প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বৃদ্ধি হওয়ায়

রাণীনগরে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প

নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামীন জনপদের নাম মিরাট। যোগাযোগ বিচ্ছন্ন, অবহেলিত এই গ্রামের বর্ষা মৌসুমে চলাচলের একমাত্র বাহন নৌকা । জীবনযাত্রার মান তেমন উন্নত নয়। গামছা বুনন, মাছধরা তাদের মূল পেশা। মাটির ভিটা ওপরে টিনের চালা সব মিলিয়ে মাটির ঘরের সামনে বারান্দা। সেই বারান্দার একপাশে ছোট ছোট তাঁত। মাঝ বয়সী এক গৃহবধূ সাংসারিক কাজকর্মের পাশাপাশি একটু ভালো থাকার জন্য স্বামীর সাথে গামছা বুননের কাজ করে। বারান্দার অন্য পাশে আরেকজন মাঝবয়সী নারী চরকায় সুতা মোড়াচ্ছেন। কেবল এ ঘরের বারান্দায় নয়, এখানকার প্রায় প্রতিটি ঘরের বারান্দায় দেখা যাবে তাঁতে কাপড় বুননের খটখট শব্দ। মূলত তারা গামছা বুনছেন। আর এ গামছা বুননের তাঁতিপাড়ার অবস্থান নওগাঁ জেলার রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউপির অবহেলিত মিরাট উত্তরপাড়া গ্রামে। কারিগরপাড়া হিসেবেই সবার কাছে বেশি পরিচিত। গামছা বুননের এ তাঁতপাড়াটি।

মিরাট গ্রামের তাঁতি রাজিনা বিবি (২১) জানান, সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে গামছা বুননের কাজ করি। দিনে এক থান বা চারটি গামছা বুনতে পারি। আবার সময় বেশি পেলে বেশি গামছাও বুনতে পারি। সাধারণত লম্বায় চার হাত চওড়ায় দু’হাত গামছা চারটি বিক্রি করা হয় ২৫০ টাকা থেকে ২৮০ টাকা। অনেক সময় রঙ, নকশাও গুণগতমানের জন্য গামছার দাম কম বেশিও হয়ে থাকে। চারটি গামছা বিক্রি করলে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা লাভ হয়। রুবিয়া বিবি বলেন, গামছার সুতা বগুড়া জেলার সান্তাহার বাজার থেকে কিনতে হয়। দেশীয় এসব সুতার দাম দিনদিন বেড়েই চলছে। তাই আমাদের গামছা বুননের কাজও দিনদিন হুমকীর মুখে পড়ছে। এজন্য আমাদের জাতি তাঁতি পেশা ছেড়ে দিয়ে বেশি লাভের আশায় অনেকে গামছা বুননের কাজ ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় ঝুঁকছে। তৈরি উপকরণের মূল্য লাগামহীন বৃদ্ধি ও আধুনিকতার কাছে টিকতে না পেরে আমাদের জীবন যাপন করা কষ্ট সাধ্য হয়ে উঠছে। ফলে এখানকার কারিগর পরিবারের সংখ্যা দিন দিন কমছে।

একই গ্রামের রওশনারা বেগম জানান, গামছা বুননের নকশা আমরা নিজেরাই করি। তবে গামছার জমিন আর পাড়ের রঙ ও নকশার মধ্যে কিছুটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। এখানকার প্রতিটি গামছারই তিন থেকে পাঁচ ইঞ্চি চওড়া পাড় দেখা যাবে। এছাড়া এখানকার বোনা গামছার রঙগুলো সাধারণত উজ্জল হয়ে থাকে। এখানকার তাঁতগুলোতে একজন তাঁতি একটি তাঁতে বুননের কাজ করেন। তার কোনো সহকারীর প্রয়োজন হয় না। হাতে টানা এ তাঁতগুলো মাটির ওপর বসানো। তাঁতি বসেন মাটিতে কিছুটা গর্ত করে। তাঁত বোনার সময় তাঁতির হাত ও পা এক সঙ্গে কাজ করে।

কুবিরাতলী গ্রামের গামছা ব্যবসায়ী আজাহার আলী বলেন, মিরাটের তাঁতিদের তৈরি গামছা দেশের ঐতিহ্যবাহী বুনন শিল্পের একটি। কিন্তু সুতার দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে এখানকার তাঁত ও তাঁতির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে এ ঐতিহ্যবাহী বুনন শিল্পটি।

এব্যাপারে স্থানীয় ইউপি চেয়াম্যান জামাল উদ্দিন জানান, মিরাটের এই তাঁত পল্লীটি খুবই অবহেলিত। এদের দিকে কেউই তাকায় না। বাপ দাদার এ পেশাকে খুব কষ্টে তারা ধরে রেখেছে। তাই এ শিল্পকে জাগিয়ে তুলতে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি সহযোগীতা এবং সবার সহযোগীতায় এ শিল্প আবার ফিরে পেতে পারে তার পুরনো ঐতিহ্য।



মন্তব্য চালু নেই