রাজধানীতে চাকরির নামে ভয়ঙ্কর প্রতারণা

চাকরি যেন সোনার হরিণ, প্রবাদে সোনার হরিণ হলেও দেওয়ালে/পত্রিকায় টানানো বিজ্ঞাপনে চাকরি যেন হাতের ময়লা। আসলে ওই বিজ্ঞাপন যে প্রতারণার ফাঁদ তা ফাঁদে পড়ার আগে কেউ টের পান না। সম্প্রতি রাজধানীতে এমনই প্রতারণা ফাঁদ এবং প্রতারক চক্রের সন্ধান পেয়েছে র‌্যাব। প্রতারণার চিত্র এবং প্রতারিত হওয়া বেকার যুবকদের কথা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক নয়া দিগন্ত।

গতকাল রাজধানীর নিকুঞ্জের একটি প্রতারক প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় র‌্যাব। মিথ্যা বিজ্ঞাপনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার অভিযোগে হাতেনাতে চারজনকে গ্রেফতার করেন তারা। তারা হলেন- সজরুল ইসলাম তরিকুল (৩০), রফিকুল ইসলাম (২২), মহিউদ্দিন রনি (৪১) ও আমিরুল ইসলাম(৩৬)। গ্রেফতারকৃতরা তাদের দোষ স্বীকার করেছে। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ এইচ এম আনোয়ার পাশা তাদের প্রত্যেককে এক বছর করে কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা করে জরিমানা করেন। জরিমানা অনাদায়ে আরো তিন মাসের কারাদণ্ড প্রদান করেন মোবাইল কোর্ট।

যেভাবে আকৃষ্ট করা হয় বেকারদের

মিডিয়া নামে তাদের দালাল রয়েছে যারা বিভিন্ন পত্রিকায় বিমান বালা, প্রবাসী ম্যাডাম, চিত্রনায়িকা, ধনাঢ্য ব্যক্তির এপিএস-দেহরক্ষী ইত্যাদি পদে বিজ্ঞাপন দেয় এবং সিকিউরিটি মানি গ্রহণ করে ট্রেনিংয়ের কথা বলে বিভিন্ন কোম্পানির নাইট গার্ডের ডিউটিতে ঢুকিয়ে দিত। ট্রেনিং শেষ না হওয়ায় চাকরিপ্রত্যাশীরা একপর্যায়ে বেতন ও সিকিউরিটি মানি ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।

শুধু জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়ই নয়, চাকরির এ রকম চটকদার বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে আছে রাজধানীর ঢাকার সবখানে। এসব বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা আছে, স্বল্প সময়ে আকর্ষণীয় বেতনের লোভনীয় অনেক অফার। আর এই অফারের ফাঁদে পা ফেলে মোটা অঙ্কের টাকার পাশাপাশি মূল্যবান অনেকটা সময় খোয়াতে হয় সহজ-সরল মানুষগুলোকে। এমন ঘটনা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় হরহামেশাই ঘটছে। দেশের সহজ-সরল মানুষ ঢাকায় এসে ঢাকার পরিবেশের সাথে পুরোপুরি পরিচিত হওয়ার আগেই প্রতারকরা তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় বিপুল অর্থ।

র‌্যাব সূত্র জানায়, এ ধরনের বিজ্ঞাপনের নেপথ্যে রয়েছে কয়েকটি প্রতারকচক্র। এসব প্রতারক কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালক কিংবা কর্মকর্তাও নয়। তারা নিজেরাই নিজেদের মতো করে চাকরির বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। আর এই বিজ্ঞাপন দেখে প্রতারণার ফাঁদে পা বাড়ান চাকরিপ্রত্যাশীরা।

প্রতারিত হওয়া বেকারদের কয়েকজন

ঝালকাঠির নলসিটি উপজেলার নজরুল ইসলাম ১৯৮৭ সালে এইচএসসি পাস করার পর থেকেই সংসারের হাল ধরেন। ব্যবসায়বাণিজ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজ করেছেন। কিন্তু কোনো কাজেই তিনি সফল হননি। হঠাৎ দেশের প্রথম সারির একটি পত্রিকার দ্বিতীয় পাতায় ইতালি প্রবাসী ম্যাডামের এপিএস নিয়োগের বিজ্ঞাপনে চোখ পড়ে তার। মুহূর্তেই মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন নজরুল। এরপর গত সোমবার ঢাকায় এসে খিলগাঁও নিকুঞ্জের ৬ নম্বর রোডের ৫৪ নম্বর বাড়ির নিচতলায় ‘বিটকো’ নামক চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করেন। তখন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তার কাছে তিন হাজার টাকা দাবি করেন। তাহলেই চাকরি হয়ে যাবে নজরুলের। কিন্তু নজরুলের কাছে কোনো টাকা না থাকায়, তার ব্যাগ রেখে দেন তারা। পরে টাকা নিয়ে যোগাযোগ করতে বলেন। রফিকই নয়, সিরাজগঞ্জের আব্দুল হাকিম। বিবিএ পাস করেছেন। তিনিও ‘বিটকো’তে এরিয়া ম্যানেজার হিসেবে ১৮ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে চাকরির জন্য দুই হাজার টাকা জমা দিয়ে রিসিট নেন। এ সময় আরো অন্তত ২০-২৫ জন চাকরিপ্রত্যাশী ওই প্রতিষ্ঠানে দুই থেকে তিন হাজার টাকা জমা দিচ্ছিলেন।

ভুক্তভোগী হাকিম জানান, তিনি বিভিন্ন জব সাইটে চাকরির জন্য তার জীবনবৃত্তান্ত মেইল করেছেন। ওই প্রতিষ্ঠানের লোকজন সেখান থেকে তার তথ্য সংগ্রহ করে তাকে ই-মেইলের মাধ্যমে ওই চাকরির নিয়োগপত্র পাঠান এবং গতকাল সিকিউরিটি চার্জ বাবদ ওই অফিসে টাকা জমা দেয়ার জন্য জানান। সরল বিশ্বাসে হাকিম দুই হাজার টাকা জমা দেন। ১০ দিন পর সাভার এলাকায় মোবাইল ফোন টাওয়ারগুলো তদারকি বিষয়ে এরিয়া ম্যানেজার হিসেবে চূড়ান্ত নিয়োগপত্র নিয়ে প্রশিক্ষণে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে বলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাকিমের সেই স্বপ্ন কি পূরণ হবে? না, হবে না। চাকরি দেয়ার নামে এটি একটি চক্রের প্রতারণা। বিজ্ঞাপন দেখে ‘চাকরি নামে সোনার হরিণ’ ধরার স্বপ্নে বিভোর হন নজরুল, হাকিমের মতো হাজারো চাকরিপ্রত্যাশী। সে স্বপ্নই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। চাকরির আশায় উল্টো সব কিছু খোয়াতে হয় তাদের।

প্রতারকের মুখে প্রতারণার কথা

বিটকো প্রতিষ্ঠানের মালিক অভিযুক্ত সজরুল বলেন, প্রতারণার জন্যই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ও মেইল পাঠানো হয়েছে। আমার পক্ষে চাকরি দেয়া সম্ভব নয়। শুধু সার্ভিস চার্জ নিয়ে পরে অন্যত্র গিয়ে একই ধরনের প্রতারণা করতেন তিনি।

তিনি আরো জানান, কোনো কোনো ব্যক্তিকে মোটা বেতনে চাকরি দেয়ার কথা বলে কম বেতনের সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিতে পাঠাত। সেখানে টিকতে না পেরে কিছুদিন পর প্রার্থী নিজে ইচ্ছাই চাকরি ছেড়ে পালিয়ে যায়। ফলে সিকিউরিটি মানির টাকা এবং যে ক’দিন ডিউটি করে তার টাকা তাদের লাভ হিসেবে থাকে। কিন্তু মধ্যখান থেকে প্রতারণার শিকার হয় চাকরিপ্রত্যাশী সাধারণ মানুষ। তিনিও ইতঃপূর্বে একইভাবে প্রতারিত হয়ে প্রতারণার কৌশল শিখে এখন নিজেই এসব কাজ করছেন বলে জানান সজরুল।

সজরুল আরো জানান, মিডিয়া নামে তাদের কয়েকজন লোক রয়েছে যারা বিভিন্ন পত্রিকায় বিমান বালা, প্রবাসী ম্যাডাম, চিত্রনায়িকা, ধনাঢ্য ব্যক্তির এপিএস-দেহরক্ষী ইত্যাদি পদে চুকরি দেওয়ার নাম করে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিতাম এবং সিকিউরিটি মানি গ্রহণ করে ট্রেনিংয়ের কথা বলে বিভিন্ন কোম্পানির নাইট গার্ডের ডিউটিতে ঢুকিয়ে দিতাম। আসলে চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।

হয়েছে সাজা

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশা বলেন, বিভিন্ন পত্রিকায় এ চক্রটি আকর্ষণীয় বেতনের চাকরির বিজ্ঞাপন দিয়ে সহজ সরল মানুষের কাছ থেকে সিকিউরিটি অ্যান্ড সার্ভিস চার্জ বাবদ দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা আদায় করে। কিন্তু চাকরি না দিয়ে ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে। অনেক সময় চাকরিপ্রত্যাশীদের মারধর ও ভয়ভীতি দেখায়। অভিযানের সময় ওই প্রতিষ্ঠানে ২০-২৫ জন চাকরির জন্য টাকা জমা দিতে এসেছিলেন এবং তাদের কাছ থেকে টাকা জমা নেয়া হচ্ছিল। এ কারণে প্রতারণার অভিযোগ তাদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।

তিনি জানান, আমিরুল ওই বাড়ির মালিকের কাছ থেকে ৯ মাস আগে বাড়িটি ভাড়া নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে এরূপ কাজ করাচ্ছিল। গত দুই মাস ধরে সজরুল এখানে কাজ করছে। আগে সুমন এবং পারভেজকে দিয়ে সে এ কাজ করিয়েছে। মহিউদ্দিন ও রফিকুল সজরুলকে প্রতারণার কাজে সহযোগিতা করত। তাদের প্রত্যেককে এক বছর করে কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানা অনাদায়ে আরো তিন মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতে হতে পারে তাদের।

কোথায় সক্রিয় প্রতারকেরা

জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুর, শ্যামলী, বাড্ডা, মৌচাক, পল্টন ও যাত্রাবাড়ীর বিভিন্ন এলাকায় চাকরিদাতা প্রতারকচক্র সক্রিয়ভাবে তাদের প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতারকরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে রুম ভাড়া করে চাকরি দেয়ার নাম করে সহজ সরল মানুষের নিয়মিত প্রতারণা চালিয়ে আসছে। এক দফা নিয়োগ দেয়ার পর নিয়োগপ্রাপ্তদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত অর্থ আদায় হয়ে গেলেই সটকে পড়ে প্রতারক চক্র।

জানা যায়, প্রতারকদের কেউ কেউ চাকরির নামে প্রথমেই মোটা অঙ্কের জামানত চেয়ে বসে। তারপর বিভিন্ন অজুহাতে কয়েক দফা অর্থ করেন চাকরিপ্রার্থীর কাছে। তার মধ্যে সরকারি অনুমোদন এনে দেয়া, নির্ধারিত পোশাক তৈরি ও বিভিন্ন কাগজপত্র বানিয়ে দেয়ার দোহাই থাকে। টাকা আদায় শেষ হলে সাময়িক জায়গা বদল করে এ প্রতারকেরা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কাজ করলেও জনগণের সচেতনতা ছাড়া এই প্রতারণা বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।



মন্তব্য চালু নেই