রাজনীতিতে করমর্দন বনাম সেক্যুলারিজম

এইত ৬-৭ জুন দুই দিনের এক ঐতিহাসিক সফর হয়ে গেল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। এই সফরে আমাদের দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের দুই নেত্রীসহ (হাসিনা-খালেদা) অন্যান্যদের সাথেও মোদির বৈঠক, দেখা-সাক্ষাৎ ভাববিনিময় সবই হয়েছে। রাজনীতিতে এ নিয়ে কারো কোনো আপত্তি বা অভিযোগ-অনুযোগ থাকার কথা নয়। কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে কথা উঠেছে, বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তা হলো মোদির সাথে করমর্দনের বিষয়টি নিয়ে।

‘করমর্দন’ নিয়ে কোন কোন সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। জানিনা, তারা এ নিয়ে কি বুঝাতে চেয়েছেন! তবে বিষয়টি বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতিতে বেশ চমকপদ এবং বেশ প্রাসঙ্গিক বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে । কেননা, এর মাঝে লুকায়িত রয়েছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির এক ধরনের পরিবর্তনের আভাস ।এখানে কোনো পক্ষকে তুষ্ট কিংবা অসন্তুষ্ট দেয়ার জন্য নয়, বরং বাস্তব প্রেক্ষিতেই বিষয়টি স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করতে চাই।

মোদির সাথে দুই নেত্রী করমর্দন করায় বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে সমালোচনা চলছে এ নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেইসবুকে অনেকেই স্ট্যাটাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার কঠোর সমালোচনা করেছেন।

এই কট্টরপন্থিদের দাবি, একজন মুসলিম নারী কখনো কোনো পর পুরুষের সাথে এভাবে করমর্দন করতে পারেন না।ফলে তাদের দৃষ্টি দুই নেত্রীই নাজায়েয কাজ করেছেন।

এরকমই একজন ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে খালেদা জিয়ার কাছে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘এখন আপনার ইসলামি চেতনা গেল কই? পর পুরুষের সাথে আপনার এরূপ করমর্দনে কবরে শুয়ে আপনার শহীদ জিয়াও কষ্ট পাচ্ছেন। হায়রে ক্ষমতা, তুমি এতই প্রিয়, তোমার জন্য সব বিসর্জন দিতে পারি আমরা!’

এদিকে অপর একজন ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা করে বলেন, আপনি একজন মুসলিম নারী, শুনেছি- আপনি নাকি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করেন। এরপরও আপনি কিভাবে মোদির সাথে বারবার করমর্দন করলেন? ইসলামের দৃষ্টিতে এটা আপনি কোনোভাবেই করতে পারেন না।,

উল্লেখ্য, গত দুইদিনে সফরকালে মোদিকে স্বাগত, বিদায় জানানোসহ বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কয়েকবার এবং বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সোনার গাঁ হোটেলে দেখা করতে গিয়ে দুইবার করমর্দন করেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদও দেখা ও করমর্দন করেন।

এটাকে রাজনীতিতে সৌজন্যতাবোধ হিসেবেই মনে করা হয়। তবে ইসলামী চিন্তাচেতনায় বিশ্বাসী কট্টরপন্থীরা পুরুষের সাথে মহিলাদের করমর্দন করাকে নাজায়েজ তথা গোনাহ হিসেবে দেখেন। অন্যদিকে সেক্যুলার রাজনীতি ভাবধারায় বিশ্বাসিরা এটাকে কোনো কিছু মনে করেন না। তারা এটা সৌজন্য বোধ হিসেবেই দেখছেন।

প্রসঙ্গত, আমাদের অনেকের হয়তো স্মরণে আজে বিগত (১৯৯৬-২০০১) আওয়ামী লীগের আমলে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পশ্চিমা বিশ্বের একটি রাষ্ট্রে সফরে গিয়ে ওই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে করমর্দন করেছিলেন। এতে ওই সময় তিনি ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে রাজনীতিতে তাকে অনেক মাসুলও দিতে হয়। যতদূর মনে পড়ে এই সমালোচনা গোছাতে শেখ হাসিনাকে ২০০১ নির্বাচনের আগে নির্বাচনী প্রচারণায় মাথায় হেজাব এবং হাতে তসবিহও নিতে হয়েছিল। অর্থাৎ কট্টর ইসলামপন্থিদের আস্থা অর্জনে তাকে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছিল। তবে এক্ষেত্রে বেগম জিয়া বরাবরই সতর্ক ছিলেন।

কিন্তু রাজনীতির সেই প্রেক্ষাপট যেন ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, এবার মোদির সাথে করমর্দনে প্রধানমন্ত্রী যতটা না সমালেচনার সম্মুখীন হচ্ছেন এর চেয়েও বেশী হচ্ছেন খালেদা জিয়া। কেননা, শেখ হাসিনা বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই করমর্দনের সংস্কৃতি চর্চা করে আসছেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার এ সংস্কৃতি হঠাৎ পরিবর্তন হিসেবেই লক্ষণীয়। ফলে সহজেই বলা যায়- এখনকার সমালোচনায় খালেদা জিয়াকেই একটু বেশী মাশুল দিতে হতে পারে।

প্রসঙ্গত, আজ থেকে বছরখানেক আগে ‘বাংলাশে রাজনীতি বনাম সেক্যুলারিজম ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা, এবং ‘যে কারণে আওয়ামী শাসন দীর্ঘায়িত হতে পারে’ পৃথক শিরোনামে সংবাদপত্রে দুটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। তাতে করমর্দন এবং মাথার হেজাব রানোর মধ্যে রাজনীতিতে কী বার্তা দিচ্ছে? এবং আমাদের রাজনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিজের একটি পর্যবেক্ষণ ভাবনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। ওই সময় হয়তো অনেকে আমার নিবন্ধটিকে এক ধরনের আড়চোখে দেখার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতপন্থীরা এ নিয়ে বিরূপ মন্তব্যও করেছিলেন। কিন্তু আজ যেন সেটা খুবই বাস্তবতা।

ওই নিবন্ধ দুটিতে উল্লখ করেছিলাম- বিএনপি ইসলামপন্থিদের সাথে জোট করলেও সাম্প্রতিককালে অনেকে বিএনপির নেতানেত্রীদের পোষাক-আশাকে একটা কমপ্লিকেটেড ভাব খোঁজার চেষ্টা করেছেন। এর স্বপক্ষে অনেকে গেল বছর বাংলাদেশে সফরে আসা মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দিশাই এর সাক্ষাতের সময়কার বেগম জিয়ার পোশাকের ছবিটি বিএনপিকে কিছুটা সেক্যুরিজমের প্রতি অগ্রসর হওয়ার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন।

তাতে উল্লেখ করেছিলাম-গত কয়েক বছর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে নানা মেরুকরণ, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত চলছে তার মূলে একটা বিশেষ কারণ নিহিত রয়েছে। গেল বছরের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটা সাময়িক সমাধান হলেও বিষয়টি কিন্তু অনেক গভীরে। তবে অনেকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বটিকে ক্ষমতায় টিকে থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াই বলে উল্লেখ করলেও আমি কিন্তু বিষয়টি মোটেও সেভাবে দেখি না। কেননা, বর্তমানে শুধু ক্ষমতা নয়, ক্ষমতার দ্বন্দ্বের পাশাপাশি চলছে এক ধরনের আদর্শিক দ্বন্দ্ব। সেটা হচ্ছে- একদিকে সেক্যুলারিজম, অন্যদিকে ইসলামিজম। দ্বন্দ্বটা বেশ শক্তিশালীই বলা চলে। এছাড়া আপতত দৃষ্টিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বটাকে শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বলে মনে হলেও আসলে এটা একটা বিশ্বায়নের দ্বন্দ্ব ।

কেননা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীব্যাপি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক সেক্যুলার রাষ্ট্র গঠনের যে হিড়িক পড়েছিল তার ধাক্কা ভারতীয় উপমহাদেশেও লাগে। কিন্তু জাতীয়তাবাদের চেতনার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে ভারতীয় উপমহাদেশ প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে মুক্ত হয়ে পৃথক দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তবে এখানকার জাতীয়তাবাদের চরিত্রটা একটু ভিন্ন বলে মনে হয়েছে- কারণ এখানে ধর্মীয় চেতনায় মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে ইন্ডিয়া রাষ্ট্র গঠন হয়। গত ৬৮ বছরে ভারত আদর্শিক চেতনা হিন্দুত্ববাদ থেকে বের হতে না পারলেও কিছুটা সেক্যুলারিজমের চরিত্রে শক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গঠন করতে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ অনেক পেছনে। ফলে বিশ্বায়ন মূল্যায়নেও এরা পেছনে।

তবে অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সেক্যুলারিজম চরিত্র ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। আর বর্তমান ক্ষমতাসীনরাও সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে এক্ষেত্রে ইউরোপ-অ্যামেরিকাসহ দাতা গোষ্ঠীর আস্থা অর্জন ও সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছে। ফলে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বিষয়ে শত ব্যর্থতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের সেক্যুলার চরিত্র ক্ষমতাসীনদের কাছে অধিকতর নিরাপদ বলে বিশ্বনেতাদের কাছে প্রতীয়মান হওয়ায় তারা বেশ জোরালোভাবেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীনদের।

এর প্রমাণ হিসেবে আমরা দেখতে পাই, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে মানবাধিকার তথা নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ ব্যাপকভাবে লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলেও এ নিয়ে বিশ্বনেতারা প্রতিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন। যদিও সেক্যুলারিজম, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র পৃথক কোনো বিষয় নয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, বর্তমান সরকারের শত ব্যর্থতা সত্ত্বেও সম্প্রতি কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশনের (সিপিএ) নির্বাহী কমিটির চেয়ারপারসন পদে এবং ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়া, প্রধানমন্ত্রীর সাউথ সাউথ সম্মাননা অর্জন এবং জাতিসংঘের ইউনস্কো কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শান্তির বৃক্ষ বলে ঘোষণাই প্রমাণ করে কুটনৈতিকভাবে সরকার বেশ সফল ও সার্থক। এরফলে বলা যায়- পরোক্ষভাবে সেক্যুলারিজমের পক্ষেই বিশ্ব সম্প্রদায় সমর্থন জুগিয়েছেন।

এতক্ষণ আমরা বর্তমান বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনীতি, ক্ষমতাসীনদের অবস্থান ও সাফল্যের কথা বলার চেষ্টা করেছি। তবে দেশের বর্তমান এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির পেছনে বাংলাদেশের বিরোধী পক্ষের ভুমিকাও কম নয়।

বিগত কয়েক বছরে দফায় দফায় তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিসহ নাগরিক অধিকার সংশ্লিষ্ট শত ইস্যুতে বারবার আন্দোলনের হুমকি দিয়ে শক্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারা, সরকার বিরোধী আন্দোলনে সঠিক সময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতা, ক্ষমতাসীনদের সমঝোতা প্রস্তাবে না গিয়ে একগুয়েমি, সরকারের সাথে বিরোধী জোটের নেতাদের গোপন আঁতাত, আন্দোলনের জন্য ত্যাগী নেতাকর্মির অভাব, সর্বোপরি রাজনীতিতে চাটুকারিতা ইত্যাদির কারণে আজ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই ক্ষমতাসীনদের অনুকূলেই বলা যায়।

সবচেয়ে বড় যে কারণটি বিরোধী জোটকে পিছিয়ে দিয়েছে বলে মনে করা হয় তা হলো- রাজনীতিতে অধিকতর ইসলামিজমকে প্রাধান্য দেয়ার মনোভাব। আর এ কারণেই আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভে অনেকটাই ব্যর্থ হচ্ছে বলে ধরা হয়। যদিও বিরোধী পক্ষে এটাকে প্রতিপক্ষের অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবে মনে করা হয়।

এছাড়া নিজ দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ অনেক নেতা এবং জোটের শরীক দল জামায়াতের নেতাদের মানবতা বিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়ানো হলেও এক্ষেত্রে বিরোধী জোটের প্রধান দল বিএনপির অবস্থান অনেকটাই অস্পষ্ট। ইসলামিজম সম্পর্কেও তাদের অবস্থান অনেকটাই কমপ্লিকেটেড। কখনো কখনো বিএনপি নিজেদেরকে ইসলামের পক্ষের শক্তি, আবার কখনো কখনো মধ্যমপন্থী সেমি-ইসলামিজম আবার কখনো সেক্যুলার পক্ষের শক্তি হিসেবে প্রমাণেরও চেষ্টা করে। ফলে বিএনপির বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক অবস্থান অনেকটাই কমপ্লিকেটেড ধরা হয়।

এর প্রমাণ হিসেবে অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, বিগত ২০১৩ সালের হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দেয়া, আবার জামায়াতে ইসলামী সঙ্গে জোট করা হলেও মাঝে মধ্যেই বলা হয়- এটা তেমন কোনো বিষয় নয়- আমরা শুধু নির্বাচনী জোট করেছি। আবার অনেকে দলের নেতানেত্রীদের পোষাক-আশাকেও কমপ্লিকেটেড ভাব খোঁজার চেষ্টা করেছেন। এর স্বপক্ষে অনেকে সম্প্রতি বাংলাদেশে সফরে আসা মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দিশাই এর সাক্ষাতের সময়কার ছবিটি বিএনপিকে কিছুটা সেক্যুরিজমের প্রতি অগ্রসর হওয়ার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন।

এভাবে বিএনপিকে যেভাবেই মূল্যায়নের চেষ্টা করুক না কেন, তবে এটা সত্য যে, রাজনৈতিক বাস্তবতায় বর্তমানে বড় ধরনের আন্দোলন করার মতো শক্তি বিরোধী জোটের কতটা রয়েছে তা অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। কারণ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভার আলোচ্য বিষয় যেখানে মুহূর্তের মধ্যে হুবহু বাইরে চলে যায়, নেতাদের মিডিয়ার সামনে যতটা তর্জনগর্জন শোনা যায়, বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন নেই। এছাড়া বাস্তবে অনেক নেতাই টেন্ডারবাজি ও অন্যান্য ব্যবসার প্রশ্নে ঠিকই ক্ষমতাসীনদের সাথে আঁতাত করে চলছেন। হাতেগোনা কয়েকজন নেতা ছাড়া বাকীদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ বিস্তর খোদ নিজ দলের নেতাকর্মিদেরই।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, অতীতের সব আন্দোলন সংগ্রাম-বিপ্লব থেকে বলা যায়- ইসলামিজমে কখনো সমাজ বিপ্লবের আগে রাজনৈতিক বিপ্লব সফল হয়নি। আর কখনো দৈব্যচয়িতভাবে রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটে গেলেও সেটা বেশী দিন টিকে থাকতে পারে না। এর প্রমাণ হিসেবে আমরা বলতে পারি- আরব বসন্তের ঢেউয়ে ঘটে যাওয়া মিশরের গণতান্ত্রিক ইসলামি বিপ্লব এক বছরও টিকে থাকতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশে যারা বৃহত্তর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে রাতারাতি রাজনীতিতে ইসলামী বিপ্লব ঘটাতে চান তাদেরকে এই বিষয়টি মাথায় রেখে অগ্রসর হওয়া উচিত।

অন্যদিকে আমরা বলতে পারি- ইসলামী রাজনৈতিক বিপ্লব না ঘটিয়েও সেক্যুলার আদলে রাষ্ট্রগঠনের মাধ্যমেও রাজনীতিতে ইসলামিক চেতনা ধারণ সম্ভব। যেমনটি তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের সেক্যুলার সংবিধান পরিবর্তন না করেও আব্দুল্লাহ গুল ও এরদোগান তুরস্ককে একটি মডারেট মুসলিম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফলে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামির ভাববার সময় এসেছে বলেই আমরা মনে করি।

ফলে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে বলা যায়- সহসাই ক্ষমতার পরিবর্তন হচ্ছে না। এর মধ্যে যদি দৈববশত কোনো ধরনের অঘটন না ঘটে। কেননা, আভ্যন্তরীন ও বিশ্ব সেক্যুলার রাজনীতি ক্ষমতাসীনদের পক্ষেই সমর্থন জুগাচ্ছে। সর্বশেষ দুইদিনের সফরে মোদিও সে ধরনের একটি ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। তাই যে যাই বলুক না কেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়- ক্ষমতাসীনদের এই শাসন হতে পারে তুরস্কের মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের শাসনের মতো ১৫ বছর, হতে পারে ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের মত ২৩ বছর, হতে পারে মিশরের হোসনি মোবারকের মতো ৩০ বছর কিংবা লিবিয়ার গাদ্দাফির শাসনের মতো দীর্ঘ ৪১ বছর।

আমার এই বিশ্লেষণ হয়তো দেশের বিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিরোধী পক্ষের কাছে হাস্যকর মনে পারে। অনেকে যুক্তি দেখিয়ে বলতে পারেন- তুরস্ক, ইরাক, মিশর ও লিবিয়ার মতো পরিস্থিতি এখানে নেই। আবার অনেকে বলতে পারেন- যে সময়ে তারা শাসন করেছিলেন, এখন সে সময়কালেরও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে । ফলে আমার এ ধরনের বিশ্লেষণ কোনোভাবেই যৌক্তিক নয় বলে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করতে পারেন। আমিও তাদের এসব যুক্তির ক্ষেত্রে এক মত পোষণ করি।

কিন্তু আওয়ামী শাসনকাল দীর্ঘায়িত হবার কারণটি কিন্তু সেসব বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত নয়। বিষয়টি একেবারেই সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সাথে সম্পৃক্ত। আর বিশ্ব সম্প্রদায়ের ধারণা এ ধরনের একটি রাষ্ট্র গঠনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটই ভালো ভুমিকা রাখতে পারবে। যদিও রাতারাতি বাংলাদেশ সেক্যুলার রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার রাজনীতিতে অনেকটা কৌশলীভাবেই অগ্রসর হচ্ছে। তারা সহজে ইসলামপন্থী বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে চটিয়ে কিছু করতে নারাজ। তবে মহাজোট সরকার এই মেয়াদের বাকী সাড়ে ৩ বছর ক্ষমতায় টিকে গেলে এবং এই সংবিধানের অধীনেই আরেকটি নির্বাচন করতে পারলে রাষ্ট্রের সেক্যুলারিজম চরিত্র যে অনেক দূর অগ্রসর হবে এতে আমার অন্তত: কোনো সন্দেহ নেই।

অন্যদিকে কোনো কারণে ক্ষমতার পট পরির্তনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন হলেও যে রাতারাতি ইসলামিজমের বিপ্লব হয়ে যাবে এটা ধারণা করারও কোনো সুযোগ নেই। কারণ বাস্তবতায় বিএনপি কখনো পুরোপুরি ইসলামিজমে যেতে নারাজ। তারা সর্বদা মধ্য পন্থা অবলম্বন করেই ক্ষমতায় গিয়ে দেশ শাসন করতে চায়।

সবশেষে বলবো- ইসলামপন্থি কিংবা সেমি ইসলামপন্থিদের জন্য আপাতত কোনো সুসংবাদ কিংবা আশাপদ হবার দিক দেখছি না। তবে এটা সত্য যে- বর্তমানে দেশে সক্রিয় দুটি রাজনৈতিক পক্ষই ইজমকে কাজে লাগিয়ে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে অন্ধকারে রেখে রাষ্ট্র ক্ষমতা ভোগ করাই তাদের মূল লক্ষ্য। ক্ষমতার এই দ্বন্দ্ব থেকে সহজে বের হয়ে দেশপ্রেম নিয়ে জনসাধারণের কল্যাণে শাসন কার্য পরিচালনার এমন জনপ্রত্যাশা অলিক আকাঙ্খা ছাড়া আর কিছুই নয়। ফলে ক্ষমতার এই দ্বন্দ্ব কোন দিকে গড়ায় তা দেখতে আরো কিছুসময় অপেক্ষা করতে হবে আমাদেরকে।

লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক । [email protected]



মন্তব্য চালু নেই