‘রায়ের বাজার বধ্যভূমির লাশের মধ্যে আমিও ছিলাম’
১৪ বছর বয়সী রবিউল আলমের চোখের সামনে তখন অসংখ্য লাশ। খোলা আকাশের নিচে পানিতে পড়ে থাকা লাশগুলো বিকৃত হয়ে গেছে। স্বজনদের লাশ খুঁজতে আসা মানুষের কান্নায় আকাশ ভারী। এমন ভয়াবহ দৃশ্য কিশোর রবিউলের মনে দাগ কেটেছিল, তাকে কষ্ট দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কিশোর রবিউল আলমকে এখনও সেই কষ্ট তাড়া করে ফেরে।খবর বাংলা ট্রিবিউনের।
রায়ের বাজার এলাকায় বসবাস করেন রবিউল। ১৯৭১ সালে ১৪ বছর বয়সী রবিউল দেখেছিলেন পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা। বাংলা ট্রিবিউনের কাছে সেই সময়ের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তিনি।
রবিউল বলেন, ‘১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবস এলেই মনে পড়ে সেই ভয়ানক দৃশ্যের কথা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বিকৃত লাশগুলো। মনে হয় এখনও আমার দিকে চেয়ে আছে মৃতদেহগুলো। ওই ঘটনার পর অনেক দিন ঘুমাতে পারিনি।’
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে বেপরোয়াভাবে সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে পাক হানাদার বাহিনী। সেই সময়ের স্মৃতি তুলে ধরেন রবিউল আলম। মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়সে কিশোর হলেও তাকে হত্যা করতে নিয়ে গিয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী।
সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়ার কাহিনী বলতে গিয়ে আজও কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে পড়ে রবিউলের। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর কারফিউ চলছিল। পেটে ক্ষুধা, মার কাছে খাবার চাইলে তিনি অসহায়ের মতো তাকিয়ে ছিলেন। রায়ের বাজার বধ্যভূমি থেকে আমাদের বাসার সামান্য দূরে খালের পাড়ে বসে আছি। সেখান থেকে সবই দেখা যায়। সেখানে এলাকার অনেক লোক মাছ ধরছে দেখে আমারও লোভ হলো মাছ ধরার। সফি, চান মিয়া, আমার বড় ভাই সফিউল্লাহসহ অনেকেই মাছ ধরছিলেন। আমিও সেখানে যাই। মাছ ধরার নেশায় ভুলে যাই যে দেশে কারফিউ চলছে। রাজাকার, আলবদর, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাড়ি-বাড়ি তল্লাশি করছে। হিন্দু, মুসলিম কোনও বাছবিচার করছে না, যাকে পাচ্ছে তাকেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে দেখেছি মিষ্টির দোকানদার সামপাল, তার ছেলে গোলাপ, শেখ শওকত আলীসহ অনেককে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেছে। পরে জানতে পেরেছি সামপাল ও তার ছেলে ছাড়া বাকি সবাইকে তারা হত্যা করেছে।’
রবিউল বলেন, ‘সেদিন মাছ ধরার আশায় দল থেকে বেরিয়ে রায়ের বাজার বধ্যভূমির কাছে চলে যাই। ইট পোড়ানোর চুলায় উঁকি দিয়ে দেখি শতশত লাশ পড়ে আছে। ভয়ে আঁতকে উঠি। চিৎকার দিয়ে দৌড়ে এগিয়ে দেখি, ইট বানানোর স্থানে (পট) সবুজ ঘাসের ওপরেও লাশ পড়ে আছে। কাছেই রাজাকার ক্যাম্প, চারদিক থেকে গুলি চলছে। ভয়ে আমরা চারজন ইট বানানোর মাটির পাশে শুয়ে পড়ি।
আশেপাশে অনেক মৃতদেহ ছিল। কিন্তু রাজাকাররা আমাদের দেখে ফেলে। তারা ভেবেছিল বধ্যভূমিতে তাদের হত্যাকাণ্ডের পরও কেউ হয়তো জীবিত আছে। অথবা মুক্তিবাহিনী রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেছে।
রাজাকাররা বন্দুক তাক করে আমাদের হাত ওপরে তুলতে বলে। আমরা চারজনই হাত তুলে দাঁড়ালাম। ওরা যে যেভাবে পেরেছে আমাদেরকে আঘাত করেছে। বড় ভাইকে রাইফেল দিয়ে আঘাত করে মাথা ফাটিয়ে দেয়। সফির দুটো দাঁত পড়ে যায় আঘাতে। চান মিয়ার হাত ভেঙে যায়। আমাকে এক রাজাকার চিনতে পারে। কারণ আমি একটা মাংসের দোকানে কাজ করতাম। রায়ের বাজারের সেই দোকান থেকে রাজাকারটা মাংস নিতো। সেই রাজাকার আমাকে মারেনি। ওরা আমাদের কাছে মাছ রাখার পাতিল দেখতে পায়। তখন ওরা বুঝতে পারে আমরা মাছ ধরতে এসেছি। ওরা একে অন্যের সঙ্গে আলোচনা করে আমাদের নিয়ে যায় কাঁটাসুর ক্যাম্পে। আমাদের চার জনকে হাত-পা বেঁধে একটি ঘরে আটকে রাখে। সেই ঘরে আরও মানুষ ছিল, তবে অন্ধকারে থাকায় কাউকে চেনা যাচ্ছিল না।’
রবিউল বলেন, ‘রুমের মধ্যে কারও চেহারা দেখার উপায় নেই। শুনতে পাচ্ছিলাম সেলিনা পারভীন নামে একজনকে খোঁজা হচ্ছে। কিছু সময় পর আমাদের হাজির করা হয় এক পাকিস্তানি অফিসারের সামনে। সেখানে ছিলেন একজন সার্জেন্ট। তিনি আমাদের দেখে ছেড়ে দেন। সেখান থেকে ফিরে এলেও লাশ দেখার ভয় পিছু ছাড়েনি। সেই ভয়, কষ্ট এখনও তাড়া করে ফেরে।’
বিজয়ের ক্ষণও রবিউলের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তবে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর মুক্তির আনন্দের পাশাপাশি বেদনাতেও আর্দ্র হয়ে পড়েছিল তার হৃদয়। তিনি বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে হাজার-হাজার মুক্তিকামী মানুষ রাস্তায় নেমে উল্লাস করে। অনেকে স্বজনের মৃতদেহের খোঁজে ছুটে যান বধ্যভূমিতে। আমিও ছুটে যাই। কিন্তু চারদিন আগে দেখা লাশগুলো আমি চিনতে পারছিলাম না। লাশগুলো পচে-গলে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। তবে তার মধ্যেও অনেকে স্বজনের জামাকাপড় দেখে লাশ শনাক্ত করছিলেন। কারও বাবার, কারও মায়ের, কারও বা ভাইয়ের লাশ ছিল। মানুষের কান্না, আহাজারির সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য! এত লাশ গাড়িতে ওঠানো সম্ভব হচ্ছিল না। আমরা কয়েকজন কিশোর লাশগুলো স্বজনদের অনুরোধে গাড়িতে তুলে দিয়েছিলাম। উৎকট দুর্গন্ধ থাকা সত্ত্বেও মানুষের কান্নায় সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম।’
কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে রবিউল বলেন, ‘স্বাধীনতার পর এতগুলো বছর কেটে গেলেও মনে হয়, এই তো সেদিনের ঘটনা। এখনও সেই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় কিছুক্ষণ বসে থাকি, পলক না ফেলে চেয়ে দেখি রায়ের বাজার বধ্যভূমি। এখন অনেক লোকের সমাগম হয় সেখানে। ১৪ ডিসেম্বর এলে রায়ের বাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ সেজে ওঠে। আর সারাবছর পড়ে থাকে অবহেলায়।’
মন্তব্য চালু নেই