শহীদ বুদ্ধিজীবী সন্তানদের কাছে বিজয় এখনো ‘অসম্পূর্ণ’

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জন জেনেই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। তালিকা করে বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে নিয়ে হত্যা করে তারা। এ কাজে বাংলাদেশিদের মধ্যে রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর লোকেরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছিল।

জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার ঠিক দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার জন্য সংঘঠিত যুদ্ধের বিজয় আসে। অভ্যুদয় হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। তবে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেয়া জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের উত্তরসূরিদের কাছে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় এখনো অসম্পূর্ণ।

শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তানেরা বলছেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত সব যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত বিজয় অসম্পূর্ণ। একইসঙ্গে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক তালিকা করার পাশাপাশি সারা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের গল্প ছড়িয়ে দেয়ার দাবিও জানান তারা।

শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ‘জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছি, পেয়েছিও অনেক কিছু। প্রত্যাশা বা প্রাপ্তির হিসাব করার বিষয় নয়।

তিনি বলেন, ‘শহীদ পরিবার থেকে কমন দাবি হচ্ছে শহীদদের একটি সঠিক তালিকা করা। যা অত্যন্ত জরুরি। যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত আমরা কিন্তু শহীদদের সঠিক তালিকা করতে পারিনি। শহীদদের তালিকা করা অত্যন্ত জরুরি।’

শমী কায়সার বলেন, ‘সারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে প্রতিটি জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের গল্প, মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প, শহীদদের গল্প ছড়িয়ে দিতে হবে। সেটা নাটক হোক, চলচ্চিত্র হোক কিংবা বই হোক। এই কাজটা কিন্তু আমরা শহীদ পরিবাররাও করছি।’

চলতি বছরের ১১ মে মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নকারী গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়। তবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত আরও দুইজন, চৌধুরী মইনুউদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান পলাতক থাকায় বিচার এখনও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। চৌধুরী মইনুদ্দীন যুক্তরাজ্য এবং আশরাফুজ্জামান খান যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রয়েছেন। তাদেরকে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বিদেশে পলাতক দুইজনকে দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর না করা এবং কেন তাদের ফেরানোর জন্য সরকার চাপ সৃষ্টি করে না তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তানরা।

শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছেলে তানভীর হায়দার চৌধুরী বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত অনেকের বিচার নিষ্পত্তি ও রায় কার্যকরের ফলে স্বস্তি বোধ করছি। আবার অনেক সাজাপ্রাপ্ত আসামি বিদেশে পালিয়ে আছে তাদের রায় কার্যকর না হওয়া আমাদের মাঝে অস্বস্তিরও সৃষ্টি করে। যারা বিদেশে পালিয়ে আছে তাদের ফিরিয়ে আনতে কেন সরকার বিদেশি বন্ধুদের আরও চাপ সৃষ্টি করছে না, বুঝি না। ’

তানভীর হায়দার বলেন, যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হওয়ার কথা ছিল তার থেকে এই বাংলাদেশ এখনও অনেক দূরে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল ক্ষমতায়। এখনও এদেশে লেখালেখির জন্যে মানুষকে হত্যা করা হয়। ৭২’ এর সংবিধানে ফিরে আসা হয়নি, এখনও বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে, সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন হয়, মুক্তিযোদ্ধাকে পেটানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়- এগুলো হওয়ার কথা নয়, তারপরও হচ্ছে-এগুলো পীড়া দেয়।

শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তান আসিফ মুনীর তন্ময় বলেন, ‘আমার পিতার হত্যাকাণ্ড এবং তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল চৌধুরী মইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। আমার বাবার হত্যার সঙ্গে জড়িতদের রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কাছে বিজয়টা অসম্পূর্ণই থেকে যায়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষক ছিলেন জ্যোতির্ময়গুহ ঠাকুরতাকে হত্যা করা হয়েছিলো এই দিনেই। তার একমাত্র মেয়ে মেঘনাগুহ ঠাকুরতা বলেন, ‘বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অনেকের শাস্তি হয়েছে। তবে এখনো কেউ কেউ বাকি আছে।’ তিনি বলেন, ‘চৌধুরী মইনুউদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের দণ্ড কার্যকর করা যায়নি। তা না হলে বিজয়ের অর্জন পূর্ণাঙ্গ হবে না।’

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, ডা. আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, ড. ফজলে রাব্বী, সিরাজ উদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক জিসি দেব, জ্যোতির্ময়গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সাংবাদিক খন্দকার আবু তাহের, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এসএ মান্নান (লাডু ভাই), এ এন এম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, সেলিনা পারভিনসহ আরো অনেকে।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করা প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘শহীদদের তালিকা তো আছেই। তবে সেটা কমপ্লিট নয়। সব জায়গারগুলো নেই। তালিকা আছে, তবে সে তালিকা ছাড়া যে আর কোনো বুদ্ধিজীবী নেই এটা আমরা মনে করি না। তালিকা নেই এটা বলা যাবে না।’



মন্তব্য চালু নেই