবের হাতে ধরাও পড়েছে জড়িত চক্রের ১৫জন।ক’দিন আগে এএইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায়ের কলেজ শিক্ষক, কেন্দ্র সচিবের বিরুদ্ধে থানায় জিডিও হয়েছে। কোনো মতেই যেন এই ব্যাধি সারতে পারছেন না মন্ত্রী।

২. গেল মে মাসের প্রথমদিকে শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল তৈরী করা হচ্ছে। বেতনও অনেক বেশি হবে।’ শিক্ষকদের এই দাবিটি ছিল দীর্ঘদিনের, সবাই আশা করেছিল এবার তাদের আশা পূর্ণ হবে। কিন্তু আমরা কি দেখলাম, শিক্ষকদের আশা তো পূরণ হলোই না, এমন কি এক্ষেত্রে শিক্ষামন্ত্রী যেন অসহায় মানুষের মতো ভূমিকা পালন করলেন। শিক্ষকরা এখনো আন্দোলনে রয়েছেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের শ্রেয় নেই।
এছাড়া দৃশ্যত: প্রস্তাবিত বাজেটে টাকার অঙ্কে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বাড়লেও প্রকৃত অর্থে তা কমেছে। এবার (২০১৫-২০১৬) শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পেয়েছে ১৭ হাজার ১০৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ১৫ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৪ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে তা ১৩ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। এবারের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি এক করে দেখানো হয়েছে। সব মিলিয়ে এই খাত বরাদ্দ পেয়েছে ৩৪ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।
এবারে মাত্র শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির ২ শতাংশ। আর আগের অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ১৬ শতাংশ। যা আফ্রিকার অনেক দরিদ্র দেশের চেয়েও অনেক কম। অথচ ইউনেসকোর সুপারিশ হচ্ছে, শিক্ষা খাতে একটি দেশের বরাদ্দ হওয়া উচিত জিডিপির ৬ শতাংশ। এক্ষেত্রে শিক্ষামন্ত্রী কার্যকর ভুমিকা রাখতে পারেননি।

৩. শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল খোঁজে পা্ওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে।শিক্ষার মান যে কতটা নাজুক পর্যায়ে পৌঁছেছে তা সম্প্রতি শিক্ষাসচিবের বক্তব্য থেকে বুঝা যায়।২৩ জুন বেসরকারি অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটির বেহাল চিত্র নিজ চোখে দেখে রীতিমত চমকে গেলেন শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান। তিনি বললেন- ‘বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা একটি স্কুলের সুযোগ-সুবিধাও নেই তাদের।’
শিক্ষার মান নেই তাতে কি, দলের লোক বলে কথা।দেশে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৮৩টি। এতে শিক্ষার মান ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বাণিজ্য নিয়ে বিভিন্ন সময়ে হৈ চৈ হলে শিক্ষামন্ত্রী তদন্ত কমিটি গঠন করেন এবং ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শুধু তাই নয়, নতুন করে অনুমোদন দৌড়ে রয়েছে আরো ১০৮ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ।যাঁরা অনুমতি চেয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগসহ ক্ষমতাসীন জোট সরকারের শরিক দলের নেতা, সরকারপন্থী শিক্ষক নেতা, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)।
এর মধ্যে ৮৫টির পরিদর্শন রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে ইউজিসি। পাঁচটি পরিদর্শন রিপোর্টের অপেক্ষায় আছে। আবেদনের সঙ্গে প্রকল্প প্রস্তাব (পিপি) জমা না দেওয়ায় পরিদর্শন স্থগিত রয়েছে ছয়টির। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের ব্যাপারে চূড়ান্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। শর্ত পূরণ না হলে তাতে কি, হয়তো তারা সবকটির অনুমতি না পেলেও অর্ধেক তো পেয়ে যাবেন। ।

শিক্ষাবিদদের মতে, শিক্ষার প্রসার ও মান বাড়ানোর চেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের নজর থাকে মূলত ব্যবসার দিকে। যোগ্য শিক্ষক ও শিক্ষার পরিবেশের যথেষ্ট অভাব থাকলেও চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষার্থী টানছে তারা। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীরা নামে-বেনামে সংশ্লিষ্ট থাকায় বিশ্ববিদ্যালগুলো অনুসরণীয় রীতি-নীতির তোয়াক্কা করে না। সরকারের পক্ষ থেকেও যথাযথ নজরদারির উদ্যোগ নেই। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলো মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে সার্টিফিকেট ব্যবসা চালাচ্ছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট বিক্রির অভিযোগও রয়েছে। তা ছাড়া টিউশন ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও কোনো অনুসরণীয় নীতিমালা নেই। ফলে শিক্ষার নামে বাণিজ্য চলছে অবাধেই।

দেশে বর্তমানে ১২২টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩টি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৩৭টি, আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে দুটি। আরো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে রয়েছে।

এদিকে গত বছরের ৩০ জুন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে এক থেকে তিন কোটি পর্যন্ত আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে বলে অভিযোগ করা হয়। প্রতিবেদনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনার দাবি জানানো হয়।

শুধু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই নয়, ইতোমধ্যেই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আমরা সবাই জানতে পেরেছি, গেল শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থী না পাওয়ায় অর্ধশত বেসরকারি মেডিকেল কলেজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

এ বিষয়ে তথ্য নিয়ে যতদূর জানা যায় ৬৬টি মেডিকেলের মধ্যে মাত্র ১০টি ছাড়া সব ক’টির ৫০ শতাংশ আসন শূন্য থাকছে। যথাযথ শর্ত পূরণ না করে বিভিন্ন সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় অধিকাংশ মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যাদের অধিকাংশেরই নেই শিক্ষক ও মেডিকেল শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সুবিধা। ফলে এ অবস্থায় বলা যায়- জেনারেল উচ্চশিক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় যেমনটি পচন রোগ ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে, তেমনি মেডিকেল শিক্ষাতেও অতিসহজেই ক্যান্সার রোগ সংক্রামিত হচ্ছে। ফলে শিক্ষা নীতিনির্ধারকদের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানাবো- এখনো সময় আছে শিক্ষার পচন রোগ সাড়ানোর। বাণিজ্যকীকরণ থেকে শিক্ষাকে রক্ষা করতে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। অন্যথা এই শিক্ষা ক্যান্সারে সংক্রামিত হয়ে ক্রমেই গোটা জাতি অধ:পতনের দিকে ধাবিত হবে।তখন আর হাজারো চিকিৎসা দিয়ে কোনো লাভ হবে না।
সবশেষে বলবো, একসময়ে জাতির সামনে ব্যাপক আশা সঞ্চারকারী দাপটের শিক্ষামন্ত্রীর সববিষয়ে বর্তমানের দৈন্যতা ও নীরবতা আমাদের মনে খুবই কষ্ট দেয়। ইতোপূর্বে আর কোনো শিক্ষামন্ত্রীর ক্ষেত্রে এমন দশা দেখেছি বলে আমার স্মরণে নেই। ফলে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ থাকবে, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ না করতে পারলে আপনাকে বিকল্প কিছু ভাবতে হবে। অন্যথা, আপনি শিক্ষামন্ত্রীর চেয়ারে বসে অসহায়ের মত নীরব থাকবেন, আর লুটেরা শিক্ষাকে নিয়ে অনিয়ম দুর্ণীতি-বাণিজ্য করে গোটা জাতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে, আর আমরা সবাই তা নীরবে চেয়ে দেখবো তা হতে পারে না।

লেখক:
ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান
শিক্ষা ও সমাজবিষয়ক গবেষক। ই-মেইল: [email protected]



মন্তব্য চালু নেই