লিটন বলেছিলেন, স্মৃতি হাসপাতাল আর কত দূর?
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সর্বানন্দ ইউনিয়নের শাহবাজ (মাস্টারপাড়া) গ্রামের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের যে বাড়িটি দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষদের উৎফুল্ল পদচারণায় একসময় মুখর থাকতো। সেই বাড়িটিতে এখন শুধুই নীরবতা।
‘গুরুতর আহত লিটনকে নিয়ে যখন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাচ্ছিলাম। তখন তার শেষ দুটো কথা ছিল, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আমার অক্সিজেনের দরকার। এরপর চিৎকার করে আমাকে (স্ত্রী স্মৃতি) বলেন, স্মৃতি হাসপাতাল আর কতদূর। এটাই তার শেষ কথা ছিল। এরপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
মঙ্গলবার বিকেলে এমপি লিটনের বাড়ির সামনে সেই প্রিয় গাবগাছ তলায় উপস্থিত সাংবাদিকদের অনুরোধে লিটনের শোকে মুহ্যমান অসুস্থ স্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগ নেত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতি সাক্ষাৎকার দেন। শোকাহত ঘটনার পর এই প্রথম সাংবাদিকদের সামনে পরিস্থিতি সম্পর্কে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেন তিনি।
এ সময় স্মৃতি বলেন, ১৯৯৮ সালের ২৬ জুন সুন্দরগঞ্জ ডি ডাব্লিউ ডিগ্রি কলেজ মাঠে জামায়াত-শিবির আয়োজিত জনসভায় গোলাম আজমের বক্তব্য দেয়ার কথা ছিল। সেসময় স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের এ সভা পণ্ড করে দিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ লিটন তার বন্দুক হাতে কর্মীসমর্থকদের নিয়ে জনসভায় প্রবেশ করে। সেই সময় গোলাম আজমকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন তিনি। এতে জনসভা পণ্ড হয়ে যায়। ফলে সেই থেকে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার বাহিনী লিটনকে যেকোনো মূল্যে হত্যার টার্গেট করে রেখেছিল।
সেই সময় তার গুলিতে আহত জামায়াতের ফতেখাঁ গ্রামের ক্যাডার হেফজসহ আরও দুর্ধর্ষ জামায়াত ক্যাডাররা লিটনকে মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠিয়ে এবং মোবাইল করে দীর্ঘদিন থেকেই হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। লিটনকে ৩১ ডিসেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় ওই ঘটনার জের ধরেই গুলি করে হত্যা করা হয়।
তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ওই গোলাম আজমের জামায়াত-শিবিরের খুনিরাই আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। তিনি মর্মান্তিক এ হত্যার বিচার চান এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ২০১৫ সালের ২ অক্টোবর ভোরে শিশু শাহাদত হোসেন সৌরভকে গুলি ছোড়ার একটি পরিকল্পিত মিথ্যা ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমপি লিটনের লাইসেন্সকৃত রিভলবার ও শর্টগান জব্দ করে নেয়া হয়। খুনি জামায়াত-শিবির চক্র জানতো তার বাড়িতে তাদের প্রতিরোধ করার মতো কোনো অস্ত্র নেই। সেই সুযোগে তারা বাড়িতে এসে পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করার সাহস পায়।
এমপি লিটনের স্ত্রী আরও বলেন, প্রতিদিন বিকেলে অনেক নেতাকর্মী বাড়িতে থাকতো। এছাড়া তার বাড়িতে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা ছিল রাতে। সাধারণত সন্ধ্যার আগে নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে এমপি লিটন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বামনডাঙ্গা রেল স্টেশন সংলগ্ন তার অফিসে গিয়ে বসেন এবং রাত ৯টা থেকে ১০টা অবধি সেখানে থাকেন।
কিন্তু কেন জানি না সেদিন, কোনো নেতাকর্মী তার বাড়িতে ছিল না। বাড়িতে শুধু তিনি তার ভাই সৈয়দ বেদারুল আহসান বেতার, ভাগ্নি শিমু, চাচি স্মৃতি খাতুন এবং বাড়ির কেয়ার টেকার ইসমাইল, ইউসুফ ও সৌমিত্র ছিলেন।
এ সময় তিনি ও তার ভাই বাড়ির উঠোনের রান্না ঘরের কাছে ছিলেন। সেসময় গুলির শব্দ শুনতে পান এবং লিটন ঘর থেকে বাড়ির ভেতর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে বলেন ওরা আমাকে গুলি করেছে, আগে ওদের ধরো। এ সময় তিনি বুকে হাত দিয়ে ছিলেন এবং বুকের বাম পাশ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। বাড়ির সামনে ড্রাইভার এমপির চিৎকার শুনে এবং আততায়ীদের ছুটতে দেখে গাড়ি নিয়ে তাদের ধাওয়া করেন।
আহত লিটনকে সঙ্গে নিয়ে স্মৃতি, ইসমাইল ও বেতার গাবগাছ তলায় বেরিয়ে আসেন। সেসময় আহত লিটন দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। ড্রাইভার ও গাড়ি না থাকায় একটি মোটরসাইকেলের মাঝখানে বসিয়ে আহত লিটনের কথা মতো তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় ড্রাইভার আসলে সেই গাড়িতে চড়ে প্রতিবেশী নয়ন ও রেজাউল এবং বেতারসহ এমপি লিটনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সুন্দরগঞ্জে দলীয় কোনো কোন্দল নেই। লিটন এমপি হিসেবে অত্যান্ত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তবে তার একমাত্র শত্রু ছিল স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির চক্র। যাকে তিনি আওয়ামী লীগের আদর্শে অনুপ্রাণিত রাজনীতিতে কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন। তার প্রতিশোধ এ ত্যাগী নেতার রক্ত ঝরিয়ে নিয়েছে তারা।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এমপির শ্যালক সৈয়দ বেদারুল ইসলাম বেতার কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, যে দুজন খুনি লিটনের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ জানিয়ে তার সঙ্গে ঘরে ঢোকেন। তারা গিয়ে সামনের সোফায় বসে পড়েন। দুই খুনীর মুখ খোলা থাকলেও মাথা ও কান মাপলারে ঢাকা ছিল এবং তাদের পরণে ছিল কালো জ্যাকেট ও কালো প্যান্ট। তারা বহিরাগত ছিল না, কারণ তারা গাইবান্ধা এলাকার আঞ্চলিক ভাষা দিয়ে কথা বলছিল।
প্রসঙ্গত: গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন শনিবার সন্ধ্যায় সুন্দরগঞ্জের নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় দ্রুত রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়। রাত সাড়ে ৭টায় কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মন্তব্য চালু নেই